সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা অনুসারে আলোচনা কর।
সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন, তা আলোচনা কর- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা
ভূমিকা:- আচার্য সায়ণ ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব- এই চারটি বেদের মধ্যে ঋকবেদ – এ প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও যজুর্বেদের ভাষ্যকে আগে রচনা করেছেন, তারপর ঋগ্বেদের ভাষ্য রচনা করেছেন। কিন্তু বিচার্য্য এই, আগে তিনি ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা না করে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন কেন? ঋগ্বেদভাষ্যভূমিকার প্রারম্ভে ঊহাপোহবিচার করে স্বয়ং তিনিই উক্ত প্রশ্নের উত্তর দান করেছেন। অবশ্য উত্তরদানের পদ্ধতিটি আধুনিক দৃষ্টিতে অভিনব। যজুর্বেদের ব্যাখ্যা প্রথমে না করে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যাই প্রথমে করণীয় এরকম বিসংবাদী পক্ষকে তিনি প্রথমে সযুক্তিক উপন্যাস করেছেন।
বিরুদ্ধবাদীদের বক্তব্য:-
বেদে এবং উপনিষদ -এ সর্বত্র ঋকবেদের প্রাথম্য উল্লিখিত হয়েছে।
যেমন – পুরুষসূক্তে শ্রুত হয়েছে-
” তস্মাদ্ যজ্ঞাৎ সর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাৎসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্ যজুস্তস্মাদজায়ত।।(ঋগ্বেদ-১০/৯০/৯)
অর্থ ইন্দ্রাদি সর্ববেদপূজিত ও উপাসনীয় সেই পরমেশ্বর হতে ঋগ্বেদ ও সামবেদ উদ্ভূত হয়েছিল এবং তার থেকে ছন্দ ও যজুর্বেদ সম্ভূত হয়েছিল। ঋগ্বেদের প্রাথম্য বহু উপনিষদেও আম্নাত হয়েছে-
“ ঋগ্বেদং ভগবোঅধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমাথর্বণং চতুর্থম্। ( ছান্দোগ্যোপনিষৎ ৭/১/২)
ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঅথর্ববেদঃ।।” ( মুণ্ডকোপনিষৎ ১/১/৫)
এইভাবে সর্বত্র ঋগ্বেদই যেহেতু প্রথমে উক্ত হয়েছে, সেইহেতু ‘অভ্যহির্তং পূর্বম্‘ এই ন্যায়ানুসারে শ্রেষ্ঠই প্রথমে উল্লেখযোগ্য হয় বলে বেদচতুষ্টয়ের মধ্যে ঋগ্বেদেরই সর্বশেষ্ঠতা সূচিত হয়েছে। সুতরাং ঋগ্বেদেরই প্রাথম্য ও প্রাধান্য সুস্থিত হওয়ায় ঋগ্বেদের ব্যাখ্যাই প্রথমে করণীয় বলে আশঙ্কা হয়।
আরো অনুসন্ধেয় এই সর্বত্র ঋগ্বেদের প্রাথম্য কীর্ত্তিত হয় বলেই যে ঋগ্বেদের প্রাধান্য তাই নয়। যজ্ঞের অঙ্গকে দৃঢ় করার মতো ক্ষমতা আছে বলেও সমস্ত বেদের মধ্যে ঋগ্বেদেরই শ্রেষ্ঠতা উদগীত হয়।তাছাড়া সাম, যজুঃ ও অথর্ব প্রত্যেক বেদই ঋগ্বেদকে সমাদর করেছেন।
ঋগ্বেদের এই অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্যের জন্য চতুর্বেদের মধ্যে ঋগ্বেদের সর্বশ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ায় সর্বাগ্রে ঋগ্বেদকে ব্যাখ্যা করাই সমীচীন হবে, এইরূপ বিপক্ষীয় আশঙ্কা ঋগ্বেদের ভাষ্য রচনার প্রারম্ভে স্বয়ং আচার্য সায়ণই উত্থাপন করেছেন।
উত্তরপক্ষে বক্তব্য:-
উক্তরূপ আশঙ্কা করে আচার্য সায়ণ যেভাবে তার সমাধান প্রদর্শন করেছেন তা নিম্নরূপঃ –
একথা অনস্বীকার্য যে বেদের অধ্যয়ন, পরায়ন ও ব্রহ্মযজ্ঞজপাদিতে ঋগ্বেদের অনন্য ভূমিকা ও অসামান্য উপযোগিতা উপলব্ধ হওয়ায় বৈদিক সম্প্রদায়ে ঋগ্বেদের প্রাথম্য ও প্রাধান্য উদাত্ত কন্ঠে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রের অর্থজ্ঞান ও যজ্ঞের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে যজুর্বেদ সংহিতার ও যজুর্বেদবিৎ ঋত্বিকের সর্বাতিশয়ী প্রাধান্য শ্রুতিসমর্থিত হওয়ায় যজুর্বেদেরই ব্যাখ্যা সর্বাজ্ঞে করণীয়।
যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতা ও বাজসনেয়ী সংহিতায় যজ্ঞতত্ত্ব বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। ঋগ্বেদভাষ্যভূমিকায় সায়নের প্রবচন এই- ‘অর্থজ্ঞানস্য তু যজ্ঞানুষ্ঠানার্থত্বাৎ’। অর্থাৎ যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্যই যখন মন্ত্রের অর্থজ্ঞান বা যজ্ঞানুষ্ঠানেই যখন মন্ত্রের সার্থকতা আর যজ্ঞবিষয়ে যখন যজুর্বেদেরই পাধান্য, তখন যজুর্বেদই প্রথমে ব্যাখ্যেয়।
যজ্ঞানুষ্ঠানে অধ্বর্য্যু ও যজুর্বেদের প্রাধান্যকে স্বয়ং ঋগ্বেদই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন-
” ঋচাং ত্বঃ পোষমাস্তে পুপুস্বান্
গায়ত্রং ত্বো গায়তি শক্বরীষু।
ব্রহ্মা ত্বো বদতি জ্ঞাতবিদ্যাং
যজ্ঞস্য মাত্রাং বিমিথীত উত্বঃ।।” (ঋগ্বেদ ১০/৭২/১১)
এখানে ঋত্বিক চতুষ্টয়ের করণীয় বিধৃত হয়েছে। হোতা বিভিন্ন স্থানে পঠিত ঋক্ মন্ত্রগুলিকে একত্র সংকলন করে শাস্ত্র পাঠ পূর্বক ঋগ্বেদান্তর্গত মন্ত্রসমূহের পুষ্টি বিধান করেন। উদগাতা শক্বরী প্রভৃতি ঋক্ সমূহের সুর সংযোজন করে স্তোত্র গান করেন। বেদত্রয়ে নিষ্ণাত ব্রহ্মা যাজ্ঞিককে প্রণয়াদি কর্মে অনুজ্ঞা দান করেন এবং কারো কোনো অপরাধ হলে যথোচিত প্রতিকার করেন। আর অধ্বর্য্যু যজ্ঞের মাত্রা ও স্বরূপকে বিশেষভাবে নিষ্পাদন করেন।
অধ্বর্য্যু যজ্ঞানুষ্ঠানকে সাঙ্গ করেন, পরিপূর্ণ করেন। তিনি যজ্ঞের ফল – প্রাপয়িতা, তাঁর পর্যবেক্ষণে যজ্ঞ সমাপ্ত হয়, সফল হয়। তাই তাকে যজ্ঞের নেতা বলা হয়।
অধ্বর্য্যু যজুঃ শব্দের নির্বচন প্রসঙ্গে যাস্ক বলেছেন – যজুতের্যজুঃ। অর্থাৎ যাগ- নিষ্পাদনের হেতু হয় বলে যজুঃ নামটি প্রথিত হয়েছে। সুতরাং যজুর্বেদই যজ্ঞদেহকে যজ্ঞের নির্মাণ করেন। সুতরাং যজুর্বেদ যজ্ঞের ভিত্তিস্থানীয়, আর ঋগ্বেদ ও সামবেদ চিত্রস্থানীয়। যজুর্বেদকে উপজীব্য করে ঋগ্বেদ ও সামবেদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বলে ঋগ্বেদ ও সামবেদ যজুর্বেদের অাশ্রিত।
সিদ্ধান্ত
সুতরাং যজ্ঞক্রিয়ার অনুষ্ঠানে ঋগ্বেদ ও সামবেদের মূল বা আশ্রয়স্থান যজুর্বেদের সমধিক প্রাধান্য থাকায় সায়ণাচার্য বেদার্থ নির্ণয়ে উদ্যত হয়ে প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যাকে প্রনয়ণ করেছেন।
অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন সায়ণাচার্য তৈত্তিরীয় শাখ্যাধ্যায়ী বা কৃষ্ণযজুর্বেদীয় ছিলেন বলে তিনি প্রথমে কৃষ্ণ যজুর্বেদের ভাষ্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়ে সায়ণাচার্যের নিজের উক্তি থেকে আমরা নিঃসন্দিহান হতে পারি যে, যজ্ঞে যজুঃসংহিতার ও অধ্বর্যুর প্রাধান্যই যজুর্বেদ ভাষ্য রচনার প্রাথম্যের প্রতি কারণ। ঋগ্বেদভাষ্যভূমিকার প্রারম্ভে তিনি বলেছেন-
” আধ্বর্য্যবস্য যজ্ঞেষু প্রাধান্যাদ্ ব্যাকৃতং পুরা।
যজুর্বেদোঅথ হৌত্রার্থমৃগ্বেদো ব্যাকরিষ্যতে।।”
অন্যত্রও তিনি বলেছেন-
” যজ্ঞং যজুর্ভিরধ্বর্য্যুনির্মিমীতে ততো যজুঃ।
ব্যাখ্যাতং প্রথমং পশ্চাদৃচাং ব্যাখ্যানমীরিতম্।।“
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: আরো পড়ুন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদের অনুবন্ধ
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে প্রমার উপস্থাপন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন