পতঞ্জলি রচিত মহাভাষ্য সম্পর্কে যা জানো লেখ।
মহাভাষ্য পতঞ্জলি
ভূমিকা:- সূত্রকার পাণিনী, বার্তিককার কাত্যায়ণ ও মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি – এই তিনজনকে ত্রিমুনি বলা হয়। এদের তিনজনের ব্যাকরণগ্রন্থই ত্রিমুনি ব্যাকরণ নামে পরিচিত। ত্রিমুনি ব্যাকরণে ক্ষেত্রে তৃতীয় গ্রন্থটি হল মহাভাষ্য।
মহাভাষ্যের রচয়িতা :-
এর রচয়িতা মহর্ষি পতঞ্জলি। তিনি ত্রিমুনি ব্যাকরণের জগতে তৃতীয় মনে হলেও পাণিনীয় সম্প্রদায়ের বৈয়াকরণগনের মধ্যে তাঁর প্রভাব খুব বেশি। পরবর্তীকালে ভট্টোজি দীক্ষিত প্রমুখ বৈয়াকরণদের স্বীকৃত “যথোত্তরং মুনীনাং প্রামাণ্যম্” নীতিটির দিকে চেয়ে অন্তত সে কথাই মনে করা চলে।
মহাভাষ্যের অপর নাম :-
মহাভাষ্যকার পতঞ্জলিকে শেষনাগের অবতার কল্পনা করে মহাভাষ্যকে কোথাও কোথাও ফনিভাষ্যও বলা হয়।
পতঞ্জলির সময়কাল :-
মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির সময়কাল নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে অধিকাংশ পন্ডিতের মত অনুসরণ করে তাঁকে খ্রিঃপূর্বঃ দ্বিতীয় শতকের লোক বলেই সাধারণভাবে উল্লেখ করা চলে।
মহাভাষ্যের নামকরণের কারণ:-
মহাভাষ্য নামটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে যে পতঞ্জলির এই ভাষ্য কোন সাধারণ ভাষ্য নয়, এটি মহাভাষ্য। ভাষ্যের যেটি প্রচলিত লক্ষণ সেটি মহাভাষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ-
” সূত্রস্থং পদমাদায় বাকৈঃ সূত্রানুসারিভিঃ।
স্বপদানি চ বর্ণ্যন্তে ভাষ্যং ভাষ্যবিদো বিদুঃ।।”
পতঞ্জলির মহাভাষ্যে সূত্রস্থ পথগুলোকে নিয়ে যেমন আলোচনা করা হয়েছে তেমনি নিজের কথাও বলেছেন মহাভাষ্যকার। শুধু তাই নয় বেশ কিছু পাণিনীয় সূত্রকে প্রত্যাখ্যানও করেছেন তিনি। এমন ক্ষমতা কম ভাষ্যকারই দেখতে পেরেছেন। এইভাবে নানা দিক দিয়ে বিচার করলে পতঞ্জলির ভাষ্যের মহাভাষ্যত্ব প্রমাণিত হয়।
মহাভাষ্যের বিষয়বস্তু:-
মহাভাষ্যের বিষয়বস্তুর কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে এই গ্রন্থে পাণিনীর সূত্র ক্রমে অষ্টাধ্যায়ীস্থ সূত্রগুলিকেই প্রধানত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে সব সূত্রের ব্যাখ্যা পতঞ্জলি করেননি।সূত্র ছাড়া কাত্যায়ন ও সুনাগদির বার্তিকগুলি মহাভাষ্যে স্থান পেয়েছে এবং ব্যাখ্যাত হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, বার্তিকগুলির উৎসস্থল এই পাতঞ্জল মহাভাষ্যই। সমগ্র মহাভাষ্যে মোট ৮৫ টি আহ্নিক আছে। আহ্নিক নামটি থেকে কেউ কেউ মনে করেন যে এক একটি দিনে যতটা পড়ানো হতো বা যতটা রচনা হত, ততটা অংশই এক একটি আহ্নিকে স্থান পেয়েছে। মহাভাষ্যের প্রথম আহ্নিকটির নাম পস্পশা। পস্পশা শব্দের অর্থ প্রস্তাবনা বা উপোদঘাত। মহাভাষ্যের প্রথম ৯টি আহ্নিক নবাহ্নিক নামে পরিচিত।
মহাভাষ্য রচনাশৈলী:-
মহাভাষ্যের রচনাশৈলী এবং গদ্যও পণ্ডিতগণের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কঠিন বিষয় আলোচনার গুনে অনেক ক্ষেত্রেই সরস ও চিত্তগ্রাহী হয়ে উঠেছে। কাশিকাবৃত্তির টীকাকার হরদত্তের মতানুসরণ করে বলা যায় যে আক্ষেপ সমাধানের রীতিতে রচিত এই গ্রন্থটি যথার্থ ভাষ্য হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে পদমঞ্জুরী, টীকায় হরদত্তের দেওয়া ভাষ্য লক্ষণটিও স্মরণীয়-‘আক্ষেপ সমাধানপরো গ্রন্থো ভাষ্যম্’। বস্তুতঃ পাতঞ্জলি মহাভাষ্য গ্রন্থখানি পাণিনীয় সম্প্রদায়ে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে কোন কোন পন্ডিত অষ্টাধ্যায়ী এবং মহাভাষ্যকেই যথার্থ পাণিনীয় গ্রন্থ বলে মনে করেছেন-
“অষ্টাধ্যায়ী মহাভাষ্যে দ্বে ব্যাকরণপুস্তকে।
ততোঅণ্যৎ পুস্তকং যত্তু তৎসর্বৎ ধূর্তচেষ্টিতম্”।।
মহাভাষ্যের টীকা ও টিকাকার:-
পাতঞ্জলির মহাভাষ্যের ওপর আজ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে বহু আলোচনা হয়েছে এবং এই মহাগ্রন্থটির ওপর বহু টীকা ব্যাখ্যাদি রচিত হয়েছে। মহাভাষ্যের টীকা গুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো -আচার্য ভর্তৃহরি রচিত ত্রিপদী বা মহাভাষ্য দীপিকা। তবে মহাভাষ্যের ওপর রচিত আচার্য্য কৈয়টের লেখা প্রদীপ বা মহাভাষাপ্রদীপ নামক টীকাটি খুব পাণ্ডিত্যপূর্ণ। মহাভাষ্যের টীকাকারগণের মধ্যে ভর্তৃহরি, কৈয়ট এবং নাগেশের নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মহাভাষ্যের বিভিন্ন সংস্করণ:-
পতঞ্জলির এই মহাভাষ্য গ্রন্থটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে নির্ণয়সাগর প্রেস সংস্করণ( বোম্বাই ) পন্ডিত গুরু প্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত কাশি সংস্করণ, বেদব্রত শাস্ত্রী সম্পাদিত সংস্করণ, কীলহর্ণ সম্পাদিত সংস্করণ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মহাভাষ্যের মূল্যায়ন :-
পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ী-র মতো পতঞ্জলির মহাভাষ্য থেকেও তৎকালীন ভারতবর্ষের সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক তথ্যাদি পাওয়া যায়। পতঞ্জলিকালীন ভারতবর্ষ বিষয়ে অনেক পণ্ডিত সুন্দর সুন্দর প্রবন্ধাদি রচনা করেছেন। এই ভাবে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, পাণিনীয় সম্প্রদায় পাতঞ্জল মহাভাষ্য সত্য ইএকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।