ঋগ্বেদীয় ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলির বিষয়ে আলোচনা কর। ঋগ্বেদীয় ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলি মূল্যায়ণ করো। ঋকবেদের উল্লেখযোগ্য ঋগ্বেদীয় ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে মূল্যায়ন করা হল।
ঋগ্বেদীয় ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলির বিষয়ে আলোচনা
ঋগ্বেদে প্রধানত দেবতার স্তুতি পরিলক্ষিত হয়। এই বেদ মূলত দেবস্তুতিমূলক এবং ধর্মমূলক হলেও এখানে এমন কিছু উল্লেখযোগ্য সূক্ত আছে যেগুলিতে দেবতা বিষয়ক ভাবনা মুখ্য স্থান লাভ করেনি। ধর্মের সঙ্গে এই সূক্ত গুলির কোন সংশ্রব নেই। সেই ধরনের সূক্তগুলিকে ধর্মনিরপেক্ষ সূক্ত বলে।
উল্লেখযোগ্য ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলি
ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলিও আবার অনেক ধরনের আছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
- i) নীতি প্রতিপাদক সূক্ত,
- ii) ইন্দ্র জালাত্মক সূক্ত,
- iii) নারাশংসী সূক্ত,
- iv) দানস্তুতিমূলক সূক্ত,
- v) সংবাদ সূক্ত,
- vi) সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক সূক্ত,
- vii) বিবাহ বিষয়ক সূক্ত,
- viii) বনানী সংক্রান্ত সূক্ত ইত্যাদি।
সপ্তম মন্ডলের ১০৩ সংখ্যক সূক্তটি ভেকসূক্ত নামে প্রসিদ্ধ। এই সূক্তের একটি মন্ত্রে বর্ষা সমাগমে উৎফুল্ল ভেকদিগের রবকে বৎস লাভকারী ধেনুদের রবের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
” দিব্যা আপো অভি যদেনমায়ন্দৃতিং ন শুষ্কং সরসী শয়াণম্।
গবামহ ণ মায়ুর্বৎসিনীনাং মন্ডুকানাং বগ্নুরতা সমেতি।।”
অপর একটি মন্ত্রে (৭/১০৩/৭) ভেকের শব্দকে অতিরাত্র নামক সোমযাগে স্তোতৃবর্গের উচ্চারিত মন্ত্রধ্বনির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলিকে নিম্নে আলোচনা করা হল-
১ ) নীতিপ্রতিপাদক সূক্ত
ধর্মনিরপেক্ষ সূক্ত গুলির মধ্যে নীতি প্রতিপাদক সূক্ত গুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইগুলি হল –
ক) নবম মন্ডলের ১১২ সংখ্যক সূক্ত মানুষের বিচিত্র কর্মজীবনের চিত্র ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ধ্বনিত হয়েছে।
খ) অক্ষসূক্তে দশমমণ্ডলের ৩৪ সংখ্যক সূক্তে পাশা খেলায় আসক্ত সর্বস্বান্ত এক জুয়াড়ির করুন বিলাপ ধ্বনিত হয়েছে-
“অক্ষৈর্মা দীব্যঃ কৃষিমিৎ কৃষস্ব।
বিত্তে রমস্ব বহু মন্যমানঃ।।”
২) ইন্দ্রজালাত্মক সূক্ত
ঋগবেদে ইন্দ্রজালাত্মক সূক্তের সংখ্যা প্রায় ৩০ টি। এই জাতীয় সূক্তগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
- (ক) প্রথম মন্ডলের ১৫১ নম্বর সূক্তে নানা জীবজন্তুর বিষক্রিয়া নষ্ট করার মন্ত্র পাওয়া যায়।
- (খ) মন্ডলের ১৬৩ নম্বর সূক্তে যক্ষা রোগ বিনাশের মন্ত্র আছে।
- (গ) ষষ্ঠ মন্ডলের ৭৫ সংখ্যক সূক্তে যোদ্ধার বর্ণ, মৃগশৃঙ্গ নির্মিত তীরের ফলা, গরুর স্নায়ু নির্মিত জ্যা, রথ ও অশ্বের কার্যকারিতা প্রভৃতি উপমার্গভ বর্ণনাই এই সূক্তের মূল বিষয়।
এই সূক্তের শেষ ঋকটি আবার জ্ঞাতিশত্রুতার পরিচয়বাহী এবং অনিষ্ঠকারী জ্ঞাতিদের প্রতি অভিশম্পাত স্বরূপ-
” যো নঃ স্বো অরণে যশ্চ নিষ্ট্যো জিঘাংসেতি দেবাস্তং সর্বে ধূর্বন্তু ব্রহ্ম বর্ম মমান্তরম্।।”
