সাংখ‍্যকারিকা: গুণের লক্ষণ স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্যসমূহ

সাংখ্যকরিক অনুসারে গুণের লক্ষণ স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্যসমূহ ঈশ্বর কৃষ্ণের মতানুসারে নিরূপণ করো।

গুণের লক্ষণ স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্যসমূহ


গুণের লক্ষণ স্বরূপ

সাংখ‍্যশাস্ত্রে পুরুষকে নির্গুণ বলা হয়েছে। আর পুরুষ ব্যতিরিক্ত মহৎ প্রভৃতি যেসকল ব্যক্ত ও অব্যক্ত কার্য বস্তু রয়েছে, তারা তাহলে কী? বস্তুত এগুলি সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুনের সমাহার। তাই এগুলিকে ত্রিগুণ বলা হয়েছে।

এখন জিজ্ঞাসা হতে পারে এই তিনটি গুণ কি রকমের?তাদের স্বরূপ ও লক্ষণ কি? তাদের প্রয়োজন ও কার্যই বা কি?

এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঈশ্বর কৃষ্ণ দ্বাদশ কারিকায় বলেছেন-


“প্রীত‍্যপ্রীতিবিষাদাত্মকাঃ প্রকাশপ্রবৃত্তিনিয়মার্থাঃ।
অন‍্যোন‍্যাভিভবাশ্রয়জননমিথুনবৃত্তয়শ্চ গুণাঃ।।”


‘কে তে গুনাঃ’- এই প্রশ্নের দ্বারা প্রথমত গুণের স্বরূপ জানতে চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শাস্ত্রে গুন শব্দের বিভিন্ন স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন- আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বস্তুর শক্তিকে গুণ বলা হয়েছে।

ব্যাকরণে অ,এ,ও-কে পারিভাষিকরূপে গুণ বলা হয়। বৈশেষিকগণ দ্রব্যাশ্রিত সংযোগ প্রভৃতি পদার্থবিশেষকে গুন বলেছেন। কিন্তু সাংখ‍্যশাস্ত্রে সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুনরূপে স্বীকৃত হয়েছে। এগুলোকে কেন গুন বলা হয়েছে, তা বোঝাতে বাচস্পতি মিশ্র বলেছেন-“গুনাঃ পরার্থাঃ”। পরার্থতার জন্যই সত্ত্বাদির গুন সংজ্ঞা হয়েছে। এখানে পর শব্দের দ্বারা পুরুষকে বোঝানো হয়েছে। একই পদার্থের সত্ত্বাদি গুনত্রয় বিদ্যমান হওয়ায় পুরুষের অদৃষ্ট বশতঃ একই পদার্থ থেকে এক এক পুরুষের সুখ-দুঃখ ও মোহ উদ্ভূত হয়।


গুণের লক্ষণ স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে ঈশ্বর কৃষ্ণ বলেছেন –

“প্রীত‍্যপ্রীতিবিষাদাত্মকাঃ”। এখানে প্রীতি শব্দে সুখকে অপ্রীতি শব্দে দুঃখকে এবং বিষাদ শব্দের মোহকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রীতি, অপ্রীতি ও বিষাদ পরস্পর বিরুদ্ধ বলে এটি গুণের লক্ষণ হতে পারে না।

তাই ঈশ্বরকৃষ্ণ পরবর্তী কারিকায় সত্ত্বাদি গুনকে প্রথমে সত্ত্বঃ, তারপর রজঃ এবং সর্বশেষে তমঃ- এইরূপ ক্রমানুসারে উল্লেখ করেছেন। গুনত্রয়ের এরূপ ক্রমস্বীকারের মাধ্যমে গুণের বিশেষ লক্ষণকে বুঝতে হবে। যেমন – সত্ত্বগুনের লক্ষণ হবে প্রীত‍্যাত্মকত্ব। রজোগুণের লক্ষণ হবে অপ্রীত‍্যাত্মকত্ব এবং তমের লক্ষণ হবে বিষাদাত্মকত্ব। এর ফলে সুখ,দুঃখ ও মোহ যথাক্রমে সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ গুণের ধর্ম হবে। সুতরাং পরমতকে নিষেধ করার জন্যই এখানে আত্ম শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে।

