মনুসংহিতা রাজধর্ম অনুসারে দণ্ডের উৎপত্তি প্রকৃতি ও কার্যকলাপ বিষয়ে মহর্ষি মনুর মতামতের সমালোচনাত্মক আলোচনা করা হয়েছে | মনুর অনুসরনে দণ্ডের উৎপত্তি এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা কর।
১) দণ্ডের উৎপত্তি প্রকৃতি ও কার্যকলাপ বিষয়ে মহর্ষি মনুর মতামতের সমালোচনাত্মক আলোচনা কর। অথবা, মনুর অনুসরনে দণ্ডের উৎপত্তি এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা কর।
মনুসংহিতা -য় রাজধর্মঃ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে দন্ডের দন্ডের প্রকৃতি ও উপযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
মনুসংহিতা রাজধর্ম অনুসারে দন্ডের উৎপত্তি প্রকৃতি ও কার্যকলাপ
ভারতীয় সামাজিক বিধি বিধানের বেদমূল্য গ্রন্থ মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে রাজধর্ম বিষয়ক আলোচনার অবসরে আচার্য মনু দণ্ডের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। অরাজক রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে ঈশ্বর প্রজাদের রক্ষার জন্য দেবতাদের সারভূত অংশ থেকে রাজাকে সৃষ্টি করেন। এই ঐশ্বরিক রাজার রাজকীয় ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হল দণ্ড।
দম্ ধাতুর উত্তর ড প্রত্যয় যোগে দণ্ড শব্দটি নিষ্পন্ন। নিরুক্তকার যাস্কের মতে দণ্ড শব্দের বহুবিধ অর্থের মধ্যে অন্যতম হল দমন করা, যা এসেছে দম্ ধাতু থেকে। কামন্দকীয় নীতিসারে একই অর্থে দণ্ডের প্রয়োগ হয়েছে-
“দমো দণ্ড ইতি প্রোক্তঃ।”
দণ্ড সম্পর্কে মহাভারতের শান্তি পর্বেও বলা হয়েছে-
“দণ্ডেন নীয়তে চেদং দণ্ডং নয়তি বা পুণঃ।
দণ্ডনীতিরিতি খ্যাতা ত্রীল্লোঁকানভিবর্ততে।।”
দন্ডসৃষ্টির কারন
এই শাস্ত্র অনুসারে রাজা দণ্ড দ্বারা এই জগতকে সৎপথে পরিচালিত করবেন।মনু বলেছেন রাজার শাসনকার্যের সুবিধার্থে দণ্ডের সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দণ্ড হল ব্রহ্মতেজোময় এবং ধর্মস্বরূপ। সমস্ত প্রাণীর রক্ষক রূপেও দণ্ডের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই উল্লিখিত হয়েছে-
“তস্যার্থে সর্বভূতানাং গোপ্তারং ধর্মমাত্মজম্।
ব্রহ্মতেজোময়ং দণ্ডমসৃজত্ পূর্বমীশ্বরঃ।।”
প্রবলের ভয়ে ধাবমান বিশৃঙ্খল চরাচরকে সুষ্টুভাবে রক্ষা ও পালন করার জন্য ঈশ্বর যখন রাজাকে সৃষ্টি করেন, তার পূর্বে রাজার কার্য সাধনের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মতেজোময় সর্বরক্ষক,ধর্মস্বরূপ দন্ডকে সৃষ্টি করেন।
দন্ডের প্রকৃতি ও কার্যকলাপ
