ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা অনুসারে বেদের অনুবন্ধগুলি কী কী? প্রত্যেকটি অনুবন্ধের ব্যাখ্যা কর।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা অনুসারে বেদের অনুবন্ধগুলি কী কী? প্রত্যেকটি অনুবন্ধের ব্যাখ্যা কর।
বেদের অনুবন্ধগুলি কী কী?
বিষয়, প্রয়োজন, অধিকারী ও সম্বন্ধ
ভূমিকা:- শাস্ত্রে প্রবৃত্তির জন্য বিষয়, প্রয়োজন, অধিকারী ও সম্বন্ধ-এই চারটি অনুবন্ধের জ্ঞান আবশ্যক। সাধারণভাবে সায়ণাচার্যকৃত বেদব্যাখ্যার বিষয় হয়েছে বেদ। বেদের অর্থজ্ঞানই প্রয়োজন। ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যেয়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কই সম্বন্ধ এবং জ্ঞানার্থী অধিকারী। তথাপি বিশেষভাবে বেদের বিষয়প্রয়োজনাদির উল্লেখ প্রয়োজন। অন্যথা বেদব্যাখ্যার বিষয়াদির উত্তমতা স্থির হয় না। সেইজন্য বেদের বিষয় কি, বিষয় জানার প্রয়োজন কি, বিষয় ও প্রয়োজনের মধ্যে সম্বন্ধ কি রূপ এবং বেদাধ্যয়নের অধিকারী কে এই বিষয়গুলি সায়ণাচার্য নিরূপণ করেছেন।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা অনুসারে প্রত্যেকটি অনুবন্ধের ব্যাখ্যা
বেদের বিষয়:-
বেদের বিষয়ে প্রয়োজনাদি অনুবন্ধ চতুষ্টয়ের নিরূপণ-
“বিষয়প্রয়োজনসম্বন্ধাধিকারিজ্ঞানমন্তরেণ শ্রোতৃপ্রবৃত্ত্যভাবাদ্-বিষয়দয়ো নিরূপ্যন্তে।”
বিষয়, প্রয়োজন, সম্বন্ধ এবং অধিকারী এগুলি হল অনুবন্ধ চতুষ্টয়। এই অনুবন্ধ চতুষ্টয়ের জ্ঞান ছাড়া শ্রোতৃবর্গের প্রবৃত্তি হয় না একারণ বিষয়াদির নিরূপণ করা হয়েছে। ব্যাখ্যার যাহা ব্যাখ্যেয় বেদ, তাই এখানে বিষয় – ” ব্যাখ্যানস্য ব্যাখ্যেয় বেদো বিষয়ঃ”। বেদের অর্থ জ্ঞানের প্রয়োজন। ব্যাখ্যানব্যাখ্যেয় ভাবই সম্বন্ধ। বেদার্থজ্ঞান প্রার্থনাকারীই অধিকারী। যদিও এইগুলি প্রসিদ্ধ অতএব, এইগুলিকে পৃথকভাবে নিরূপণের কোনো প্রয়োজন নেই অতএব বেদে যদি এইগুলিকে নিরূপণ করা না হয় তাহলে ব্যাখ্যার কি বিষয় হবে? স্থির কোনো কিছু বিষয় থাকবে না। এ কারণ অনুবন্ধ চতুষ্পদ নিরূপিত হবে। বেদের পূর্বকাণ্ডে (কর্মকাণ্ডে ) চতুষ্টয় নিরূপিত হবে। বেদের পূর্বকাণ্ডে( কর্মকাণ্ডে ) ধর্মই বিষয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ ধর্মই বৈদিক পূর্বকাণ্ডে প্রতিপাদ্য হয়েছে এবং উত্তর কান্ডের (জ্ঞানকান্ডের) প্রতিপাদ্য বিষয় হয়।
বেদের প্রয়োজন:-
ধর্মজ্ঞান এবং ব্রহ্মজ্ঞান এই উভয়জ্ঞানই প্রয়োজন-
” তদুভয়জ্ঞানম্ বেদস্য সাক্ষাৎপ্রয়োজনম্।”
