পাণিনী ও অষ্টাধ্যায়ী সম্বন্ধে যা জানো লেখ।
মহর্ষি পাণিনী ও অষ্টাধ্যায়ী
ভূমিকা:- মহর্ষি পাণিনী শুধুমাত্র ত্রিমুনি ব্যাকরণের ক্ষেত্রেই নয় শুধুমাত্র পাণিনি সম্প্রদায়ের বৈয়াকরণগনের মধ্যেই নয়, সমগ্র সংস্কৃত ব্যাকরণ শাস্ত্রের জগতেও মধ্যমণি রূপে পরিগণিত হন। তাঁর অষ্টাধ্যায়ী নামক সূত্রপাঠ এবং ব্যাকরণ সম্পর্কিত অন্যান্য রচনাগুলিকে ঘিরে পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামী বৈয়াকরণগন যে ব্যাকরণ সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিলেন, সেই সম্প্রদায়ই পাণিনী-সম্প্রদায় নামে সংস্কৃত ব্যাকরণের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আজও একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে বিরাজ করছে।
পাণিনীর ব্যাকরণকে আজও বহু পন্ডিত ‘মানব মস্তিষ্কের বিষ্ময়’ বলে মনে করেন। বৈদিক এবং লৌকিক উভয় ভাষার জন্যই পাণিনী তাঁর অষ্টাধ্যায়ী তে সূত্র রচনা করেছেন। তাঁর ব্যাকরণকেই এখনো যথার্থ বেদাঙ্গ ব্যাকরণের মর্যাদা দেওয়া হয়।
মহাভাষ্যকার পতঞ্জলিও পাণিনীর সূত্র গুলিকে বেদমন্ত্রের সমমর্যাদা দান করেছেন-
” ছন্দোবৎ সূত্রানি ভবন্তি।”
পাণিনীর ব্যক্তিগত পরিচয়:-
পাণিনীর নামান্তর:-
পুরুষোত্তমদেব তাঁর ত্রিকান্তশেষ গ্রন্থে পাণিনীর পাঁচটি নাম উল্লেখ করেছেন – পাণিনী, দাক্ষীপুত্র, শালঙ্কি, শালাতুরীয় এবং আহ্নিক।
পাণিনির অবস্থান ও তাঁর পিতা মাতা:-
শালাতুর নামক গ্রামে তাঁর বাড়ি ছিল। এটি বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত।পণ্ডিত শিবদত্ত শর্মার মতে, পাণিনীর পিতার নাম ছিল শশাঙ্ক। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি পাণিনীকে বলেছেন দাক্ষীপুত্র -‘দাক্ষীপুত্রস্য পাণিন্যেঃ’। এ থেকে মনে করেন যে পাণিনীর পিতার নাম দাক্ষী এবং কারও কারও মতে তার মা দক্ষুকুলোৎপন্না ছিলেন।
পাণিনীর গুরু ও তাঁর প্রতিভা:-
কথাসরিৎসাগর প্রভৃতি গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে পাণিনীর গুরুর নাম ছিল বর্ষ। ছেলেবেলা থেকেই পাণিনী ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবন এবং বিশেষ যশের অধিকারী। কাশিকাবৃত্তিতে একটি উদাহরণ পাওয়া যায় এ বিষয়ে-“আকুমারং যশঃ পাণিনেঃ।”
পাণিনীর সময়কাল:-
মহর্ষি পাণিনীর সময়কাল নিয়েও নানা মুনির নানা মত রয়েছে।বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করে তাকে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দি থেকে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে রাখতে চেয়েছেন। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতই তাঁকে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের লোক বলেই মনে করেন।
পাণিনীর রচনাবলী:-
মহর্ষি পাণিনীর লেখা ব্যাকরণ বিষয়ক গ্রন্থটি হল- অষ্টাধ্যায়ী সূত্রপাঠ। তিনি সূত্রপাঠের সঙ্গে ধাতুপাঠ, গণপাঠ, ঊনাদিপাঠ, লিঙ্গানুশাসন প্রভৃতির উপদেশ করেছিলেন বলেও মনে করেন পণ্ডিতগণ। পাণিনীর নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রচলিত আছে-‘ জাম্ববতী বিজয়’ বা ‘পাতালবিজয়’।