গুনত্রয়ের প্রয়োজন :-

গুনত্রয়ের স্বরূপ বলার পর ঈশ্বরকৃষ্ণ “প্রকাশপ্রবৃত্তিনিয়মার্থাঃ”- এই বাক্যের দ্বারা গুণত্রয়ের প্রয়োজন উক্ত করেছেন। এখানে প্রযুক্ত অর্থ শব্দের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও নিয়ম- সত্ত্বাদি গুনত্রয়ের প্রয়োজন। গুনের স্বরূপ ব্যাখ্যায় যেমন ক্রমানুসারে সত্ত্বাদি গুনত্রয়কে গ্রহন করা হয়েছিল, এখানেও তেমনি ক্রমানুসারেই সত্ত্বাদি গুনত্রয়কে গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং সত্ত্বগুণের প্রয়োজন হবে প্রকাশ, রজঃ গুনের প্রয়োজন হবে প্রবৃত্তি ও তমঃ গুনের প্রয়োজন হবে নিয়মন। প্রকাশ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’, ‘প্রবৃত্তি’ শব্দের অর্থ প্রযত্ন ও নিয়মন শব্দের অর্থ নিয়ামক। সুতরাং, সত্ত্বগুন প্রকাশক, রজঃ গুণ প্রবর্তক ও তমঃ গুণ নিয়ামক হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সত্ত্বগুণের ধর্ম লঘুতা, রজোগুণের ধর্ম অস্থিরতা বা চাঞ্চল‍্য এবং তমঃ গুণের ধর্ম গুরুতা।

একথা স্বয়ং ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেছেন –


“সত্ত্বং লঘু প্রকাশকমিষ্টমুপষ্টম্ভকং চলঞ্চ রজঃ।
গুরু বরনকমেব তমঃ……..।।”

সত্ত্বগুন লঘু হয় বলে সত্ত্বগুণের প্রভাবে অগ্নি প্রভৃতির ঊর্ধ্ব গমন এবং বায়ু প্রভৃতির তির্যকগমন সম্ভব হয়। সত্ত্বগুণের সম্পর্ক ব্যতীত বুদ্ধিতে পুরুষ প্রতিবিম্ব হতে পারে না। এইজন্য সত্ত্বগুনকে প্রকাশধর্মী বলা হয়। সত্ত্বগুনের ফলে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় অল্প সময়ে গ্রহণে সমর্থ হয়। এটিই লঘুতার ফল। সত্ত্বগুন লঘু ও প্রকাশময় হলেও স্বয়ং ক্রিয়াহীন। কিন্তু রজোগুণ স্বয়ং ক্রিয়াশীল এবং প্রবর্তক। রজোগুণের সঙ্গে সত্ত্বগুণের মিলনের ফলে রজোগুনের প্রভাবেই সত্ত্বগুনের কার্য তৎপরতা প্রকাশ পায়।

গুণত্রয়ের কার্যসমূহ :-

গুনত্রয়ের প্রয়োজন বলার পর ঈশ্বরকৃষ্ণ ‘ অন‍্যোন‍্যাভিভবাশ্রয়জননমিথুনবৃত্তয়শ্চ” – এই শব্দের দ্বারা গুণত্রয়ের কার্যাবলী উল্লেখ করেছেন। এখানে বৃত্তি শব্দ ক্রিয়ার বোধক। অন্যান্যাভিভব, অন্যোন্যাশ্রয়, অন্যোন্যজনন ও অন‍্যোন্যামিথুন- এই চারটি হল গুণত্রয়ের বৃত্তি বা কার্য।


‘অন‍্যোন্যাভিভব’ বৃত্তি হল জীবের অদৃষ্ট বশত তিনটি গুণের মধ্যে একটি অন্য দুটি গুণকে অভিভূত করে। যেমন – সত্ত্বগুণ, রজঃ ও তমঃগুণকে অভিভূত করে নিজের দুঃখবৃত্তিকে উৎপাদন করে এবং তমঃগুন সত্ত্বঃ ও রজঃ গুনকে অভিভূত করে নিজের মূঢ় বৃত্তিকে নিষ্পাদন করে, এথেকেই বিচিত্রভেদ বিশিষ্ট জগতের উৎপত্তি হয়।

অন‍্যোন‍্যাশ্রয়বৃত্তি-

হল গুনত্রয় পরস্পরকে অপেক্ষা করে। যেমন- সত্ত্বগুণ প্রবৃত্তি ও নিয়মকে অপেক্ষা করে নিজের প্রকাশরূপ কার্যে ব‍্যাপৃত থাকে। এরূপ রজঃগুন প্রকাশ ও নিয়মকে অপেক্ষা করে প্রবৃত্তিরূপ কার্যে নিযুক্ত হয়। আর তমঃগুন প্রকাশ ও প্রবৃত্তিকে অপেক্ষা করে নিয়মরূপ কার্যে প্রবৃত্তি হয়।

‘অন‍্যোন‍্যজননবৃত্তি’ হল গুনত্রয় পরস্পর সাপেক্ষভাবে কাজ করে। অর্থাৎ, তারা এককভাবে কোনো কার্য সম্পাদন করতে পারেনা।

‘অন‍্যোন‍্যমিথুনবৃত্তি’ হল গুনত্রয়ের নিয়ম সহচরবৃত্তি। সুতরাং, এই তিনটি গুন সর্বদায় সম্মিলিত হয়ে নিজ নিজ কার্য সাধন কে।

এইভাবে উক্ত কারিকার দ্বারা ঈশ্বরকৃষ্ণ গুনত্রয়ের স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্যাবলী উল্লেখ করেছেন।

সাংখ‍্যকারিকা হতে অন্যান্য প্রশ্ন উত্তর

Comments