ঋগ্বেদে হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তের বৈশিষ্ট‍্য

ঋগ্বেদে হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তের বৈশিষ্ট‍্য আলোচনা কর?

ঋগ্বেদে হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তের বৈশিষ্ট‍্য আলোচনা

হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তঋকসংহিতায় দশম মন্ডলের ১২১ নং সূক্ত
হিরণ‍্যগর্ভ সুক্তের ঋষিহিরণ‍্যগর্ভ ঋষি
হিরণ‍্যগর্ভ সুক্তের ছন্দত্রিষ্টুপ্ ছন্দ
হিরণ‍্যগর্ভ সুক্তের দেবতাপ্রজাপতি দেবতা
হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তে মন্ত্রের সংখ‍্যা মন্ত্রের সংখ‍্যা দশটি

উ:- বৈদিক সাহিত‍্য মানব মনীষির এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বৈদিক যুগে বহুদেবতাবাদ প্রতিষ্ঠিত ছিল। তা সত্ত্বেও দেবতার সংখ‍্যা সম্বন্ধে বিভিন্ন মত পার্থক‍্য লক্ষ‍্য করা যায়। সাধারনভাবে দেবতাতত্ত্বের দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও সংখ‍্যা সম্বন্ধে হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তের বিষয়গত ও তাত্ত্বিক দিক আলোচিত হয়েছে। দর্শন জিজ্ঞাসা, তথা সৃষ্টি চিন্তার উৎস হিসেবে ঋগ্বেদে এই সূক্তের উপস্থিতি। এখানে প্রজাপতির স্রষ্টারূপ স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

ঋকসংহিতায় দশম মন্ডলের ১২১ নং সূক্ত হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তটি । এই সূক্তে হিরণ‍্যগর্ভ ঋষি, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ ও প্রজাপতি দেবতা। এই সূক্তে মন্ত্রের সংখ‍্যা দশটি।

হিরণ‍্যগর্ভ শব্দের অর্থ

হিরণ‍্যগর্ভ শব্দের অর্থ নিয়ে পণ্ডিত মহলে মতান্তরের অবধি নেই। ঋগ্বেদের বিখ‍্যাত ভাষ‍্যকার আচার্য সায়ণ এই শব্দটিকে দ্বিবিধ অর্থে গ্রহণ করে তার মত প্রকাশ করেছেন-

” হিরণ‍্যং ব্রহ্মাণ্ড রপং যস‍্যেশ্বরস‍্য প্রজাপতেগর্ভে বর্ততে সোঅয়ং হিরণ‍্যগর্ভঃ।।”

অর্থাৎ হিরণ্ময় ব্রহ্মাণ্ড যার উদরে অবস্থান করেছে সেই প্রজাপতি দেবতাই হিরণ‍্যগর্ভ।

আবার “যদ্ধা হিরণ‍্যস‍্য ব্রহ্মান্ডস‍্য মধ‍্যে সত‍্যলোকে গর্ভরূপেন অবস্থিতশ্চতুর্মুখো হিরণ‍্যগর্ভঃ।” অর্থাৎ হিরন্ময় অন্ডের মধ‍্যে মর্ত‍্যলোক গর্ভরূপে অবস্থিত চতুরানন ব্রহ্মাই হল হিরণ‍্যগর্ভ।

হিরণ‍্যগর্ভ জন্মের সাথে সাথেই প্রভু হয়ে উঠেছেন-

” হিরণ‍্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে
  ভূতস‍্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।।”

বেদে হিরণ‍্যগর্ভকে বোঝানোর জন‍্য শাস্ত্রে ‘ক’ শব্দটির ব‍্যবহার হয়েছে। এই সূক্তের শেষ মন্ত্র ব‍্যতিত প্রতিটি মন্ত্রের অন্তিম পদে “কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।” অংশে আচার্য সায়ণ ক শব্দের দ্বারা হিরণ‍্যগর্ভ প্রজাপতি দেবতাকে  বুঝিয়েছেন। কিন্তু ভট্টভাস্কর প্রভৃতি ভাষ‍্যকারেরা ক শব্দের দ্বারা কোনো অজ্ঞাত দেবতাকে বুঝিয়েছেন।