অষ্টাধ্যায়ী
অষ্টাধ্যায়ীর গঠন:- অষ্টাধ্যায়ী হল সূত্রপাঠ, পঞ্চাঙ্গ ব্যাকরণের প্রধান অঙ্গ এটি। সংস্কৃত ভাষা ও বৈদিক ভাষা বিষয়ক প্রায় চারহাজার ব্যাকরন সূত্রের সমষ্টি হল এই অষ্টাধ্যায়ী। গ্রন্থের সূচনা থেকে ১৪ টি মহেশ্বর সূত্র বা শিব সূত্র আছে। স্বরসিদ্ধান্তচন্দ্রিকা নামকগ্রন্থের মতে, এই মাহেশ্বর সূত্রগুলি সহ অষ্টাধ্যায়ী-র মোট সূত্রসংখ্যা ৩৯৯৫। অন্যমতে সূত্র গুলি ৩৯৯৭ প্রভৃতিও দেখা যায়।
সূত্রের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে বলা হয় যে,
“অল্পাক্ষরমসন্দিগ্ধং সরবেৎ বিশ্বতো মুখম্।
অস্তোভমনবদ্যং চ সূত্রং সূত্রবিদো বিদুঃ।।”
সূত্রের এই সমস্ত লক্ষণগুলি অষ্টাধ্যায়ী-স্থ সূত্রগুলিতেও বর্তমান। আটটি অধ্যায়ে এবং ৩২ টি পাদ(৮×৪=৩২) বিভক্ত এই সূত্র পাঠের প্রথম সূত্রটি হল বুদ্ধিরাদৈচ্। সূত্রে উল্লেখিত বুদ্ধি শব্দটির দ্বারা পাণিনী মঙ্গলাচরণের কাজটি করেছেন বলেও মনে করা হয়। আর শেষ সূত্রটি হল অ অ।
অষ্টাধ্যায়ীর বৈশিষ্ট্য :-
পণ্ডিতরা এবং আধুনিক গবেষকগণ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে,
- ১) পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা নিয়ে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- ২) ১৪ টি মাহেশ্বর সূত্র অবলম্বনে যে প্রত্যাহার গুলি গঠিত হয়েছে, সেগুলির দ্বারা সূত্রের আকার অনেক সংক্ষিপ্ত হয়েছে। কারণ, প্রত্যাহারগুলির দ্বারা অতি সংক্ষেপে অনেক ধ্বনিকে বোঝানো হয়।
- ৩) সুবন্ত ও তিঙন্ত- এই দুই ভাগে তিনি পদকে বিভক্ত করে যথেষ্ট যুক্তি সংগতার পরিচয় দিয়েছেন।
- ৪) সংজ্ঞার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তিনি ‘টি’, ‘ ঘ’ প্রভৃতি লঘু সংজ্ঞা যেমন করেছেন, তেমনি কর্মপ্রবচনীয়াদি মহাসংজ্ঞারও ব্যবহার করেছেন, যেখানে যেমন প্রয়োজন তেমন সংজ্ঞাই করেছেন।
- ৫) সূত্রের মধ্যে প্রাচ্যম্, উদীচাম্ প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগের দ্বারা ভাষার মধ্যে উপভাষাগত ভেদ দেখিয়েছেন।
- ৬) উনাদয়ো বহুলম্ সূত্রটির দ্বারা তিনি উনাদি প্রকরণকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
- ৭) বৈদিক ভাষায় স্বাতন্ত্র্য দেখাবার জন্য তিনি বৈদিক ভাষা সংক্রান্ত বিশেষ সূত্রও রচনা করেছেন।
- ৮) ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে বিচার করলেও আমরা অষ্টাধ্যায়ী -র মধ্যে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান এর অনেক দিকই খুঁজে পাই।
অষ্টাধ্যায়ীর মূল্যায়ন :-
এইভাবে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করলে মহর্ষি পাণিনী ও তাঁর অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণ গ্রন্থের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়ে। বস্তুতঃ মহর্ষি পাণিনী হলেন প্রাচীন ভারতীয় মনীষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং তাঁর অষ্টাধ্যায়ী সত্যই এক বিস্ময়ের বিষয়।