অগ্নি সূক্ত ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত।
অগ্নি সূক্ত-ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত
দেবতা | অগ্নি |
ঋষি | মধুচ্ছন্দা |
ছন্দ | গায়ত্রী |
অগ্নি সূক্ত | প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত |
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ- ১
ওঁ অগ্নিমীলে পুরোহিতং
যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্।
হোতারং রত্নধাতমম্।।
অন্বয়:- অগ্নিম্ ঈলে যজ্ঞস্য পুরোহিতম্ দেবম্ ঋত্বিজম্ হোতারম্ রত্নধাতবম্ ।
বঙ্গানুবাদ:- আমি যজ্ঞের পুরোহিত, দেবগণের আহ্বানকারী, ঋত্বিক প্রভূতি পরিমাণ রত্নের ধারণকারী ( বা দাতা ) দেব (বা দীপ্তিমান ) অগ্নিকে স্তুতি করি।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ-২
“অগ্নিঃ পূর্বভিঃ ঋষিভি
রীড্যো নূতনৈরুত
স দেবাঁ এহ বক্ষতি।।”
অন্বয়:- অগ্নিঃ পূর্বেভিঃ ঋষিভিঃ ঈড্যঃ উত নূতনৈঃ। সঃ দেবান্ ইহ আ বক্ষতি।
বঙ্গানুবাদ:- অগ্নি পূর্বকালীন ঋষিগণের স্তুতিভাজন ছিলেন এবং নূতন ঋষিগণ কর্ত্তৃক ও তিনি স্তুতির যোগ্য। তিনি দেবগণকে এই স্থানে (যজ্ঞস্থলে) নিয়ে আসুন।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ-৩
“অগ্নিনা রয়িমশ্নবত্
পোষমেব দিবেদিবে
যশসং বীরবত্তমম্।।”
অন্বয়:- অগ্নিনা রয়িম্ অশ্নবৎ দিবেদিবে পোষম্ এব। যশসম্ বীরবত্তমম্।
বঙ্গানুবাদ:- (হোতাকর্ত্তৃক স্তুত) অগ্নির দ্বারা (যজমান) ধন লাভ করেন। (সেই ধন) দিনে দিনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, যশোযুক্ত হয় ( অর্থাৎ দানাদি কর্মে ব্যয় করার জন্য সেই ধনের দ্বারা যশ অর্জন করা যায়) এবং (সেই ধনের দ্বারা পুত্র ভৃত্যাদি) বীরপুরুষ অতিশয়রূপে প্রাপ্ত হওয়া যায়।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ- ৪
“অগ্নে যং যজ্ঞমধবরং
বিশ্বতঃ পরিভূরসি।
স ইদ্দেবেষু গচ্ছতি।।”
অন্বয়:- অগ্নে অবধরম্ যং যজ্ঞম্ বিশ্বতঃ পরিভূঃ অসি সঃ ইৎ দেবেষু গচ্ছতি।
বঙ্গানুবাদ:- হে অগ্নি, তুমি হিংসাবিহীন(ভাবে অনুষ্ঠিত) যে যজ্ঞকে চতুর্দিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে আছো, সেই যজ্ঞ অবশ্যই দেবতাদের উদ্দেশ্যে (স্বর্গলোকে) গমন করে থাকে।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ:- ৫
” অগ্নির্হোতা কবিক্রতুঃ
সত্যশ্চিত্রশ্রবস্তমঃ।
দেবো দেবভিরা গমৎ।।”
অন্বয় :- অগ্নিঃ। হোতা কবিক্রতুঃ সত্যঃ চিত্রশ্রবস্তমঃ, দেবঃ দেবেভিঃ আগমৎ।
বঙ্গানুবাদ:- অগ্নি হোমনিষ্পাদক (বা দেবগণের আহ্বানকারী), ক্রান্তপ্রজ্ঞ, সত্যস্বরূপ, বিচিত্র শ্রেষ্ঠ কীর্ত্তির অধিকারী। দ্যুতিমান সেই অগ্নি অন্য দেবতাদের সঙ্গে (এই যজ্ঞস্থলে) আগমন করুন।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ:- ৬
“যদঙ্গ দাশুষে ত্ব-