দন্ডই স্থাপর জঙ্গম,প্রানীগন সুখভোগে এবং এবং সধর্মে নিয়োজিত থাকার পক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত হওয়ায় দেশ,কাল,পাত্র বিবেচনা করে রাজা অন্যায়কারীর প্রতি যথাযথ দন্ড প্রয়োগ করেন। এই দন্ডের মধ্যে রাজার প্রকৃত যোগ্যতা নিহিত থাকে। অর্থাৎ দন্ডই নেতা,দন্ডই রাজা, দন্ডই শাসক,দন্ডই চতুরশ্রম ধর্মের রক্ষক। কারন,দন্ড প্রজাকূলকে রক্ষনাবেক্ষন করে থাকে বলে দন্ডকে ধর্মের প্রতিভূস্বরূপ বলা হয়েছে।
দন্ডের ভয়ে প্রজাকূল ন্যায়পথে চালিত হয় এবং নিজ নিজ বিষয়ভোগে সমর্থ্য হয়। ন্যায় অনুসারে দন্ড প্রযুক্ত হলে রাজ্যে অনেক সুফল দেখ যায়। তেমনি অন্যায়ভাবে দন্ড প্রযুক্ত হলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়।
এখানে ধর্ম শব্দের অর্থ শৃঙ্খল। দণ্ডই সেই শৃঙ্খল আনয়ন করে। দণ্ড অপরাধীকে ভীত ও সংযত করে, ফলে সমাজের সকলেই সুখে বসবাস করে। দণ্ড যদি না থাকত তাহলে রাজ্যে মাৎস্যন্যায়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। এই দণ্ডের ভয়ে সমস্ত প্রাণী নিজ নিজ জাগতিক বস্তু উপভোগ সমর্থ হয় এবং প্রত্যেকে স্ব স্বধর্মে অবিচল থাকে। আচার্য মনু এই প্রসঙ্গে বলেছেন-
“সর্বো দণ্ড জিতো লোকো দুর্লভো হি শুচির্নরঃ
দণ্ডস্য হি ভয়াৎ সর্বং জগদ্ ভোগায় কল্পতে।।”
দণ্ডই যথার্থ রাজকীয় শক্তি। দাহিকা শক্তিকে যেমন অগ্নি থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনি আচার্য মনুর মতে রাজা নন, দণ্ডই সকলকে শাসন করে, দণ্ডই সমস্ত প্রজাকে রক্ষা করে, কারণ অন্য সমস্ত ব্যক্তি এমনকি রাজপুরুষেরাও যখন সুপ্ত, বিশ্ব যখন নিদ্রা মগ্ন তখন একমাত্র প্রহরীর ন্যায় দণ্ডই সদাজাগ্রত থাকে-
” দণ্ডঃ শাস্তি প্রজাঃ সর্বা দণ্ড এবাভিরক্ষতি।
দণ্ডঃ সুপ্তেষু জাগর্তি দণ্ডং ধর্মং বিদুর্বুধাঃ।।”
দণ্ডই স্থাবর, জঙ্গম, প্রাণীগণের সুখলাভের এবং স্বধর্মে থাকার পক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত হওয়ায় দেশ, কাল, পাত্র বিবেচনা করে রাজা অন্যায়কারীর প্রতি দণ্ড প্রয়োগ করেন। একাধারে দণ্ডই রাজা, পুরুষ, নেতা, শাসিতা এবং ব্রহ্মচর্যাদি চতুরাশ্রমের রক্ষক। তাই আচার্য মনু বলেছেন-
“স রাজা পুরুষো দণ্ডঃ স নেতা শাসিতা চ সঃ
চতুর্ণামাশ্রমানাঞ্চ ধর্মস্য প্রতিভূঃ স্মৃতঃ।।”
শুধু মানুষ নয় দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, রাক্ষস,পক্ষী এবং সর্পকুলও দণ্ডের দ্বারা নিপীড়িত হয়েই জগতের উপকার সাধন করে থাকে। দণ্ড যেখানে সদা জাগরুক রাজাও সেখানে স্থির মনে রাজকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হন। ফলে জীবকুল কখনো দুঃখ ভোগী হয় না। তাই আচার্য মনু বলেছেন-
“যত্র শ্যামো লোহিতাক্ষো দণ্ডশ্চরতি পাপহা।
প্রজাস্তত্র ন মুহ্যন্তি নেতা চেৎ সাধু পশ্যতি।।”
