সংস্কৃত সাহিত্যে অশ্বঘোষের কাব্য গুলির পরিচয় দাও। অশ্বঘোষ রচিত বুদ্ধচরিত , বজ্রসূচী সারিপুত্তপ্রকরণ , সৌন্দরানন্দ । অশ্বঘোষ টীকা – বুদ্ধচরিত , সৌন্দরানন্দ , সারিপুত্তপ্রকরণ বজ্রসূচী সম্পর্কে আলোচনা। এছাড়া বুবুদ্ধচরিত এর রচয়িতা কে প্রভৃতি আলোচনা করা হল ।
অশ্বঘোষ টীকা
ভূমিকা –
সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাস পূর্বযুগের কবি ও নাট্যকার রূপে সর্বজন বিদিত ছিলেন অশ্বঘোষ। খৃষ্টীয় পঞ্চশতকে অশ্বঘোষ সম্পর্কে কিছু তথ্য চীনা ভাষায় রচিত।
‘ রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’-এর পরবর্তী যুগে মহারাজ কনিষ্কের সভাকবি পদ অলংকৃত করেছিলেন বৌদ্ধ কবি অশ্বঘোষ। বৌদ্ধযুগে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য অবহেলিত হয়েছিল, সংস্কৃতের চর্চা অবসাদগ্রস্ত হয়েছিল।
অশ্বঘোষের জীবনী –
অশ্বঘোষ ব্রাহ্মণ হলেও বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। তিনি কনিষ্কের রাজসভায় স্থান লাভ করেছিলেন। অশ্বঘোষের জন্মস্থান অযোধ্যা বা সাকেত। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি সাকেত নগরে থাকতে শুরু করেন।
আবির্ভাবকাল
কিংবদন্তি অনুযায়ী রাজা কনিষ্কের সমসাময়িক অর্থাৎ খৃষ্টীয় প্রথম শতক আবির্ভাব কাল। তাঁর সময়কার মোটামুটি খ্রিস্টীয় প্রথম শতক।
অশ্বঘোষের রচনাবলী
নিম্নে তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
রচনা | সর্গ / অঙ্ক / শ্লোক | বিষয়বস্তু |
---|---|---|
বুদ্ধচরিত | সতেরোটি (মতান্তরে ২৪ ) | ভগবান বুদ্ধের জীবনাদর্শ |
সৌন্দরানন্দ | আঠারোটি | বুদ্ধের জীবনী ও বুদ্ধের ভ্রাতা নন্দের বৌদ্ধধর্ম গ্রহন |
সারিপুত্তপ্রকরণ | সারিপুত্ত কিভাবে বুদ্ধের নিকট দিক্ষা গ্রহন করেন | |
গন্ডীস্তোত্রগাথা | 19টি শ্লোকে রচিত | |
বজ্রসূচী | ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রীয় প্রভৃতি বর্ণ ব্যবস্থার নিন্দা প্রচার |
সংস্কৃত সাহিত্যে অশ্বঘোষের কাব্য গুলির পরিচয়
কবি আবির্ভূত হয়ে ভগবান বুদ্ধের জীবন ধর্ম এবং কীর্ত্তিকে অবলম্বন করে লোকসংস্কৃতে দুখানি মহাকাব্য রচনা করেছিলেন।
i) বুদ্ধচরিত
ভগবান বুদ্ধের জীবনাদর্শ অবলম্বনে সতেরোটি সর্গে রচিত এই মহাকাব্যটি। সিদ্ধার্থ কীভাবে গৌতমবুদ্ধ তা এই কাব্যে মূল বিষয়বস্তু। তবে অনেকের মতো বুদ্ধ চরিত নাকি 24 টি সর্গে রচিত। বাকি সর্গ গুলি পাওয়া যায়নি।
বৌদ্ধ সাহিত্যের উজ্জ্বল অবদান এর মাধ্যম এই কবি সংস্কৃত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করলেন ১৭টি সর্গে। তথাগত ভগবান বুদ্ধদেবের জীবন এবং ধর্মাযর্শ অবলম্বন করে শান্ত রস প্রধান মহাকাব্য প্রণয়ন করলেন নাম বুদ্ধচরিতম্। হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নগরী, তার রাজা শুদ্ধোধন, প্রথম রাজকুমার সিদ্ধার্থ। রাজ্য ঐশ্বর্যের মধ্যেই তিনি পালিত হচ্ছেন, কুমার বয়সে তিনি পরম সুন্দরী যশোধরাকে বিবাহ করলেন। পুত্র রাহুল জন্ম নিল। কিন্তু রাজ্য ভোগে আসক্তি নেই। এমন সময় নগর ভ্রমণ করতে ইচ্ছা করলেন, ফলে পুরাঙ্গনা সুন্দরীরা সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখল কিন্তু তিনি নির্বিকার।
কুমার একে একে জরা, ব্যাধি এবং শবমাত্রা দেখলেন, ফলে মনে বৈরাগ্য সৃষ্টি হল, আর গৃহে ফিরলেন না। সংসার, স্ত্রী, পুত্র, পিতা সকলকে ত্যাগ করে তিনি সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করলেন। পিতা-পুত্রের বিরহে জ্ঞান হারালেন। জীবন যাপন যন্ত্রণাময়, তখন যন্ত্রণার সাথে তার সংগ্রাম বা দুশ্চর তপস্যা শুরু হল। পথের মার দানবদের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়েছিল। তুমুল যুদ্ধে তিনি দানবদের পরাস্ত করেছিলেন। তারপর তিনি জ্ঞানী গৌতম বুদ্ধ-এ রূপান্তরিত হয়ে ছিলেন।
কাব্যে পিতার বাৎসল্য, পত্নীর প্রেম, প্রমদাগনের অপূর্ব বিলাসকলা, মারদানবের প্রলোভন, সূর্যের শারদমেঘে আরোহন এবং অনেক প্রাকৃতিক বর্ণনা কাব্যকে মহোত্তম করেছে। প্রসাদগুণ আর বৈদর্ভী রীতি এবং প্রচুর ছন্দ, অর্থভূয়িষ্ট অলংকারগুলি কাব্যখানিকে মহাকবির চরম পরম পরাকাষ্ঠা রূপে স্বীকৃতি দান করে, এতে যেমন ইতিহাস আছে, তেমনি কাব্য আছে। রামচন্দ্রের মতো বুদ্ধ এখানে অবতার। যদিও চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসি বলেছেন যে এর ২৪টি সর্গ ছিল। চীনা ভাষাতে ১৭টি, তিব্বতী ভাষাতে ১৮টি সর্গ পাওয়া যায়। প্রথম ১৩ টি মূল, শেষ চারটি অমৃতানন্দের লিখিত।
ii) সৌন্দরানন্দ
অষ্টাদশ শতকে বিরচিত সৌন্দরানন্দ মহাকাব্যটি সম্ভবত অশ্বঘোষের প্রথম রচনা। বুদ্ধদেবের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নন্দ দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন বলে তার অপর নাম সুন্দর। তার স্ত্রীর নাম সুন্দরী। সম্ভবত তাদের নামানুসারেই মহাকাব্যটির নাম হয়েছে। প্রথম ৬টি সর্গে আছে কপিলাবস্তু নগরের বর্ণনা, বুদ্ধদেব ও নন্দের জন্মের বিবরণ,সুন্দরীর প্রতি নন্দেরা আসক্তি, নন্দের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুদ্ধদেবের দীক্ষাদান এবং ধর্মান্তরিত নন্দের জন্য সুন্দরীর আক্ষেপের বর্ণনা। বাকি প্রায় সমগ্র মহাকাব্যই বুদ্ধদেবের মূলনীতি এবং শিক্ষায় পরিপূর্ণ। কবি অপেক্ষা ধর্মপ্রচারক অশ্বঘোষের পরিচয়ই এইকাব্যে সমধিক। অবশ্য নন্দের প্রতি সুন্দরীর অনুরাগ এবং নন্দ কর্তৃক তাঁর পরিত্যাগের বর্ণনা পাঠকচিত্তকে বিগলিত করে।
এই মহাকাব্যটি অশ্বঘোষ এর প্রথম রচনা। এই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু বুদ্ধের জীবনীও বুদ্ধের ভ্রাতা নন্দের বৌদ্ধধর্ম গ্রহন। আঠারোটি সর্গে রচিত নন্দের সন্ন্যাসধর্মে দিক্ষা গ্রহন সেই অনুসারে এই কাব্যের নামকরন হয়েছে সৌন্দরানন্দ ।
iii) সারিপুত্তপ্রকরণ
এই দুটি মহাকাব্য ছাড়া অশ্বঘোষের লেখা বিনয়পিটকে বর্ণিত সারিপুত্র ও তার বন্ধু মৌদগল্যায়নের কাহিনী নিয়ে নয় অঙ্কে রচিত সারিপুত্রপ্রকরণ নামক রূপকটি প্রকরণ শ্রেণীর মহাকাব্য। এতে ক্ষত্রিয়ের নিকট দীক্ষা গ্রহণে বিদূষকের বাধা সত্ত্বেও বন্ধু মৌদগল্যায়নের সঙ্গে সারিপুত্রেরও বুদ্ধদেবের কাছে গিয়ে দুজনেই দীক্ষা নেওয়ার বর্ণনা আছে।
এটি একটি প্রকরন জাতীয় অঙ্কের দৃশ্যকাব্য। সারিপুত্ত কিভাবে বুদ্ধের নিকট দিক্ষা গ্রহন করেন। এটাই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু।
iv) গন্ডীস্তোত্রগাথা
গণ্ডীস্তোত্রগাথা মাত্র ২৯ টি শ্লোকে স্রগ্ধরা বৃত্তে রচিত কবিতা। গণ্ডী নামক বাদ্যযন্ত্রের শব্দের ধর্মগত ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া হয়েছে।
স্রগ্ধরা ছন্দে 19 টি শ্লোকে রচিত এই গীতিকাব্যটি।
v) বজ্রসূচী
এই গ্রন্থটি অশ্বঘোষের নামে চললেও অনেকে মনে করেন এটি ধর্মকীর্তি নামক অন্য এক কবির রচনা। এই ব্যাপারে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা মুশকিল।
ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রীয় প্রভৃতি বর্ণ ব্যবস্থার নিন্দা প্রচার এই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু।
সূত্রালঙ্কারঃ-
এটিও অশ্বঘোষের রচনা কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। অনেকের মতে এটি কুমার লাটের রচনা।
উপসংহার
অনেকের মতে, অশ্বঘোষ(Ashwaghosh )বৌদ্ধ ভিক্ষুক ছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধধর্ম প্রচার। তা হলেও তার কাব্য ও কবিত্বকে অস্বীকার যায়না।
পরিশেষে বলা যায় যে, কালিদাস পূর্ববর্তী যুগের সংস্কৃত সাহিত্যে সর্বাধিক প্রথিতযশা কবি হিসাবে বৌদ্ধ গ্রন্থকার অশ্বঘোষের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। অশ্বঘোষ ছিলেন একাধারে কবি ও দার্শনিক। কবির বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী।
বুদ্ধচরিত এর রচয়িতা হলেন অশ্বঘোষ। এই মহাকাব্যটি অশ্বঘোষ এর প্রথম রচনা।
বুদ্ধচরিত এর সর্গ সংখ্যা 24 । সংস্কৃত ভাষায় ১৭ টি সর্গ পাওয়া যায় ও চীনা ও তিব্বতী অনুবাদে এর ২৮টি সর্গ পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন অশ্বঘোষ সম্পর্কে ছোট প্রশ্ন গুলি
সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যান্য টীকা গুলি পড়ুন
- ১. (টীকা) অশ্ব ঘোষ
- ২. (টীকা) রাজতরঙ্গিনী
- ৩. হরিবংশ পুরাণ
- ৪. ভট্টি কাব্য বা রাবণবধ মহাকাব্য
- ৫. হিতোপদেশ
- ৬. (টীকা) কুমারসম্ভবম্
- ৭. (টীকা) স্বপ্নবাসবদত্তা
- ৮. (টীকা) গীতা
- ৯. (টীকা) জানকীহরণ
- ১০. জয়দেবের গীতগোবিন্দ
- ১১. হরিবংশম্
- ১২. (টীকা) রঘুবংশ মহাকাব্য
- ১৩. (টীকা) বিক্রমোর্বশীয়ম্ নাটক