সেই ধর্ম জ্ঞান ও ব্রহ্মজ্ঞান সপ্তদ্বীপবিশিষ্ট পৃথিবী ঐ রাজা যাচ্ছেন ইত্যাদি জ্ঞানের ন্যায় পুরুষার্থের সাধন হয় না এই শঙ্কা করা উচিত নয়। কারণ ধর্ম প্রযুক্ত পুরুষার্থ প্রশংসিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ ধর্মানুষ্ঠানের দ্বারা পুরুষার্থ লাভ হয় এবং তার প্রশংসা করা হয়ে থাকে। ধর্মেই সমগ্র জগতের প্রতিষ্ঠা, এই সংসারে ধার্মিকের নিকট প্রজাগণ অগ্রসর হয়ে থাকে।
ধর্মের দ্বারাই পাপ বিনষ্ট হয়। ধর্মেই সবকিছু প্রতিষ্ঠিত আছে। সেইহেতু ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি শ্রেষ্ঠ বস্তু (ব্রহ্মকে ) লাভ করেন। ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রহ্মই হয়ে থাকেন। আত্মবিৎ (ব্রহ্মবিৎ) শোক হতে উত্তীর্ণ হন। ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যে ব্রহ্মজ্ঞান হতে মোক্ষরূপ পুরুষার্থ সিদ্ধ হয়ে থাকে-এইরূপ বলা হয়েছে।
বেদের অধিকারী:-
তিনি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যজাতীয় পুরুষ-
“তদুভয়জ্ঞানার্থী বেদেঅধিকারী। স চ ত্রৈবর্ণিকঃ পুরুষঃ।”
স্ত্রী এবং শূদ্রের যদিও জ্ঞানাপেক্ষা আছে কিন্তু উপনয়নাভাবে তাদের বেদে অধিকার নিষিদ্ধ হয়েছে। স্ত্রী শূদ্রের উপনয়ন সংস্কার হয় না বলে এনারা বেদে অনধিকারী হয়ে থাকেন। তাঁদের ধর্মও ব্রহ্মজ্ঞান পুরাণাদি পাঠের দ্বারা উৎপন্ন হয়। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এই বর্ণত্রয়ের পুরুষকে ত্রৈবর্ণিক বলা হয়। এই ত্রৈবর্ণিক পুরুষগণের বেদ হতে অর্থজ্ঞান অর্জনে অধিকার।
বেদের সম্বন্ধ:-
ধর্ম ও ব্রহ্মের সহিত বেদের প্রতিপাদ্যপ্রতিপাদকভাব সম্বন্ধ স্বীকৃত হয়।
“সম্বন্ধস্তু বেদস্য ধর্মব্রহ্মভ্যাং সহ, প্রতিপাদ্যপ্রতিপাদকভাবঃ, তদীয়জ্ঞানেন সহ জন্যজনকভাবঃ “
– বেদ, ধর্ম ও ব্রহ্মের জ্ঞান প্রদান করে বলে বেদ প্রতিপাদক হয়ে থাকে। ধর্ম ও ব্রহ্ম বেদের প্রতিপাদ্য হয়ে থাকে। একারণ বেদে প্রতিপাদকতা ও ধর্ম ও ব্রহ্মে প্রতিপাদকতা নামক সম্বন্ধ বিদ্যমান হয়ে থাকে। এইরূপ ধর্মজ্ঞান ও ব্রহ্মজ্ঞানের সহিত বেদ ও তাদৃশজ্ঞানের জনক ও জন্যভাব(জনকতা ও জন্যতা) সম্বন্ধ বিদ্যমান হয়। ত্রৈবর্ণিক পুরুষগণের সহিত বেদের উপকার্য উপকারকভাব হয়ে থাকেন অর্থাৎ বেদ উপকারক ও ত্রৈবর্ণিক পুরুষগণ উপকার্য্য হয়ে থাকেন। অতএব, উভয়ের সম্বন্ধ যথাক্রমে উপকারতা এবং উপকার্য্যতারূপ হয়ে থাকে।
মূল্যায়ণ:-
এইভাবে বিষয়াদি অনুবন্ধ চতুষ্টয়কে অবগত হয়ে দৃঢ়স্থিরবুদ্ধিতে শ্রোতৃগণ বেদব্যাখ্যা শ্রবণে প্রবৃত্ত হবে।
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদের অনুবন্ধ
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে প্রমার উপস্থাপন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন