উপনিষদ বলতে কী বোঝ? ঈশোপনিষদে আত্মার স্বরূপ কীভাবে বিবৃত হয়েছে তা আলোচনা কর।
উপনিষদ বলতে কী বোঝ?
উ:- উপনিষদ শব্দের অর্থ ব্রহ্মজ্ঞান বা ব্রহ্মবিদ্যা- ” উপনিষদ্যতে প্রাপ্যতে ব্রহ্মবিদ্যা অনয়া ইতি।” উপ-নি-সদ্ +ক্বিপ্ প্রত্যয়ের দ্বারা উপনিষদ শব্দ নিষ্পন্ন- ” উপনিভ্যাং সদের্ধাতোঃ ক্বিপি চোপনিষন্মতাঃ।” পানিনি ব্যাকরনে বলা হয়েছে- “সদ্ ন বিশরন গত্যবসাদনেষু।” অর্থাৎ সদ্ ধাতু তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই তিনটি অর্থ হল-i) সদ্ ধাতুর অর্থ বিশরণ বা বিনাশ, ii) সদ্ ধাতর অর্থ গতি বা প্রাপ্তি। iii) সদ্ ধাতুর অর্থ অবসাদন বা শিথিলীকরণ বা উচ্ছেদ করা। এই তিন অর্থে উপনিষদে যে ব্রহ্মবিদ্য তা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ভক্তিশ্রদ্ধা পূর্বক এই বিদ্যার অনুশীলন করেন(নি) ব্রহ্মবিদ্যা তাঁদের সংসারের বীজ স্বরূপ অবিদ্যা প্রভৃতিকে বিনাশ (সদ্ -বিশরণ- নাশ) করে। এই জন্য ব্রহ্মবিদ্যার নাম উপনিষদ্। যে বিদ্যা অনুশীলনের ফলে তার অবিদ্যাকে বিনষ্ট করে ব্রহ্ম সমীপে নিয়ে যায়, যা ব্রহ্মকে পাইয়ে দেয় তার নাম উপনিষদ্। উপনিষদ্ প্রসঙ্গে পল ডয়সেন বলেন-
” Upanishad means a confidential secret sitting.”
অর্থাৎ উপনিষদ কথার অর্থ গোপন বৈঠক।
ঈশোপনিষদে আত্মার স্বরূপ কীভাবে বিবৃত হয়েছে তা আলোচনা কর।
বিশ্ব রহস্যকে ভেদ করার প্রবল আগ্রহ থেকে সৃষ্টি হলো উপনিষদ। তাতে বলা হয়েছে বিশ্ব একটি মাত্র নৈর্ব্যক্তিক মহাশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই মহাশক্তি কখনোও আত্মা, কখনও কখনও পুরুষ বা সৎ নামে অভিহিত। সেই আত্মা ঈশা, তিনি রসঘন, আনন্দঘন ও প্রেমময়, তিনি সচ্চিদানন্দময়, সত্য শিব ও সুন্দরের রসময় আনন্দঘন মূর্তি তিনি। এই আনন্দ থেকে জীবজগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনষ্ট। তাকে জানতে হলে জীবাত্মাকে পরম আত্মায় নীল হতে হয়। ঈশোপনিষদের চতুর্থ মন্ত্র থেকে অষ্টম মন্ত্রে প্রধানভাবে আত্মার স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে।
ঈশোপনিষদের আত্মন্ বা ব্রহ্ম বলতে চতুর্থ মন্ত্রে “তদ্ধা বতোঅন্যানত্যোতি তিষ্টৎ” বাক্যে তৎ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রহ্মের বাচক তিনটি ওঁ, তৎ, সৎ।
গীতায় বলা হয়েছে-
“ওঁ তৎসদিতি নির্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ। ব্রহ্ম বা আত্মা সমার্থক।
অমরকোশে বলা হয়েছে – ” আত্মা যত্নো ধৃতির্বুদ্ধিঃ স্বভাবো ব্রহ্ম বর্ষ্ম চ” অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বা ব্রহ্ম। আত্মস্বরূপ না জানলে তার ফলস্বরূপ জীবদেহের পুনঃ পুনঃ জন্মমরনের বশবর্তী হয়ে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয়। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
“তে তং ভূক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালম্।
ক্ষীনে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি।।”
