সাংখ্য দর্শণ অনুসারে প্রমাণসমূহ সবিস্তারে আলোচনা করো।সাংখ্য মতে প্রমাণ কি? প্রমাণ কয় প্রকার ও কি কি? তাদের মধ্যে যেকোনো একটি উদাহরণ সহ সাংখ্যকারিকা অনুসারে আলোচনা করো।
সাংখ্য দর্শণ অনুসারে প্রমাণসমূহ
অথবা
সাংখ্য মতে প্রমাণ কি? প্রমাণ কয় প্রকার ও কি কি? তাদের মধ্যে যেকোনো একটি উদাহরণ সহ সাংখ্যকারিকা অনুসারে আলোচনা করো।
প্রমাণের সংজ্ঞা
প্রমাণ শব্দের নির্বচন থেকেই প্রমাণের অর্থকে ও প্রমাণের লক্ষণকে বোঝা যায়। প্রপূর্বক মা ধাতুর উত্তর করণবাচ্যে ল্যুট প্রত্যয়যোগে প্রমাণ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। যার দ্বারা পদার্থ প্রমিত হয় বা যথার্থরূপে জ্ঞাত হয়, তাকেই প্রমাণ বলে। প্রমাণ শব্দের নির্বাচনই বুঝিয়ে দেয়, প্রমাকরণত্বই প্রমাণের লক্ষণ। সুতরাং প্রমা জ্ঞান বা যথার্থ অনুভবের যেটা প্রকৃষ্ট সাধণ বা উপায় সেটিই হবে প্রমাণ।
সাংখ্য যোগী দার্শনিকরা ইন্দ্রিয়াদিজন্য অন্তঃকরণ বৃত্তিকেই প্রমাণ বলেছেন। আর সেই অন্তঃকরণবৃত্তিতে চৈতন্য স্ফুরিত হলে বিষয়ের যে যথার্থ জ্ঞান হয় তাকে প্রমা বলেছেন। এইরূপ প্রমার অসাধারণ কারণত্ব অন্তঃকরণবৃত্তিতে থাকায় অন্তঃকরণ বৃত্তিই সাংখ্যমতে প্রমাণ। বাচস্পতিমিশ্র তাই প্রমাণের নির্দোষ লক্ষণ প্রদর্শন করেছেন-“অসন্দিগ্ধ বিপরীতানধিগতবিষয়া চিত্তবৃত্তিঃ’ – যেটি সন্দেহ এর বিষয় নয়, ভ্রমের বিষয় নয় এবং যেটির পূর্বে কোনো ভাবে জ্ঞান হয়নি এরূপ বিষয়ের আকারে চিত্তের যে বৃত্তি বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ঘটপটাদি বিষয়াকারে চিত্তের যে পরিণাম, তাকেই সাংখ্যাচার্যগণ প্রমান বলেছেন।
প্রমাণের প্রকারভেদ
সাংখ্য দর্শনবিদগণের মতে, প্রমাণ তিনটি প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ। প্রমাণের সংখ্যা বিষয়ে দার্শনিকগণের মধ্যে পরস্পর এরূপ বিরোধ থাকলেও সাংখ্যাচার্যরা তিনটি প্রমাণেই স্বীকার করেছেন। তিনটির কমও নয়, বেশিও নয়- ‘ত্রিবিধং প্রমাণম্’। এরূপ বিশেষ উক্তির দ্বারা সাংখ্যকারিকার এ কথাই ব্যক্ত করেছেন।’ন ন্দ্যনং নাপ্যধিকমিত্যর্থঃ’ (তত্ত্বকৌমুদী)। আর সাংখ্য অনুমত এই তিনটি প্রমাণের মধ্যেই অন্য প্রমাণগুলি যে অন্তর্ভাবিত তা ঈশ্বরকৃষ্ণ কারিকায় স্পষ্ট করে বলেছেন – ‘সর্বপ্রমাণসিদ্ধত্বাৎ’। প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম- এই তিনটি প্রমাণ। এই তিনটি প্রমাণের লক্ষণ নিরূপণ প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকাকার বলেছেন –