মগ্নে ভদ্রং করিষ্যসি।
তবেত্তৎ সত্যমঙ্গিরঃ।।”
অন্বয় :- অঙ্গ অগ্নে ত্বম্ দাশুষে যৎ ভদ্রম্ করিষ্যসি তৎ তব ইৎ হে অঙ্গিরঃ তৎ সত্যম্।
অনুবাদ:- হে অগ্নি, তুমি হবির্দানকারীর (যজমানের) জন্য যে কল্যাণসাধন কর, হে অঙ্গিরা, সেই কল্যাণ প্রকৃতপক্ষে তোমারই সুখহেতু হয়।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ- ৭
“উপ তাগ্নে দিবে দিবে
দোষাবস্তর্ধিয়া বয়ম্।
নমো ভরন্ত এমসি।।”
অন্বয়:- অগ্নে বয়ম্ দিবে দিবে দোষাবস্তঃ ধিয়া নমো ভরন্তঃ ত্বা উপ অহিমসি।
বঙ্গানুবাদ:- হে অগ্নি, আমরা প্রতিদিন অহোরাএ (প্রার্থনা ) বুদ্ধিযুক্ত হয়ে নমস্কার জানাতে জানাতে তোমার নিকটে আগমন করি।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ:- ৮
” রাজন্তমধবরাণাং
গোপামৃতস্য দীদিবিম্।
বর্ধমানং স্বে দমে।।”
অন্বয়:- রাজন্তম্ অধবরাণাম্ গোপাম্ ঋতস্য। দীদিবিম্ স্বে দমে বর্ধমানম্।
বঙ্গানুবাদ:- (হে অগ্নি, আমরা তোমার নিকটে আগমন করি যে তুমি) দীপ্যমান, আমার যজ্ঞসমূহের রক্ষক, অবশ্যম্ভাবী কর্মফলের দ্যোতক এবং যজ্ঞশালায় নিজ স্থানে বর্ধনশীল।
অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত সংহিতা পাঠ:- ৯
“স নঃ পিতেব সূনবে
অগ্নে সূপায়ণো ভব।
সচস্বা নঃ স্বস্তয়ে।।”
অন্বয়:- হে অগ্নে সঃ নঃ সূনবে পিতেব সূপায়নঃ ভব, নঃ স্বস্তয়ে সচস্ব।
বঙ্গানুবাদ:- পুত্রের নিকটে পিতা যেরূপ সহজগম্য (অর্থাৎ, পুত্র যেমন সহজে পিতার নিকট গমন করতে পারে) সে রূপ হে অগ্নি, তুমি আমাদের নিকটে অনায়াসে গম্য হও, আমাদের মঙ্গলের জন্য তুমি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হও (আমাদের কাছে অবস্থান কর। )
বৈদিক দেবতা রূপে অগ্নিদেবতার বৈশিষ্ট্য
উ:- বৈদিক সাহিত্য মানব মনীষীর এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। মানব জীবন ও কৃষ্টি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে অতি প্রাচীনকাল থেকে পার্থিব সমস্ত সভ্য জাতির দীপবর্ত্তিকা এই অগ্নিদেব। ঋগ্বেদে স্তুত বিভিন্ন বৈদিক দেবতাদের মধ্যে স্বরূপ ও মহত্তের দিক থেকে স্থান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বের দিক থেকে ২৫০ টি সূক্ত সমন্বিত ইন্দ্র দেবতার পরেই ২০০টি সূক্ত সমন্বিত অগ্নি দেবতার স্থান। অগ্নি আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী দেবতা।
শ্রুতিতে বলা হয়েছে-‘ অগ্নির্বৈ দেবানাম্ অগমঃ’ । আচার্য যাস্ক নিরুক্ত গ্রন্থে বলেছেন-
‘তিস্রঃ এব দেবতা ইতি নৈরুক্তাঃ অগ্নি পৃথিবী স্থানঃ।’
অগ্নি শব্দের উৎপত্তি অগ্ ধাতু থেকে। অগ্ ধাতুর অর্থ আলোক, জলন, শক্তি। অতএব যে শক্তির আধার জ্বলন্ত জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে সেই শক্তির আধার অগ্নি। অগ্নিবাচক ল্যাটিন শব্দ Ignis এবং স্লাভিক ভাষার অগ্নি শব্দের সঙ্গে উচ্চারণগত ও অর্থগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