এই আত্মস্বরূপ জেনে জ্ঞানী মোক্ষ লাভ করেন। করুণাময়ী শ্রুতি সেই আত্মাস্বরূপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন-
” অনেজদেকং মনসো জবীয়ো
নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্ পূর্বমর্ষৎ।
তদ্ধাবতোঅন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ
তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি।।”
এই আত্মা স্বভাবতই এক ও অভিন্ন, কম্পন বা বিকার রহিত। তিনি গতিহীন হয়েও মন অপেক্ষা দ্রুতগামী, স্থির হয়েও ধাবমান। আত্মা সর্বব্যাপী হওয়ায় সর্বত্রই তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে। আত্মার সর্বাত্মদর্শী আলোচনা প্রসঙ্গে ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে-
“যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানু পশ্যতি
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো বিজুগুপ্সতে।।”
অর্থাৎ যিনি সর্বভূতকে আত্মাতে দেখেন এবং আত্মাকেও সর্বভূতে দেখেন, তিনি এইরূপ দর্শনের ফলে কাউকে ঘৃণা করেন না। অপরদিকে,
“যস্মিন্ সর্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ একত্বভনুপশ্যতে।।”
অর্থাৎ যে সময়ে বা যে আত্মাতে সর্বভূতই আত্মায় এক ও অভিন্ন হয়ে যায়, সে সময় সেই একত্বদর্শী জ্ঞানীর শোকই বা কি, আর মোহই বা কি? অর্থাৎ শোক, মোহ কিছুই থাকে না। কামনা ও কর্মের বীজকে যে জানে না তারই শোক ও মোহ হয়। বস্তুত ব্রহ্মের দুটি ভাব-
- a) নিরুপাধিক, তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ, নিষ্ক্রিয়, নিধর্মক, গতিহীন বিভু, নিত্যশুদ্ধ, সচ্চিদানন্দ স্বরূপ।
- b) সোপাধিক আত্মা বেগবান। তিনি সবকিছুর মধ্যে থেকেও সবকিছুকে অতিক্রম করে যান।
ইন্দ্রিয়াদি দেবতার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ এই পরমাত্মার প্রভাবেই পরিচালিত হয়। আত্মা বা ব্রহ্ম সর্বব্যাপক বলেই তিনি চলেন আবার চলেন না, তিনি দূরে আবার নিকটে। তিনি বিশ্ব প্রপঞ্চের অন্তরেও বাইরেও আছেন-
“তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।।”
অর্থাৎ জ্ঞানীদের কাছে তিনি সন্নিকটে আর অজ্ঞানীদের কাছে তিনি অতিদূরে। এই আত্মা বিশুদ্ধ, জ্যোতির্ময়,স্থুল-সূক্ষ্ম শরীর শূন্য, অক্ষত, স্নায়ুস্থিত, নির্মল,ক্রান্তদর্শী কবি, মনীষী, সর্বোপরি সর্বত্র বিরাজমান, স্বয়ম্ভূ, সর্ভজ্ঞ, সর্বদর্শী এবং সকলের উপরে বিদ্যমান-
” স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ
যাথাতথ্যতোঅর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।”
তিনি নিত্যকাল ধরে সংবৎসরাঘ্য প্রজাপতিদের কর্তব্য যথাযথভাবে বিভাগ করে দিয়েছেন।
আত্মা বা ব্রহ্ম সকল কর্মের নিয়ন্তা ও সকলের কর্মফলদাতা। তাঁকে জানলে অজ্ঞানতা দূর হয় এবং জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য সুচিত হয়। এই ব্রহ্মা বা আত্মজ্ঞান লাভই হল পারমার্থিক অমৃতত্ত্ব লাভের একমাত্র পন্থা।