আচার্য কৌটিল্য মনুর মতকে স্বীকার করে বলেছেন সকলকে বশে রাখার একমাত্র উপায় হল দণ্ড। কিন্তু কৌটিল্য স্বয়ং এমত স্বীকার করেননি। তাঁর মতে যে রাজা তীক্ষ্ণদণ্ড প্রদান করেন তিনি প্রাণীর উদ্বেগের কারণ। আবার যে রাজা মৃদুদণ্ড দেন তিনি স্বয়ং পরাভব বরণ করেন। কিন্তু যে রাজা যথার্থ দণ্ড প্রদান করেন তিনি সকলের পূজ্য হন। তিনি আরও বলেন যে যদি দণ্ড একেবারেই প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে রাজ্যে মাৎস্যান্যায় অর্থাৎ চরম অরাজকতা বিরাজ করবে। অর্থাৎ রাজা বা দণ্ড প্রণেতার অভাবে বলবান লোকেরা দুর্বল লোককে গ্রাস করবে।
“যদি ন প্রণয়েদ্রাজা দণ্ডং দণ্ড্যেষ্বতন্দ্রিতঃ।
শূলে মৎস্যানিবাপক্ষ্যন্ দুর্বলান্ বলবত্তরাঃ।।”
দণ্ডের অপপ্রয়োগের ব্যাপারও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন মনু-
“দুষ্যেয়ুঃ সর্ববর্ণাশ্চ ভিদ্যেরন্ সর্বসেতবঃ।
সর্বলোক প্রকোপশ্চ ভবেদ্দণ্ডস্য বিভ্রমাৎ।।”
যদিও রাজ্য পরিচালনাতে দণ্ড অতুলনীয় তথাপি রাজাকে দণ্ড প্রয়োগ সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যথাশাস্ত্র দণ্রড প্রয়োগে যেমন সুফল লাভ করা যায়, অন্যায়ভাবে দণ্ড প্রযুক্ত হলে তেমন কুফলও ঘটে থাকে। সমাজে প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কাক, কুকুর প্রভৃতি নিকৃষ্ট ও অপবিত্র প্রাণীরা যজ্ঞীয় হবি ভক্ষণ করে। কোথাও কারও প্রভুত্ব স্বীকৃতি পায় না। এই প্রসঙ্গে আচার্য মনুর উক্তিটি হল-
“অদ্যাৎ কাকঃ পুরোডাশং শ্বাবলিহ্যাদ্ধবিস্তথা।
স্বাম্যঞ্চ ন স্যাৎ কস্মিংশ্চিৎ প্রবর্তেতাধরোত্তরম্।।”
আবার দণ্ডের অশেষ উপযোগিতা আছে বলেই যে রাজা সর্বদা দণ্ড প্রয়োগে উন্মুখ হয়ে থাকবেন তা নয়। কারণ উগ্রদণ্ড রাজা প্রজানুরঞ্জন হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে মহামতি কৌটিল্যের মতটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য –
” তীক্ষ্ণদণ্ডো হি ভূতানামুদ্বেজনীয়ো ভবতি।”
উপসংহারঃ-
আচার্য কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে উপসংহারে গিয়ে বলেছেন-
‘চতুবর্ণাশ্রমো লোকে রাজ্ঞা দণ্ডেন পালিতঃ।’
তাই দণ্ডের প্রয়োগ কর্তাকে হতে হবে বিশুদ্ধ চিত্ত, সত্যবাদী, শাস্ত্রবিদ্, সহায়সম্পন্ন বুদ্ধিমান। আচার্য মনু এই প্রসঙ্গে বলেছেন-
“শুচিনা সত্যসন্ধেন যথাশাস্ত্রানুসারিনা।
প্রণেতুং শক্যতে দণ্ডঃ সুসহায়েন ধীমতা।।”
একথা সত্য যে, রাজা ঈশ্বরের মতোই অসীম ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তার ক্ষমতাও শাস্ত্রের দ্বারা সীমাবদ্ধ ও স্থিরীকৃত। অতিরিক্ত বিষয় ভোগে আসক্ত, অদূরদর্শী, অমার্জিত বুদ্ধি, রাজাদের হাতে দণ্ডের অপপ্রয়োগ সমস্ত জগৎবাসীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সুতরাং বিধাতার দ্বারা সৃষ্ট দণ্ডের প্রয়োগ বিষয়ে রাজার সতর্কতা অবলম্বন একান্ত কর্তব্য।