” প্রতিবিষয়াধ্যবসায়ো দৃষ্টং ত্রিবিধমনুমানমাখ্যাতম্।
তল্লিঙ্গলিঙ্গিপূর্বকম্ আপ্তশ্রুতিরাপ্তবচনন্তু।।”
প্রমাণসমূহ :-
প্রত্যক্ষ প্রমাণের সংজ্ঞা:- প্রতি শব্দের সঙ্গে ইন্দ্রয়বাচী অক্ষ শব্দের সমাসে প্রত্যক্ষ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়। অতএব বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ বিশিষ্ট ইন্দ্রিয়ই প্রত্যক্ষ শব্দের অর্থ। বিষয়েন্দ্রিয় সম্বন্ধরূপ ব্যাপার বিশিষ্ট হওয়ায় ‘ব্যাপারবৎ কারনং করণম্’ – করণের এই লক্ষণ অনুসারে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ই প্রত্যক্ষপ্রমার প্রতি করণ হয় বলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ রূপে বিবেচিত হয়। কিন্তু সাংখ্যদার্শনিকগণ – এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন।
এখানে ‘প্রতিবিষয়াধ্যবসায়ো দৃষ্টম্’ এটি ঈশ্বর কৃষ্ণের অভিপ্রেত প্রত্যক্ষের বিশেষ লক্ষণ। এখানে প্রতিবিষয় শব্দের দ্বারা ইন্দ্রিয়কে বোঝানো হয়েছে।
‘বিষয়ং বিষয়ং প্রতিবর্ত্ততে ইতি প্রতিবিষয়মিন্দ্রিয়ম্”।
প্রত্যেক বিষয়ের সঙ্গে নিয়ত বর্তমান চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ই প্রতি বিষয়। আর সেই ইন্দ্রিয়জন্য যে অধ্যবসায় অর্থাৎ নিশ্চয়জ্ঞান বা নিশ্চয়াত্মক চিত্তবৃত্তি সেটাই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আর এই প্রমাণের ফল পুরুষনিষ্ট বোধই হল প্রত্যক্ষপ্রমা।
অনুমান প্রমাণ ও তার প্রকারভেদ
অনুমানের লক্ষণ প্রসঙ্গে ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেছেন-
‘তল্লিঙ্গলিঙ্গিপূর্বকম্’।
এখানে ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ ব্যাপ্য হেতু। আর লিঙ্গি শব্দের অর্থ ব্যাপক সাধ্য। ‘লিঙ্গলিঙ্গিপূর্বক’ শব্দের দ্বারা হেতু ও সাধ্যের সহচাররূপ ব্যাপ্তিজ্ঞান বোধিত হয়েছে।
আরো লক্ষনীয় যে, এখানে উক্ত ‘লিঙ্গলিঙ্গি ‘ শব্দে অনুমতির অব্যভিচারী অব্যবহিত কারণ পরামর্শজ্ঞানকেও বুঝিয়েছে। সেখানে লিঙ্গী শব্দের অর্থ পক্ষ, সাধ্য নয়।
‘লিঙ্গমস্তি অস্মিন্’ –