হিরণ‍্যগর্ভ সূক্তের বৈশিষ্ট‍্য

হিরণ‍্যগর্ভ সৃষ্টির আদিতে বর্তমান ছিলেন। তিনি জীবের আত্মা, বল ও মৃত্যু দিয়েছেন।  আচার্য যাস্কের মতে, ‘প্রজাপতিঃ প্রজানাং পাতা পালয়িত বা।’ যার গর্ভ অর্থাৎ অভ‍্যন্তর ভাগ ছিল হিরণ্ময় তিনি হিরণ্যগর্ভ। এই অর্থে সূর্যদেবতাও হিরণ্যগর্ভ। কারণ তিনি আকাশকে স্ব স্থানে স্থাপিত করেছেন।  পৃথিবীকে সৃষ্টি ও স্থির করেছেন, তিনি জীবাত্মা দিয়েছেন, বল দিয়েছেন, তার আজ্ঞা  সকল দেবতারা মান্য করেন, তাঁর ছায়া অমৃত স্বরূপ,  মৃত্যু তাঁর বস‍্যতা স্বীকার করে।

” য আত্মদা বলদা যস‍্য বিশ্ব
উপাসতে প্রশিষং যস‍্য দেবাঃ।।”

গুন ও স্বরূপের বিচারে ঋকবেদের সূর্য, অগ্নি, ইন্দ্র ও হিরণ্যগর্ভ একই বস্তু।  অতএব বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে একত্রে কল্পনাই এখানে একেশ্বরবাদ সূচিত হয়েছে।

       তিনি আপন মহিমায় সকল জ্ঞানেন্দ্রিয় সম্পূর্ণ গতিশক্তি যুক্ত জীবেদের রাজা হয়েছেন।সকল দ্বিপদ ও চতুষ্পদের প্রভু হয়েছেন। তারই মহিমায় হিমাচ্ছন্ন পর্বতসমূহের উৎপত্তি হয়েছে। এই স্বসাগরা ধরনী তারই সৃষ্টি, দিক সকল তারই বাহু স্বরূপ-

    ” যস‍্যেমে হিমবন্তো মহিত্বা
      যস‍্য সমুদ্রং রসয়া সহান্হঃ।।”

তাঁকে আশ্রয় করে সূর্য উদিত ও দ্বীপ্ত যুক্ত হয়। এই হিরণ্যগর্ভই নিজ মহিমা দ্বারা জলের উপর সর্বভাগে নিরিক্ষণ করেছিলেন। তিনিই সমস্ত দেবতার অদ্বিতীয় দেবতা হয়েছেন। তাঁর পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম প্রদর্শিত হয়েছে-

” হিরণ‍্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে
ভূতস‍্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ‍্যামুতেমাং
কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।”

আনন্দদানকারী অনন্ত জলরাশি তারই  সৃষ্টি- ” ইয়ং চ অপচন্দ্রা বৃহতি জনান্।” তিনি যেন সকলের প্রতি প্রসন্ন হন, এটি ঋষির প্রার্থনা। তাই শেষ মন্ত্রে যজমান তাকে হবি নিবেদন করে শ্রেষ্ঠতম ধর্মের প্রতি নিরন্তন হওয়ার প্রার্থনা করেছেন-

” প্রজাপতে ন ত্বদেতান‍্যন‍্যো
   বিশ্বা জাতানি পরি তা বভূব।
   যৎ কামান্তে জুহ মস্তন্নো অস্তু
   বয়ং স‍্যাম পতয়ো রয়ীণাম্।।”

এভাবে সমগ্র হিরণ্যগর্ভ সূক্তের মধ্যে একেশ্বরবাদ সৃষ্টি ও স্রষ্ট্বার স্বরূপ প্রভৃতি দার্শনিক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। হিরণ্যগর্ভ সূক্ত প্রতিটি মন্ত্রের শেষবাক‍্যে একেই মন্ত্রের পূর্ণাবৃত্তি পাই-‘কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।’

অধ্যাপক ক্ষীতিশ চট্টোপাধ‍্যায়ের মতে দ্বিতীয় মন্ডলের সরর্জনীয় সূক্তের অনুকরণেই পরবর্তীকালে দশম মন্ডলের হিরণ্যগর্ভ সূক্ত রচিত হয়েছে। এমনকি দেবীসূক্ত ও হিরণ্যগর্ভ সূক্তে বর্ণিত একেশ্বরবাদই পরবর্তীকালে উপনিষদে পরিণতি লাভ করেছে।

Comments