এই অগ্নি দেবতার উৎপত্তি বিষয়ে নানান কাহিনী বৈদিক সূক্তে পাওয়া যায়। যেমন- কোথাও কোথাও তাকে সমগ্র পৃথিবীর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কোথাও আবার উল্লেখ রয়েছে যে অগ্নিকে মাতরিশ্বাই স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আনয়ন করেছেন। এই অগ্নির উৎপত্তি বিষয়গুলি জল, স্থল, অন্তরীক্ষে উল্লেখ রয়েছে-
‘ দিবস্পরি প্রথমং জঞ্জে অগ্নিরস্মদ্ দ্বিতীয়ং পরিজাত বেদাঃ তৃতীয়মপ্সু।’
বস্তুতপক্ষে অগ্নি সমস্ত কালের সমস্ত মানুষের অন্তরঙ্গ দেবতা। দৈনন্দিন জীবনে মানুষের সঙ্গে অগ্নির সম্পর্ক করে তা প্রমাণ করে। অগ্নিতেই মানুষের খাদ্য পাক হয়। বন্য পশু, অপদেবতা প্রকৃতির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অগ্নি মানুষের মুখ্য সহায়ক। অগ্নি আবরণকারী তমরাশিকে দূর করে।
মানুষ্য জীবনের বহুবিধ সংস্কার যেমন উপনয়ন বিবাহ শ্রাদ্ধও প্রভৃতি অগ্নিতেই সম্পাদিত হয়।
বৈদিক আর্যগণ অগ্নির সাথে এক গৃহে বাস করতেন, যুবা পুত্র যেমন পিতার কাছে সহজগম্য অগ্নিও তেমনি মানুষের কাছে সহজগম্য-
‘ স নঃ পিতেব সূনবে
অগ্নে সূপায়নো ভব
সচস্বা নঃ স্বস্তয়ে।।’
হে অগ্নি মর্ত্য মানুষের সুহৃদ ভ্রাতা মাতা পুত্র এবং জগতি- ‘পিতা মাতা সদম্ ইয়ং মানুষাণাম্।’
দেবতারা সাক্ষাৎভাবে যজ্ঞের হবি আস্বাদ করেন না। অগ্নির মুখ দিয়ে আস্বাদন করেন। এই জন্য অগ্নিকে দেবতাদের মুখ স্বরূপ বলা হয়েছে-‘ অগ্নির মুখং দেবাণাম্’। অগ্নির লেলিহান শিখাই তার জিহ্বা। তিনি শুধু দেবতাদের প্রতিনিধিরূপে যজ্ঞের আহুতি গ্রহণ করেন না, অগ্রবর্তী হয়ে দেবতাদের আনয়ন করেন। তাই তাকে দেবতাদের পুরোহিত বলা হয়েছে-
“ওঁ অগ্নিমীলে পুরোহিতং
যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্।
হোতারং রত্নধাতবম্।।”
আচার্য যাস্ক তার নিরুক্ত গ্রন্থে বলেছেন- ‘ অগ্নির্ভবতি অগ্রং যজ্ঞেষু প্রণীয়তে, অঙ্গং নয়তি সংনমমান।’ শুধু তাই নয়, অগ্নি হোতা, অধ্বর্যু, ব্রাহ্মণ এবং দ্যুলোক ও ভূলোকের দ্রুততম বার্তাবাহক। ঋষিরা এই অগ্নিকে রত্নধাতমম্ রূপে উল্লেখ করেছেন। অগ্নির উপাসনা দ্বারাই যজমান তার কাঙ্খিত ধন এবং সমৃদ্ধ প্রাপ্ত হন-
“অগ্নিনা রয়িমশ্নবত্
পোষমেব দিবেদিবে
যশসং বীরবত্তমম্।”
এই অগ্নি যজ্ঞের নিয়ন্তা। ঋত পথের বিধায়ক-
” রাজন্তমধবরাণাং
গোপামৃতস্য দীদিবিম্।
বর্ধমানং স্বে দমে।।”
এই অগ্নি স্তুতকারী যজমানকে বিত্ত, গৃহ, প্রজা, পশু রূপে কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করেন-
” যদঙ্গ দাশুষে ত্ব-
মগ্নে ভদ্রং করিষ্যসি
তবেত্তৎ সত্যমঙ্গিরঃ।”
এই অগ্নি ধীমান ও সত্যের প্রতিমূর্তি। বিচিত্রতার কীর্তিকলাপ। বিষ্ময়কর গৌরবের সঙ্গে তিনি যুক্ত-.
“অগ্নির্হোতা কবিক্রতু
সত্যশ্চিত্রশ্রবস্তমঃ।”
বৈদিক সাহিত্যের বিশেষত ঋকবেদে অগ্নিকে শরীরধারী পুরুষরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তার পৃষ্ঠদেশ ঘৃতবর্ণ, তার কেশরাশি স্ফুলিঙ্গ বর্ন, শ্মশ্রু পিঙ্গল বর্ণ এবং দন্ত পংক্তি সোনার মতো ভাস্কর। তার চিবুক সুগঠিত ও উন্নত- “ঘৃতপৃষ্ঠঃ ঘৃতপ্রতীকঃ ঘৃতনির্ণিকঃ (পরিধেয়)
. অগ্নির আলো ও তাপ হল যথাক্রমে প্রজ্ঞা ও প্রাণ। এই অগ্নি প্রচ্ছন্ন থাকেন ইন্ধনের মধ্যে। মন্থনের দ্বারা সেই অগ্নি জাগ্রত হন। অরণীদ্বয়ের ঘর্ষণের দ্বারা যেমন অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে তেমনি দেহাধারে অন্তশ্চতনা মন্থন করে আত্মশক্তিকে জাগরিত করা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেছেন-
“আগুনের পরশমণী ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবণপুণ্য করো দহন দানে।।”
- বৈদিক শব্দরূপ: বৈদিক যুগের ব্যাকরণের শব্দরূপের কিছু শর্ত
- ঋগ্বেদ সংহিতায়াঃ অক্ষসূক্ত ব্যাখ্যা
- ঋগ্বেদসংহিতা: অক্ষ সুক্ত
- হিরণ্যগর্ভ সুক্ত: সংস্কৃত ব্যাখ্যা
- হিরণ্যগর্ভ সূক্ত: সংহিতা পাঠ
- ঋগ্বেদে হিরণ্যগর্ভ সূক্তের বৈশিষ্ট্য
- শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ: ঈশ্বরের স্বরূপ
- বৈদিক উপসর্গের বৈশিষ্ট্য স্বরূপ ও ব্যবহার
- ঋগ্বেদীয় ধর্মনিরপেক্ষ সূক্ত
- ঋগ্বেদসংহিতা: দেবীসূক্ত
- নদী সূক্তের বৈশিষ্ট্য
- ঋগবেদ প্রাতিশাখ্য গ্রন্থের পরিভাষাপটল: সুত্র ব্যাখ্যা
- ঋগ্বেদের দার্শনিক সূক্ত
- অগ্নি সূক্ত: ঋগ্বেদসংহিতা, প্রথম মন্ডল, প্রথম সূক্ত
- বেদ: বিনিয়োগ ব্যাখ্যা
- নাসদীয় সূক্তের দার্শনিক তাৎপর্য
- সরস্বতী দেবীর স্বরূপ
- বরুণ দেবতার স্বরূপ
- সবিতা দেবীর স্বরূপ
- ঊষা দেবীর স্বরূপ
- রুদ্র দেবতার স্বরূপ
- বিষ্ণু দেবতার স্বরূপ
- ইন্দ্র দেবতার স্বরূপ
- অগ্নিসূক্ত অনুসারে অগ্নি দেবতার স্বরূপ বর্ণনা কর
- অক্ষসূক্তে ঋকবেদের যে সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে তার বর্ণনা