ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা- কে অবলম্বন করে পূর্বপক্ষের মত খন্ডন পূর্বক মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর। মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
৩) ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা- কে অবলম্বন করে পূর্বপক্ষের মত খন্ডন পূর্বক মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর। মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর।
ভূমিকা:– আপস্তম্ব তাঁর যজ্ঞপরিভাষা গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্’। সুতরাং বেদের দুটি ভাগ -মন্ত্রভাগ এবং ব্রাহ্মণভাগ। এই দুই ভাগ নিয়ে হল বেদ। এই দুই ভাগ নিয়ে হল বেদ। এটাই বেদের লক্ষণ। আবার স্বতঃ প্রমাণ, বেদের অস্তিত্ব সাধক অন্য কোনোও প্রমাণ প্রদর্শনের আবশ্যকতা নেই। এইভাবে লক্ষণ ও প্রমাণ নিরূপিত হওয়ায় বেদের মন্ত্রভাগের প্রামাণ্য আছে কিনা। অর্থাৎ মন্ত্রভাগ প্রমাণ কিনা বা মন্ত্রভাগে প্রমাণের কোনো লক্ষণ সঙ্গত হয় কিনা ।
সায়ণাচার্য বিষয়টি যুক্তিসহ পর্যালোচনা করেছেন।
মন্ত্রভাগের প্রামাণ্য নিরূপন:-
“ননু অস্ত নাম বেদাখ্যঃ……ন প্রমাণম্।”
প্রসিদ্ধ তিনটি প্রমাণের মধ্যে বেদ শব্দ প্রমাণ। বেদকে সিদ্ধান্তী অপৌরুষেয় আগম প্রমাণ’ বলেছেন।
মন্ত্রভাগের প্রামাণ্য বিষয়ে পূর্বপক্ষ:-
কিন্তু পূবাপক্ষীর আশঙ্কা এই, বেদের অন্তর্ভূক্ত মন্ত্রভাগের কোনও প্রামাণ্য নেই। কেননা, প্রমাণের কোনও লক্ষণই মন্ত্রভাগরূপ আগম প্রমাণে সমন্বিত হয়না। প্রমাণের সম্ভাব্য নিম্নোক্ত প্রসিদ্ধ দুটি লক্ষণকে আচার্য সায়ণ তাঁর ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন-
- ১) সম্যক্ অনুভবের সাধনই প্রমাণ। অর্থাৎ যার দ্বারা অসন্দিগ্ধ, অবিপর্যস্ত ও অবিরুদ্ধ কোনও বস্তুর যথার্থ অনুভবরূপ জ্ঞান (প্রমা জ্ঞান) উদিত হয়, সেটাই প্রমাণ। সায়ণাচার্যের উক্তি- ‘ সম্যগনুভবসাধনং প্রমাণম্। ‘
- ২) অথবা যার দ্বারা অনধিগত বা অজ্ঞাত কোনও বিষয়ের বোধ জন্মে সেটাই প্রমাণ। আচার্য্যের উক্তি- “অনধিগতার্থগতপ্রমাণম্”।
পূর্বপক্ষীর মত অনুসারে, প্রমাণের উক্ত দুটো লক্ষণেই মন্ত্রভাগরূপ শব্দ প্রমাণে সংগত হতে পারে না। সুতরাং মন্ত্রভাগের প্রমাণত্বই যদি সিদ্ধি না হয়, তবে সেটি অবশ্যই নিষ্প্রয়োজন হবে ও অব্যাখ্যেয় হবে। বিবাদিগণের উদ্ভাসিত এরূপ পূর্বপক্ষকে লক্ষ্য করে আচার্য সায়ণের প্রবচন – ” নাসৌ ব্যাখ্যানমর্হতি। অপ্রমাণত্বেনানুপযুক্তত্বাৎ।।” (ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা)।
এখানে পূর্বপক্ষীর অভিপ্রায় এই, সমগ্র বেদে অনেক মন্ত্র আছে, যাদের কোনও অর্থ উপলব্ধ হয় না। যেমন- ‘ অম্যক্ সা ত ইন্দ্র ঋষ্টিঃ (ঋগ্বেদ ১/১৬৯/৫)। ইত্যাদি মন্ত্রে থেকে কোনও অর্থবোধ হয় না। এই মন্ত্রের যখন কোনও অর্থের অনুভবই সম্ভবপর নয়, তখন সেখানে যে অনুভবের সম্যকত্ব ও সাধনত্ব কোনো ভাবেই থাকতে পারে না তা সন্দেহাতীত।
অতএব এই মন্ত্রগুলো সম্যক্ অনুভবের সাধন হতে পারে না বলে প্রমাণের সায়ণোক্ত প্রথম লক্ষণটি এখানে সংগত হয়না। এইজন্য বেদবিরোধীগণ বলেন, এসব মন্ত্রের কোনোও প্রামাণ্য নেই।
আবার ‘অধঃস্বিদাসীৎ উপরিস্বিদাসীৎ’ (ঋগ্বেদ ১০/১২৯/৫) ইত্যাদি মন্ত্র নিচে ছিল, অপরে ছিল- এরূপ অর্থের বোধক হলেও ‘এটা সম্ভব না পুরুষ ‘ ইত্যাদি বাক্যের ন্যায় সন্দিগ্ধ অর্থবোধক। এর ফলে এখানে অসন্দিগ্ধ বস্তু বিষয়ক সম্যক অনুভবের সাধনত্বরূপ প্রমাণ লক্ষণের সমন্বয় না হওয়ায় এ ধরনের মন্ত্রেরও সিদ্ধ হয় না।
আর ‘ওষধে ত্রায়স্বৈনম্ ‘ (তৈত্তিরীয়সংহিতা ১/২/১/১) ( হে ওষধি, একে রক্ষা কর) -কুশবিষয়ক এই মন্ত্রে অচেতন কুশ সচেতন রূপে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই অবিপরীত অর্থের সম্যক্ অনুভবসাধনত্ব রূপ প্রমাণ লক্ষণটি এখানে অব্যাপ্ত হওয়ায় এই মন্ত্রের প্রামাণ্য ব্যবহৃত হয়েছে।
‘আপ উন্দন্তু’ (অথর্ববেদ ৬/৩৮/২) – (হে জল, আমাকে ক্লিন্ন কর) -এই মন্ত্রটি ক্ষৌর কর্ম করার সময়ে যজমানের মস্তককে সিদ্ধ করা হোক এরূপ অর্থ বুঝিয়েছে।
এই মন্ত্র লোক প্রসিদ্ধ অর্থের অনুবাদক হওয়ায় অধিগত অর্থেরই জ্ঞাপক হয়েছে। তাই এখানে ‘ অনধিগতার্থগন্তু প্রমাণম্’- প্রমাণের এই দ্বিতীয় লক্ষণটি সমন্বিত হতে পারে না।
এই কারণে পূর্বপক্ষীর আশঙ্কা এই, এসব স্থলে মন্ত্রভাগের কোনও প্রামাণ্য নেই। সুতরাং ঐ মন্ত্রভাগ ব্যাখ্যানর্হ।
মন্ত্রভাগের প্রামাণ্য স্থাপনকল্পে উত্তরপক্ষ:-
“অম্যগাদিমন্ত্রাণাম্….. মন্ত্রভাগস্য প্রামাণ্যম্।”
বেদবিরোধিগণ যেভাবে মন্ত্রভাগের প্রামাণ্য আশঙ্কা করেছেন, সিদ্ধান্তী মীমাংসকগণ বাধক যুক্তি দ্বারা সে সব শঙ্কা যথাযথভাবে নিরসন করেছেন।
পূর্বপক্ষিগণ ‘অম্যক্ সা ত’ – ইত্যাদি যে মন্ত্রগুলির অর্থ পরিগ্রহ হয় না বলেছেন, মহর্ষি যাস্ক নিরুক্ত গ্রন্থে সে সব মন্ত্রের অর্থ স্পষ্ট করেই নির্দেশ করেছেন। অজ্ঞ জন অজ্ঞানবশতই বিদ্যমান পদার্থের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন না, তাকে উপলব্ধি করতে জ্ঞানী জনই পারেন। বেদে অনেক অপ্রসিদ্ধ শব্দ আছে। সেজন্য বেদ অধ্যয়নের আগেই বেদাঙ্গগুলিকে অধ্যয়ন করতে হয়, এরূপ নিয়ম শ্রুতিতেই করা হয়েছে- ‘অনধ্যায়েষ্বঙ্গান্যধীয়ীতে’। কিন্তু অবশ্য অধ্যেয় নিরুক্ত, ব্যাকরন প্রভৃতি বেদাঙ্গগুলি অধ্যয়ন না করেই যদি কেউ বলেন, ওই সব মন্ত্রগুলো অর্থহীন, তাহলে সেটি তো কখনোই মন্ত্রের দোষ হতে পারে না,সেটি অজ্ঞের দোষ। অন্ধ ব্যক্তি বিশাল স্তম্ভকে যে দেখতে পায় না, সে দোষ স্তম্ভের নয়, সে দোষ অন্ধেরই । লোক ন্যায়সিদ্ধ এই উদাহরণ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, নিজের অজ্ঞতাবশত যদি কেউ বেদার্থ অবগত না হন, তাতে বেদ অর্থহীন বা অপ্রমাণ হয়ে যায় না। ওই মন্ত্রের দুরূহ অর্থ নিরুক্তাদি গ্রন্থের সাহায্যে নিশ্চিতরূপে বোধগম্য হয় বলে মন্ত্র গুলির প্রামাণ্য সুরক্ষিত হয়।
আর ‘অধঃ স্বিদাসীৎ, উপরিস্বিদাসীৎ’ ইত্যাদি মন্ত্র সন্দেহের দ্যোতক নয়। এখানে সর্বব্যাপী পরমপুরুষকে লক্ষ্য করেই মন্ত্রটি প্রযুক্ত হয়েছে। ঊর্ধ্বদেশে ও অধোদেশে সর্বত্র তাঁর বিদ্যমানতা এখানে সূচিত হয়েছে। শাস্ত্রহীন, গুরুহীন ও সম্প্রদায়হীন ব্যক্তি পরমপুরুষের এই অতি গম্ভীর তত্ত্ব বুঝতে সক্ষম না হয়ে এ জাতীয় মন্ত্রকে সন্দিগ্ধার্থ মনে করেন। এর দ্বারা কখনই এটা সিদ্ধ হয় না যে, এসব মন্ত্রের কোনও প্রামাণ্য নেই। বরঞ্চ অসন্ধিগ্ধ অর্থেরই বোধক হওয়ায় এসব মন্ত্রের প্রমাণত্ব ক্ষুন্ন হয় না।
এরূপ ‘ওষধেত্রায়স্ব’ ইত্যাদি মন্ত্রে ঔষধি, ক্ষুর ও পাষানকে সম্মোধন করে অচেতন পদার্থকে লক্ষ্য করা হয়নি, কিন্তু অধিষ্ঠাত্রী, চেতন দেবতাকে লক্ষ্য করে ওই শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে। তাই ‘ওষধে ত্রায়স্ব’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনোও বিরোধ নেই। অতএব উক্ত মন্ত্রটিতে কোনও বিপরীত অর্থ বোধিত না হওয়ায় উক্ত প্রমাণ লক্ষণটি সমন্বিত হয়েছে এবং এই মন্ত্রের প্রামাণ্যও সুরক্ষিত হয়েছে।
“আপ উন্দন্তু”- ইত্যাদি মন্ত্রে জলের দ্বারা মস্তকের ক্লেদন বা আর্দ্রীকরণ রূপ কার্য লোক প্রসিদ্ধ হলেও, সেই সেই অধিষ্ঠাত্রী দেবতার অনুগ্রহে এইরূপ কার্য হয় এ অর্থ প্রসিদ্ধ নয়। উক্ত মন্ত্রগুলি তৎ তৎ অধিষ্ঠাত্রী দেবতা কথা জানিয়ে দেয়। তাই সেই অংশে অনধিগতার্থবোধকরূপে প্রমাণের দ্বিতীয় লক্ষণটি সংগত হয়।
মূল্যায়ন :-
এইভাবে সমগ্র মন্ত্র ভাগের প্রমাণত্ব অথবা প্রামাণ্য সিদ্ধ হয়। আর মন্ত্রের যে পরানপেক্ষ স্বার্থে স্বতঃপ্রামাণ্য মীমাংসক ও বৈদান্তিকগণের বিবক্ষিত, তা বেদের লক্ষণ ও প্রমাণ সমীক্ষা প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। সুতরাং বেদগত মন্ত্রভাগের প্রামাণ্য সিদ্ধ হওয়ায় বেদের মন্ত্র ভাগ যে অবশ্য ব্যাখ্যেয় তা প্রতিপন্ন হয়।
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদের অনুবন্ধ
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে প্রমার উপস্থাপন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন