ঋগ্বেদের দশমমন্ডলের অন্তর্গত একাদশ অনুবাকে নাসদীয় সূক্তের দার্শনিক তাৎপর্য আলোচনা কর।
Table of Contents
নাসদীয় সূক্তের দার্শনিক তাৎপর্য আলোচনা
নাসদীয় সূক্ত | যেখানে কোন দেবস্তুতি বা প্রার্থনা নেই |
অপর নাম | সৃষ্টিসূক্ত |
অবস্থান | ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের অন্তর্গত একাদশ অনুবাক |
ছন্দ | ত্রিষ্টুপ্ |
ঋষি | পরমেষ্ঠী |
দেবতা | পরমাত্মা |
মন্ত্রসংখ্যা | সাতটি |
ঋগ্বেদে একহাজারেও কিছু বেশী সূক্ত আছে। এদের শতকরা নব্বইভাগে আছে দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে স্তুতি এবং অভীষ্ট প্রাপ্তির জন্য তাঁদের অনুগ্রহ প্রার্থনা। কিন্তু এমন কিছু সূক্ত আছে যেখানে কোন দেবস্তুতি বা প্রার্থনা নেই। যেমন- পুরুরবা-ঊর্বশী সংবাদ, যম-যমীসংবাদ প্রভৃতি সংবাদ সূক্তগুলিতে কথোপকথন,অক্ষসূক্তে অক্ষক্রীড়ার নিন্দা, ভেকসূক্তে ব্যাঙেদের উল্লাসের বর্ণনা রয়েছে। এগুলিকে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক সূক্ত বলে। এইরূপ সূক্তগুলির মধ্যে পুরুষসূক্ত ও নাসদীয়সূক্ত বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
নাসদীয় সূক্তে মাত্র সাতটি মন্ত্র আছে। কিন্তু প্রত্যেকটি মন্ত্রেই হীরকখন্ডের মত স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মন্ত্রগুলি হেঁয়ালীপূর্ণ মনে হলেও এদের গূঢ় মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়। নাসদীয় সূক্তের সূচনায় জগৎসৃষ্টির পূর্বেকার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।
নাসদীয় সূক্তের ঋষি দেবতা ছন্দ :-
ঋগ্বেদের দশমমন্ডলের অন্তর্গত একাদশ অনুবাকে ত্রয়বিংশতি সূক্ত আছে। সেগুলির মধ্যে ‘নাসদাসীৎ‘ এই মন্ত্রপ্রতীকের দ্বারা নাসদীয় সূক্তে সাতটি মন্ত্র আছে। এই মন্ত্রের ঋষি হলেন পরমেষ্ঠী। দেবতা হলেন পরমাত্মা এবং ছন্দ হল ত্রিষ্টুপ্।
নাসদীয় সূক্তের দার্শনিক তাৎপর্য :-
ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের অন্তর্ভুক্ত নাসদীয় সূক্তটি সৃষ্টিসূক্ত নামে পরিচিত। এই সূক্তটিতে বিশ্বসৃষ্টি বিষয়ক প্রাচীন ঋষিদের প্রাথমিক ধারনাগুলি আত্মপ্রকাশ কদেছে।
ঋষিদের মনে প্রশ্ন জেগেছে-
“কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্র বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।
অর্ধাগদেবো অস্য বিসর্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব।।”
অর্থাৎ, কোথা থেকে জন্মাল, কোথা থেকে বিবিধ প্রকার সৃষ্টি হল? যদিও সৃষ্টি রহস্য দুজ্ঞেয় তথাপি সৃষ্টির পূর্বেকার অবস্থার বিবরণ দিয়ে সৃষ্টি প্রক্রিয়াত্ব সূত্র নির্দেশ করা হয়েছে এই সূক্তে।
সূক্তের আরম্ভে বলা হয়েছে সৃষ্টির পূর্বে অসৎ ও সৎ কিছুই ছিলনা। অন্তরীক্ষ ও তদতীত আকাশও ছিল না। তখন কে কাকে কোথায় বা কিসের জন্য আবারণ করল?
অগাধ ও গহন জল কি তখন ছিল?-
” নাসদামীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কীমাসীদগহনং গভীরম্।।”
তখন মৃত্যুও অমরত্ব ছিল না। রাত্রি ও দিনের ব্যবধান ছিল না। সেই এক ও অদ্বিতীয় একমাত্র ব্রহ্মা স্বীয় শক্তির দ্বারা বায়ু ব্যতীত শ্বাস উচ্ছ্বাস করে স্ফুর্তিমান ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না-
” ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ।
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিং চনাস।।”
সৃষ্টির পূর্বে কি ছিল-
নাসদীয় সূক্তের ঋষি এইভাবে তাই ব্যক্ত করেছেন। এইতত্ত্ব দুর্বিজ্ঞেয় ও অনির্বাচ্য। সদসৎ, মৃতামৃত, দিবারাত্র প্রভৃতি পরস্পর দৈত্বসৃষ্টির পরে ঐতত্ত্ব অভিব্যক্ত হওয়ায় একটি অপরটির জ্ঞান আপেক্ষিক হয়ে পড়ে।
এই কারণে যথার্থই বলা হয়েছে “নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীম্” অর্থাৎ সৎ ও অসৎ কোনটিই ছিল না। জগতের আদি অব্যক্ত মূলতত্ত্বের এমন গভীর মূলস্পর্শী বিচার এখানে লক্ষ্য করা যায়। এই তত্ত্বই পরবর্তীকালে উপনিষদ ও বেদান্ত শাস্ত্রে নানাভাবে বিবৃত হয়েছে।
প্রতিটি উৎপত্তির অন্তরালে পদার্থ পরিবর্তনের নিয়মক্রম অনুসৃত হয়ে থাকে। ঋগ্বেদের এই নাসদীয়সূক্তে অসদবিকারকে বৈজ্ঞানিক ধারণায় স্ফুরণতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সৃষ্টির প্রারম্ভে কোন কিছুই ছিল না। কেবল বা Dot এর প্রভাব ছিল। এই বিন্দু ধীরে ধীরে সংক্রামিত হতে থাকে। এর থেকে সমস্ত বিশ্বের উদ্ভব ঘটে। প্রাণী ও নক্ষত্রপুঞ্জে বিশ্বের উদ্ভবের মূল লক্ষিত হয়। দিনকে উৎস এবং রাত্রিকে বিনাশরূপে গণ্য করা হয়। সৃষ্টির মূলে নামরূপে বর্জিত বেদান্ত প্রতিপাদ্য অব্যক্ত পরমাত্মা থেকে নামরূপ বিশিষ্ট জাগতিক জীবাত্মারূপ সদ্বস্তুর বিকার লক্ষিত হওয়ায় ‘অসতঃ সদজায়ত’ এই শ্রুতির তাৎপর্য অনুমোদিত হয়।
উপসংহার:- বেদ ও উপনিষদে সৃষ্টি তত্ত্বের মূল সুর ধ্বনিত হয়। সেখানে কারণ ও কার্যের সংঘাতরূপে একই সত্তা বিধৃত রয়েছে। প্রত্যেকটি পদার্থে বিবিধ শক্তির ধর্ম স্বীকৃত হয়। সর্বসাধারণ সত্তারূপে আণবিক শক্তিই একমাত্র কর্ম করে। এর ফলে সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি হয়। এইভাবে নাসদীয় সূক্তের অবতারণা করা হয়েছে।
ঋগ্বেদের দশমমন্ডলের অন্তর্গত একাদশ অনুবাকে নাসদীয় সূক্ত বাংলা অর্থ সহ
नासदासीन्नो सदासीत्तदानीं नासीद्रजो नो व्योमा परो यत्।
किमावरीवः कुह कस्य शर्मन्नम्भः किमासीद्गहनं गभीरम् ॥১॥
তৎকালে যাহা নাই, তাহাও ছিল না, যাহা আছে তাহাও ছিল না। পৃথিবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না।
আবরণ করে এমন কি ছিল? কোথায় কাহার স্থান ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল?
न मृत्युरासीदमृतं न तर्हि न रात्र्या अह्न आसीत्प्रकेतः।
आनीदवातं स्वधया तदेकं तस्माद्धान्यन्न परः किञ्चनास ॥২॥
তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না।
কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মামাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস প্রশ্বাস যুক্ত হইয়া জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।
तम आसीत्तमसा गूहळमग्रे प्रकेतं सलिलं सर्वाऽइदम्।
तुच्छ्येनाभ्वपिहितं यदासीत्तपसस्तन्महिनाजायतैकम् ॥৩॥
সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। সর্বত্রই চিহ্ন বর্জিত ও চতুর্দিক জলময় ছিল।
অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সেই সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে সেই এক বস্তু জন্মিলেন।
कामस्तदग्रे समवर्तताधि मनसो रेतः प्रथमं यदासीत्।
सतो बन्धुमसति निरविन्दन्हृदि प्रतीष्या कवयो मनीषा ॥৪॥
সর্বপ্রথমে মনের উপর কামের আবির্ভাব হইল। তাহা হইতে সর্বপ্রথম উৎপত্তি কারণ নির্গত হইল।
বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন আপন হৃদয়ে পর্যালোচনা-পূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তি স্থান নিরূপণ করিলেন।
तिरश्चीनो विततो रश्मिरेषामधः स्विदासीदुपरि स्विदासीत्।
रेतोधा आसन्महिमान आसन्त्स्वधा अवस्तात्प्रयतिः परस्तात् ॥৫॥
রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হইলেন। মহিমাসকল উদ্ভব হইলেন। উহাদিগের রশ্মি দুই পার্শ্বে ও নিম্নের দিকে এবং ঊর্ধ্ব দিকে রহিলেন।
को अद्धा वेद क इह प्र वोचत्कुत आजाता कुत इयं विसृष्टिः।
अर्वाग्देवा अस्य विसर्जनेनाथा को वेद यत आबभूव ॥৬॥
কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করিবে? কোথা হইতে জন্মিল? কোথা হইতে নানা সৃষ্টি হইল?
দেবতারা এই সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হইয়াছেন। কোথা হইতে যে হইল, তাহা কেই বা জানে?
इयं विसृष्टिर्यत आबभूव यदि वा दधे यदि वा न।
यो अस्याध्यक्षः परमे व्योमन्त्सो अङ्ग वेद यदि वा न वेद ॥৭॥
এই নানা সৃষ্টি যে কোথা হইতে হইল, কেহ সৃষ্টি করিয়াছেন কি করেন নাই, তাহা তিনিই জানেন, যিনি ইহার প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও না জানিতে পারেন।
আরো পড়ুন –