এই বিগ্রহে যে অধিকরণে লিঙ্গ বা হেতু বিদ্যমান, সেই অধিকরণ অর্থাৎ সন্দিগ্ধসাধ্যবান্ পক্ষই লিঙ্গী শব্দের অভিপ্রেত অর্থ। অভিপ্রায় এই, অনুমিতির ক্ষেত্রে সাধ্য হেতুর ব্যাপ্তি জ্ঞান যেমন উপযোগী, তেমনই সাধ্য ব্যাপ্য হেতুর পক্ষবৃত্তিত্ব নিশ্চয়রূপ পরামর্শজ্ঞানও উপযোগী। এবং ‘লিঙ্গ লিঙ্গি’ শব্দে এখানে লিঙ্গের অর্থাৎ হেতুর লিঙ্গী অর্থাৎ পক্ষবৃত্তিত্ব জ্ঞানরূপ সেই পরামর্শকে বুঝিয়েছে। সুতরাং, ব্যাপ্তি জ্ঞান ও পরামর্শ জ্ঞান জন্য অসন্দিগ্ধ অনধিগত বস্তুবিষয়ক চিত্তবৃত্তি সাংখ্যাচার্য্য ঈশ্বরকৃষ্ণের বক্তব্য।
অনুমান প্রমাণ প্রথমত দ্বিবিধ।
- ১) বীত
- ২) অবীত।
বীত অনুমান আবার দ্বিবিধ –
- ১) পূর্ববৎ
- ২) সামান্যতোদৃষ্ট,
আর অবীত অনুমান একপ্রকার –
- ১) শেষবৎ।
সুতরাং, অনুমান বস্তুত তিনপ্রকার –
- ১) পূর্ববৎ,
- ২) শেষবৎ
- ৩) সামান্যতোদৃষ্ট।
সেজন্য স্বয়ং ঈশ্বরকৃষ্ণ সাংখ্যকারিকায় বলেছেন- ‘ ত্রিবিধমনুমানমাখ্যাতম্।’
আগম বা শব্দ প্রমাণ ও প্রকারভেদ :-
‘আপ্তশ্রুতিরাপ্তবচনন্তু’ – এটি সাংখ্যকারিকাকারকৃত আগম বা শব্দ প্রমাণের বিশেষ লক্ষণ। এখানে আপ্তবচন শব্দের দ্বারা আগমপ্রমাণরূপ লক্ষ্যকে নির্দেশ করা হয়েছে। ব্রহ্মা, নারদ, সনৎকুমার প্রভৃতি আচার্যের উপদেশ ও বেদের উপদেশকে মুখ্যত আপ্তবচন বলে।
ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও ইন্দ্রিয় বৈকল্পরূপ দোষচতুষ্টয়রহিত ব্যক্তিকেই আপ্ত বলা হয়। রাগদ্বেষাদিযুক্ত ব্যক্তিই মিথ্যা কথা বলেন। কিন্তু রাগদ্বেষাদিবর্জিত ব্যক্তি মিথ্যা বলেন না। তাই তাঁর বচন আগম প্রমাণরূপে বিবেচিত হয়। বাচস্পতি মতে আপ্ত প্রাপ্ত বা যুক্ত যে শ্রুতি বা শব্দ সেটাই আগম প্রমাণ। অতএব এইরূপ আপ্ত যথার্থ যে শ্রুতি বা আপ্ত ব্যাক্তির যে শ্রুতি শব্দ বা শব্দাত্মক বাক্যজন্য যে বাক্যার্থ জ্ঞান অথবা বাক্যার্থবিষয়ক যে নিশ্চিতা চিত্তবৃত্তি তাকেই সাংখ্যচার্যগন আগম প্রমাণ বলেন। আগম প্রমাণ দ্বিবিধ- বৈদিক ও লৌকিক।
সাংখ্যকারিকা হতে অন্যান্য প্রশ্ন উত্তর
- তার্কিক সম্মত অসৎকার্যবাদ খন্ডন করে সৎকার্যবাদ সাংখ্যকারিকা অনুসারে ব্যাখ্যা
- গুণের লক্ষণ স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্যসমূহ
- পুরুষের বহুত্বসাধক প্রমাণসমূহ ঈশ্বর কৃষ্ণের মতানুসারে আলোচনা
- সাংখ্য দর্শনের স্রষ্ঠা কে? সাংখ্য শাস্ত্রীয় পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব সমূহের প্রকারভেদ
- ব্যক্ত ও অব্যক্তের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য সাংখ্য রীতিতে ব্যাখ্যা
- প্রত্যক্ষ প্রমাণ কি? প্রত্যক্ষের বাধক গুলি কি কি?
- সাংখ্যকারিকা: কারিকা ব্যাখ্যা