মনুসংহিতা গ্রন্থে আচার্য মনু দন্ডকে ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে অভিহিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- দন্ড দন্ডই পুরুষ। অর্থাৎ অন্যান্য পুরুষেরা দন্ডের কাছে নিষ্প্রভ। দন্ড দ্বারা সমস্ত কার্য পরিচালিত হয়। রাজা দন্ডের প্রতিনিধি মাত্র। তাই বলা যায় যে, দন্ডই শাসনকর্তা।
মনুসংহিতা সপ্তম অধ্যায় রাজধর্ম হতে অন্যান্য পোস্ট গুলি
- মনুসংহিতা রাজধর্ম সপ্তম অধ্যায় হতে শ্লোক ব্যাখ্যা-12
- মনুসংহিতা রাজধর্ম সপ্তম অধ্যায় হতে শ্লোক বাখ্যা-11
- মনুসংহিতা রাজধর্ম সপ্তম অধ্যায় হতে শ্লোক বাখ্যা-10
- মনুসংহিতা রাজধর্ম সপ্তম অধ্যায় হতে শ্লোক বাখ্যা-9
- মনুসংহিতা রাজধর্ম সপ্তম অধ্যায় হতে শ্লোক বাখ্যা-8
- মনুসংহিতা রাজধর্ম সপ্তম অধ্যায় হতে শ্লোক সংস্কৃত বাখ্যা-7
- মনুসংহিতা শ্লোক (রাজধর্ম ) সংস্কৃত বাখ্যা -6
- মনুসংহিতা (রাজধর্মঃ) সংস্কৃত শ্লোক বাখ্যা-5
- মনুসংহিতা শ্লোক (রাজধর্মঃ) সংস্কৃত ব্যাখ্যা-4
- মনুসংহিতা (রাজধর্ম) সংস্কৃত শ্লোক ব্যাখ্যা-3
- মনুসংহিতা সপ্তম অধ্যায় (রাজধর্ম) হতে শ্লোক সংস্কৃত বাখ্যা-2
- মনুসংহিতা সপ্তম অধ্যায় রাজধর্ম হতে সংস্কৃত বাখ্যা-1
- মনুসংহিতা: কুলং দহতি রাজাগ্নিঃ স পশুদ্রব্যসঞ্চয়ম্ – উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ
- মনুসংহিতা: দণ্ডের উৎপত্তি প্রকৃতি ও কার্যকলাপ
- মনুসংহিতা অনুসারে দন্ডের উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য
- মনুসংহিতা অনুসারে দূত সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ বিবরণ দাও
- মনুসংহিতা অনুসারে মনুর মতে রাজার বিনয়ের গুরুত্ব
- মনুসংহিতা অনুসারে রাজার মন্ত্রনা বিধি
- মনুসংহিতা (রাজধর্ম) হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
- মনুসংহিতা অনুসারে ব্যসন কী ? ব্যসনের বিভাগসমূহ প্রভাব ও পরিনাম আলোচনা কর
- মনুসংহিতা অনুসারে ষড়গুণ -এর প্রয়োগ নির্দেশ
- রাজার প্রাত্যহিক কৃত্যগুলি কী কী ( মনুসংহিতা )
- মনুসংহিতা: রাজার উৎপত্তির ঐশ্বরিক মতবাদ আলোচনা কর।
- মনুসংহিতা অনুসারে মনুর মতে দূর্গ কয় প্রকার ও কি কি
- মনুসংহিতা অনুসারে দন্ডের প্রকৃতি ও উপযোগিতা
- মনুসংহিতা অনুসারে মনুর মতে রাজার বিনয়ের গুরুত্ব-2
- মনুসংহিতা অনুসারে ব্যসন ও মৃত্যুর মধ্যে কোনটি ক্ষতিকর
- মনুসংহিতা অনুসারে রাজার উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
- ব্যসন কি? ব্যসন কয় প্রকার- পুূর্ববর্তী ব্যসনগুলি পরবর্তী ব্যসনের চেয়ে ক্ষতি কারক কেন?