৩) নারাশংসী ও দানস্তুতিমূলক সূক্ত
– দাতার স্তুতিমূলক সূক্তিকে বলে নারাশংসী। দানের প্রশংসা সূচক সূক্তিগুলিকে বলে দানস্তুতি। এই জাতীয় সূক্তগুলি হল দশম মন্ডলের (১০৭, ১১৭) প্রথম মন্ডলের (১২৫, ১২৬)
৪) সংবাদ সূক্ত
ঋকবেদের সংবাদ সূক্তগুলি কথোপকথনের দ্বারা রচিত। অধ্যাপক ওন্ডেনবার্গ এগুলিকে আখ্যা মুলক সূক্ত বলেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
- ক) প্রথম মন্ডলের ১৭৯ সংখ্যক সূক্তটি অগস্ত্য লোপামুদ্রার সংবাদ।
- খ) দশম মন্ডলের দশ সংখ্যক সূক্তটি যমযমী সংবাদ।
- গ) দশম মন্ডলের ৫১ ও ৫২সংখ্যক সূক্ত অগ্নি ও দেবগনের কথোপকথনের সংবাদ।
- ঘ) দশম মন্ডলের ১০৮ সংখ্যক সূক্তে সরমা ও পণি সংবাদ।
পনিরা নানা প্রলোভনে প্রলুব্ধ করলে সরমা সমস্ত প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে বলল-
” নাহং বেদ ভ্রাতৃত্বংনো স্বসৃত্বমিন্দ্রো বিদুরঙ্গিরসশ্চঘোরাঃ গোকামা মে আচ্ছদয়ন্ যদায়মপাত ইতপণয়ো বরীয়ঃ।।”
৫) সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক সূক্ত
সৃষ্টির উদ্ভব ও সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করে যে সমস্ত সূক্ত রচিত হয়েছে তার মধ্যে নাসদীয় সূক্তটি (১০/১২৯) সর্বাপ্রেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দেবী সূক্ত( ১০/৭২), পুরুষসূক্ত (১০/৯০), হিরণ্যগর্ভ সূক্ত (১০/১২১) এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। হিরণ্যগর্ভ সূক্ত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
” হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে
ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং
কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।”
৬) বিবাহ বিষয়ক সূক্ত
দশম মন্ডলের ৮৫ সংখ্যক সূক্তে সূর্যাকন্যা সূর্যের সঙ্গে সোমের বিবাহ বর্ণিত হয়েছে। কিছু মন্ত্রে বিবাহের আচার-আচরণ, বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি উপদেশ এবং বর- বধূর সম্মিলিত প্রার্থনা বর্ণিত হয়েছে-
” সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাৎ
ননান্দরি সম্রাজ্ঞী ভব সম্রাজ্ঞী অধিদেবেষু।”
৭) বনানী সংক্রান্ত সূক্ত
দশম মন্ডলের ১৪৬ সংখ্যক সূক্তে ছয়টি ঋক্ সমন্বিত জনমানবহীন অরন্যানীর বর্ণনা বাস্তবোচিত এবং কাব্যধর্মী-
” নানানং বা উ ণো ধিয়ো ব্রাণি জনানাম্
তক্ষা রিষ্টং রুতং ভিষগব্রক্ষা সুণ্বন্তমিচ্ছন্তীদ্রায়েন্দো পরিস্রবঃ।”
ঋগ্বেদীয় ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তগুলির অবদান
ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে এই ধর্মনিরপেক্ষ সূক্ত গুলির অবদান অসামান্য। এখানে সকল শ্রেণীর কবিতা, মহাকাব্য ও নাটকের বীজ, গদ্যের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ভিন্টারনিৎস এর মতে প্রাচীন গাথা জাতীয় রচনাগুলি মহাকাব্য ও নাটক উভয় শ্রেণীর রচনারই উৎস-
” The ancient ballad poetry is the source both of the epic and drama. ”
শুধু তাই নয়, সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস জানার পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ সূক্ত গুলির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।