শর্ট (ভারতীয় দর্শন) ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
ভারতীয় দর্শন হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
১) চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বা প্রবর্তক কে? এর মতে জ্ঞানের উৎস কি?
উ:- চার্বাক দর্শনের প্রবর্তক কে তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে দেবগুরু বৃহস্পতিকে চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন অজিতকেশ কম্বলী বা কম্বলাশ্বতব চার্বাক দর্শনের প্রবর্তক।
এদের মতে কেবলমাত্র প্রত্যক্ষই যথার্থ জ্ঞানের উৎস বা প্রমাণ রূপ বিচার পদ্ধতি।
২ ) চার্বাক মতে অপবর্গ কি?
উ:- চার্বাক মতে মৃত্যুই অপবর্গ। -“মরণমেবাপবর্গঃ”। আত্মার কোন সত্ত্বা না থাকায় তার বন্ধন বা মুক্তির প্রশ্নই অবান্তর।
৩) চার্বাক মতে পুরুষার্থ কি?
উ:- চার্বাক মতে, ‘কাম এব পুরুষার্থঃ’- কাম চরিতার্থ করাই একমাত্র পুরুষার্থ। অবশ্য পরবর্তীকালে সুশিক্ষিত চার্বাকেরা কামের সঙ্গে অর্থকে সংযুক্ত করে বলেছেন-” অর্থকামৌ পুরুষার্থৌ”।
৪) চার্বাকেরা অনুমান স্বীকার করেন না কেন?
উ:- অনুমান প্রত্যক্ষ নির্ভর। অনুমান করতে হলে যে ব্যাপ্তি জ্ঞানের প্রয়োজন অর্থাৎ কার্য ও কারণের নিয়ত সাহচর্য জ্ঞান, তা কখনও সম্ভব হয় না। যেমন- ধূম ও বহ্নির সাহচর্য জ্ঞান মহানসাদিতে হলেও সকল ধূম ও বহ্নির সার্বিক প্রত্যক্ষ অসম্ভব বলে অনুমান স্বীকার করা যায় না।
৫) জৈন দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে?
উ:- জৈন দর্শন বহু প্রাচীন হওয়ায় এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা নাম পাওয়া যায়না। প্রাপ্ত জৈন দর্শনের প্রচারক রূপে মহাবীর বা বর্ধমানের নাম করতে হয়। ঋষভদেব থেকে মহাবীর পর্যন্ত মোট ২৪ জন তীর্থঙ্করকে জৈন ধর্মের প্রবর্তক বা প্রচারক বলা হয়।
৬) চার্বাক মতে বেদের রচয়িতা কারা?
উ:- চার্বাক মতে, -” ত্রয়োবেদস্য কর্ত্তারো ভন্ড ধূর্ত নিশাচরাঃ” অর্থাৎ বেদের রচয়িতা ভন্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোক।
৭) জৈন দর্শনের নয় কাকে বলে? কয় প্রকার ও কি কি?
উ:- বস্তুর অনন্ত ধর্মের মধ্যে একটি বিশেষ ধর্ম বা গুণের আংশিক জ্ঞানকে জৈন দর্শনে নয় বলা হয়। একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে নয়টি সত্য।
জৈন দর্শনে সাতটি নয় স্বীকার করা হয়েছে। যথা- i) স্যাৎ অস্তি, ii) স্যাৎ নাস্তি, iii) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ, iv) স্যাৎ অব্যক্তম্, v) স্যাৎ অস্তি চ অব্যক্তম্, vi) স্যাৎ নাস্তি চ অব্যক্তম্, vii) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অব্যক্তম্।
৮) জৈন মতে, জীব ও অজীব কয় প্রকার ও কি কি?
উ:- জৈন মতে জীব দুই প্রকার। যথা- মুক্ত ও বদ্ধ। জৈন মতে অজীব চার প্রকার। যথা- i) ধর্ম ii) অধর্ম iii) আকাশ iv) পুদগল বা জড়।
৯) জৈন মতে, পুদগল বলতে কী বোঝ?
উ:- জৈন দর্শনে জড়কে পুদগল বলা হয়। যে দ্রব্যকে যুক্ত বা বিযুক্ত করা যায় তাই পুদগল নামে অভিহিত। পুদগলের দুটি অবস্থা। i) অনু ও ii) সংঘাত। কোন দ্রব্যকে ভাঙতে ভাঙতে যখন এমন পর্যায়ে আনা হয় যে আর তাকে ভাঙা যায় না সেই অবস্থার নাম অনু। একাধিক অনু মিলে যে সংঘাত বা স্কন্দ সৃষ্টি হয় তাই জগৎ।
১০) বৌদ্ধ দর্শন প্রধানত কয় ভাগে বিভক্ত ও কি কি?
উ:- বৌদ্ধ দর্শন সম্প্রদায় প্রধানত দু প্রকার। যথা- i) হীনযান ও ii) মহাযান। কালক্রমে হীনযান আবার দুভাগে বিভক্ত হয়। যথা- সৌক্রান্তিক ও বৈভাষিক। মহাযান পন্থীরাও দু’ভাগে বিভক্ত। যথা – মাধ্যমিক ও যোগাচার।
১১) জৈন দর্শনে ত্রিরত্ন কি?
উ:- সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান এবং সম্যক চরিত্রকে জৈন দর্শনে মানব জীবনের ত্রিরত্ন বলা হয়। সম্যকদর্শন, সম্যক জ্ঞান এবং সম্যক চরিত্র মোক্ষ লাভের পথ। মুক্তি এই ত্রিরত্নের যুগ্ম ফল।
১২) বৌদ্ধ দর্শনের কোন কোন দার্শনিক তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়?
উ:- বৌদ্ধ দর্শনে চারটি দার্শনিক তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। যথাক্রমে তাদের নাম – i) প্রতীত্যসমুৎপাদ ii) কর্মবাদ ও iii) অনিত্যবাদ iv) নৈরাত্মবাদ।
১৩) পঞ্চস্কন্দ বিশ্লেষণ কর।
উ:- বৌদ্ধ মতে, পঞ্চস্কন্দ হল-
i) রূপস্কন্দ- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ দ্বারা নির্মিত দেহ।
ii) বেদনাস্কন্দ- সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অনুভূতি।
iii) সংজ্ঞাস্কন্দ- প্রত্যক্ষ ইত্যাদি জ্ঞান।
iv) সংস্কারস্কন্দ- মানসিক আবেদন বা প্রমেতা।
v) বিজ্ঞানস্কন্দ- চেতনা বা বিচার বুদ্ধি।
বৌদ্ধমতে পঞ্চস্কন্দের সমষ্টির অতিরিক্ত স্থায়ী নিত্য আত্মা বলে কিছু থাকতে পারে না।
১৪) অনিত্যবাদের মূল কথা কি?
উ:- ‘ সর্বম্ অনিত্যম্’ – অর্থাৎ সবকিছুই অনিত্য। জগতে কোন কিছুর স্থায়িত্ব নেই। উৎপত্তি থাকলেই তার ধ্বংস থাকবে। জগৎ বিরামহীন পরিবর্তনের প্রবাহ। জীবনের প্রতি মুহূর্তই পরিবর্তনশীল। এক এক ক্ষণে বিদায় নিচ্ছে নতুন আর এক ক্ষণে আবির্ভাব ঘটেছে। এটাই অনিত্যবাদের মূল বক্তব্য।
১৫) থেরাবাদ কি?
উ:- বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে হীনযানদের মতবাদই থেরাবাদ নামে পরিচিত। এই মতবাদ ত্রিপিটককে প্রামান্য বলে স্বীকার করেন। হীনযানদের মতই আদি বৌদ্ধমত। এই মতবাদ প্রাচীনপন্থী। হীনযানরা বুদ্ধের নৈতিক নিয়মগুলিকে কঠোরভাবে অনুশীলনের পক্ষপাতী। এই মতবাদকে স্থবিরবাদও বলা হয়ে থাকে।
১৬) ত্রিশরণ কী?
উ:- বূদ্ধদেব প্রদর্শিত মার্গে যথাবিহিত নিষ্ঠার সঙ্গে চলার জন্য বৌদ্ধ সাধকগণ ত্রিশরণ অবলম্বন করেন। এই ত্রিশরন গুলি হল-
” বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
ধম্মং শরনং গচ্ছামি।
সঙ্খং শরণং গচ্ছামি।”
১৭) পিটক শব্দের অর্থ কী?
উ:- পিটক শব্দের অর্থ হল পেটিকা বা ঝাঁপি। বৌদ্ধ দর্শনে পিটক শব্দের অর্থ পালি ভাষায় লিখিত বৌদ্ধ গ্রন্থ। গ্রন্থগুলিতে বৌদ্ধ বানী লিপিবদ্ধ হয়েছে। এগুলি সংখ্যায় তিনটি। যথা- i) বিনয় পিটক, ii) সূত্তপিটক ও iii) অভিধর্ম পিটক।
১৮) নির্বানের প্রকৃতি কি?
উ:- এ বিষয়ে মত পার্থক্য আছে। নির্বানের প্রকৃতি গুলি হল- নির্বান হল পূর্ণ বিলুপ্তি।
নির্বান হল আনন্দ ময় অবস্থা।
নির্বান হল এক অচিন্তনীয় ভাবাত্মক অবস্থা।
১৯) অষ্টাঙ্গিক মার্গ কি?
উ:- নির্বান লাভের জন্য বুদ্ধদেব নির্দেশিত আটটি পথকে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়েছে। এই মার্গগুলি হল- i) সম্যক্ দৃষ্টি, ii) সম্যক্ সংকল্প, iii) সম্যক্ বাক্, iv) সম্যক্ কর্মান্ত,v) সম্যক্ আজীব, vi) সম্যক্ ব্যায়াম্, vii) সম্যক্ স্মৃতি, viii) সম্যক্ সমাধি।
২০) ব্যাপ্তি কী?
উ:- ব্যাপ্তি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল – ব্যাপকতা। ব্যাপ্য (হেতু) ও ব্যাপকের (সাধ্যের ) সম্বন্ধকে ব্যাপ্যকতা বলে। যদি ব্যাপকতা সম্বন্ধটি নিয়ত ও অব্যভিচারী হয় বা উপাধিমুক্ত হয়, তবে ঐ সম্বন্ধকে ব্যাপ্তি বলে।
২১) সামান্য কয় প্রকার ও কী কী?
উ:- সামান্য তিন প্রকার। যথা- পর, অপর ও পরাপর সামান্য। যেমন- ঘটত্ব হল অপর সামান্য, সত্ত্বা হল পর সামান্য এবং দ্রব্যত্ব হল পরাপরসামান্য। এটি সত্ত্বা থেকে কম ব্যাপক কিন্তু ঘটত্ব থেকে অধিক ব্যাপক।
২২) বিশেষের লক্ষণ কি?
উ:- ‘ নিত্য দ্রব্যবৃত্তিবিশেষঃ’ অংশহীন নিত্য দ্রব্যগুলির মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ বলে। বিশেষ নিত্য কারণ নিত্য দ্রব্যে বিশেষের অবস্থান বিশেষের জন্য একটি নিত্য দ্রব্যকে অপর অংশহীন দ্রব্য থেকে পৃথক করা যায়। বিশেষ অতীন্দ্রিয় বস্তু।
২৩) শংকরাচার্য বিবর্ত বলতে কি বুজিয়েছেন?
উ:- শঙ্করাচার্যের মতে জীব ও জগত ব্রহ্মের বিবর্তমাত্র। বিবর্ত শব্দের অর্থ কারণে মিথ্যা কার্যের প্রতীতি। অর্থাৎ কারণ থেকে কোন কার্য সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ভুল করে আমরা কার্য সৃষ্টি দেখাই। যেমন দড়িকে সাপ মনে করা। এখানে দড়ির কারণই কেবল সত্য।
২৪) প্রাতিভাষিক সত্তা কি?
উ:- শংকর তিনস্তরের সত্তা স্বীকার করেছেন। প্রাতিভাসিক সত্তা হল তার মধ্যে অন্যতম। যা ক্ষণকালের জন্য প্রত্যক্ষ হয় এবং সংসারাবস্থারই অপর ব্যবহারিক প্রত্যক্ষ দ্বারা বাধিত হয় তা প্রাতিভাসিক সত্তা। যেমন- রজ্জুতে সর্প দর্শন বা স্বপ্নদৃষ্ট বস্তু।
২৫) দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র কী?
উ:- বৌদ্ধ দর্শনের দুঃখের যে কার্যকারণ শৃংখলের উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দ্বাদশ নিদান আছে। এই দ্বাদশ নিদান ভবচক্র নামে পরিচিত। এই দ্বাদশ নিদান হল যথাক্রমে – অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরুপ,ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জন্ম ও জরামরন ইত্যাদি।
২৬) বৈশেষিক দর্শনের স্বীকৃত বিভিন্ন প্রকারের গুণ উল্লেখ করো।
উ:- বৈশেষিক মতে গুণ ২৪ প্রকার। যথা রূপ,রস,গন্ধ,স্পর্শ, শব্দ, সংখ্যা,পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা,দ্বেষ,প্রযত্ন, গুরুত্ব, দ্রব্যত্ব, স্নেহ, সংস্কার, ধর্ম ও অধর্ম।
২৭) যোগ শব্দের অর্থ কী?
উ:- চিত্তবৃত্তি নিরোধের নাম যোগ অর্থাৎ চিত্তের যে পাঁচটি ভূমি আছে সেইসব ভূমিতে চিত্তের ধর্ম বা বৃত্তি নিরোধকে যোগ বলা হয়।
২৮) চিত্তবৃত্তি কী?
উ:- চিত্তবৃত্তি হল চিত্তের বিষয়াকার প্রাপ্তি। অবিবেকবশত বাহ্য বিষয়ের সঙ্গে চিত্তের সংযোগ হলে চিত্তের বিকার বা পরিণাম ঘটে। চিত্তের এইসব পরিণামের নামই বৃত্তি বা চিত্তবৃত্তি।
২৯) অদ্বৈতবাদ বলতে কী বোঝ?
উ:- যে মতবাদে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, ব্রহ্মভিন্ন সবকিছুই মিথ্যা, অর্থাৎ যে মতবাদে ব্রহ্ম ভিন্ন দ্বিতীয় সত্তা স্বীকার করা হয়না, তাকে অদ্বৈতবাদ বলে।
৩০) ন্যায় সূত্র ও বৈশেষিক সূত্রের প্রণেতা কারা?
উ:- ন্যায় সূত্রের প্রণেতা হলেন মহর্ষি গৌতম এবং বৈশেষিক সূত্রের প্রণেতা হলেন মহর্ষি কণাদ।
৩১) বিশিষ্ট্যাদ্বৈতবাদে সংখ্যাতিবাদ কি?
উ:- বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে সংখ্যাতিবাদ হল ভ্রমের বস্তু ও সৎ বস্তু। ভ্রম সম্পর্কে রামানুজের মতবাদকে সংখ্যাতিবাদ বলে। এই মতবাদ অনুসারে যা সৎবস্তু তাই জ্ঞানের বিষয় হয়।
৩২) ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে? এই দর্শনের কয়েকটি গ্রন্থের নাম কর।
উ:- ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম।
এই দর্শনের কয়েকটি গ্রন্থ হল গৌতমের ন্যায় সূত্র। পরবর্তীকালে ন্যায় দর্শনের উপর অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বাৎসায়নের ন্যায়ভাষ্য, বাচস্পতির ন্যায়বর্তিকা, উদয়নের ন্যায়কুসুমাঞ্জলি, জয়ন্ত ভট্টের ন্যায়মঞ্জুরি ইত্যাদি।
৩৩) শূন্যবাদ কাদের অভিমত? এই মতবাদের দুজন প্রবক্তার নাম লেখ?
উ:- শূন্যবাদ বৌদ্ধ দার্শনিকদের অভিমত। এই মতবাদের দুজন প্রবক্তা হলেন নাগার্জুন, অশ্বঘোষ।এছাড়াও শান্তিদেব, আর্যদেব প্রমূখ।
৩৪) সাংখ্য দর্শনের মূল তত্ত্ব কি?
উ:- সাংখ্য দর্শনের দুটি মূল তত্ত্ব। যথা -প্রকৃতি ও পুরুষ। এটি দ্বৈতবাদী দর্শন। এই দর্শনে কার্যকারণবাদ স্বীকার করা হয়। একে সৎকার্যবাদ বলা হয়েছে। সৎকার্যবাদ অনুসারে উৎপত্তির পূর্বে কার্যকারণের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। প্রকৃতির জড়, পুরুষ চৈতন্যময়। সব জড় পদার্থ তিনগুণের – সত্ত্ব রজঃ ও তম সমন্বয়ে গঠিত। এই দর্শনের ঈশ্বর স্বীকার করা হয়নি কিন্তু এটি আস্তিক দর্শন।
৩৫) হীনযান সম্প্রদায়ের দুটি মতবাদ কি কি?
উ:- i) বাহ্য বস্তুর জ্ঞান আতিরিক্ত সত্তা আছে কিনা এবং ii) বাহ্য বস্তু কে জানার উপায় কি।
৩৬) সাংখ্য দর্শন অনুসারে পুরুষের বৈশিষ্ট্য কি?
উ:- সাংখ্য দর্শনে পুরুষ দ্বিতীয় তত্ত্ব। পুরুষ ও আত্মা অভিন্ন। পুরুষ চৈতন্য স্বরূপ বা জ্ঞান স্বরূপ। পুরুষ দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও জড় থেকে ভিন্ন। পুরুষ নির্বিকার, নির্গুণ,ভোক্তা ও সাক্ষী বা দ্রষ্টা। পুরুষ মহোমুক্ত, উদাসীন, অকর্তা এই হল সাংখ্য দর্শনে পুরুষের বৈশিষ্ট্য।
৩৭) কোন দর্শনে কয়টি করে প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে?
উ:- i)চার্বাক দর্শনের একটি মাত্র প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। সেটি হল প্রত্যক্ষ।
ii) জৈন দর্শনে তিনটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ প্রমাণ।
iii) ন্যায় দর্শনে চারটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমান,উপমান ও শব্দ।
iv) বৈশেষিক দর্শনে দুটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। যথা – প্রত্যক্ষ, অনুমান।
v) সাংখ্য দর্শনে তিনটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। যথা – প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ।
vi) যোগ দর্শনে তিনটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। যথা- প্রত্যক্ষ,অনুমান ও আগম।
vii) মীমাংসা দর্শনে পাঁচটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। যথা – প্রত্যক্ষ, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি।
৩৮) আস্তিক দর্শন কিয়া সুদর্শন এর একটি উদাহরণ দাও।
or, আস্তিক দর্শন বলতে কী বোঝায়?
উ:- আস্তিক বলতে আমরা সাধারণত বুঝি যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী। আস্তিক বলতে বোঝায় তাদের যারা বেদের কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য স্বীকার করে এবং বেদের সিদ্ধান্তকে প্রামান্য ও অভ্রান্ত বলে গ্রহণ করে। অর্থাৎ কোন দর্শন যদি বেদে বিশ্বাসী হয় তাকে আস্তিক দর্শন বলা হয়।
আস্তিক দর্শন সম্প্রদায়গুলির হল- আর ন্যায় দর্শন, বৈশেষিক দর্শন, যোগ দর্শন, সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন ও বেদান্ত দর্শন।
৩৯) ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতাদের নাম কি কি?
উ:- ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঋষি কনাদ।
৪০) প্রমা ও প্রমাণের মধ্যে পার্থক্য গুলি কি কি?
উ:- প্রমা হল বিষয়ের অসন্দিগ্ধ ও যথার্থ অনুভব -” যথার্থনুভবঃ প্রমা।” বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান হলো যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা। আচার্য্য অন্নংভট্ট বলেছেন- “তদ্বতি তৎপ্রকারকোঅনুভবো যথার্থঃ। সৈব প্রমেত্যুচ্যতে।।” অর্থাৎ যেটি যে ধর্মের বিশিষ্ট পদার্থ যদি সেই পদার্থে সেরূপই জ্ঞান হয়, তবে তাকে যথার্থ অনুভব বলে। এরূপ যথার্থ অনুভবকে প্রমা বলে।
অপরপক্ষে যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালীকে প্রমাণ বলে। প্রমাণ হলে প্রমার করণ অর্থাৎ যার মাধ্যমে যথার্থ অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়-“প্রমা করণং প্রমানম্।”
৪১) ন্যায় দর্শনের ব্যাপ্তি কি?
or, ন্যায় দর্শনের ব্যাপ্তি বলতে কি বোঝায়?
উ:- ন্যায় দর্শনে ব্যাপ্তি হল হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সাহচর্য জ্ঞান। যেখানে হেতু থাকে সেখানে সাধ্য অবশ্যই থাকে। ন্যায় মতে, ব্যাপ্তি জ্ঞান অনুমানের ভিত্তি স্বরূপ। নৈয়ায়িক তর্কসংগ্রহকার আচার্য অন্নংভট্ট বলেছেন- ” যত্র যত্র ধূমস্তত্র তত্রাগ্নিরিতি সাহচর্যনিয়মো ব্যাপ্তিঃ। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ধূম আছে সেখানে অগ্নি আছে।ধূমের সঙ্গে বহ্নির একত্র থাকায় সাহচর্য্য নিয়ম ব্যাপ্তি। গঙ্গেশ উপাধ্যায় বলেছেন-” ব্যাপ্তিস্তু সাধ্যাভাবৎ অবৃত্তিত্বং প্রকীর্তিতম্”। অর্থাৎ যেখানে সাধ্যের অভাব আছে সেখানে হেতুর অবৃত্তিত্বই ব্যাপ্তি।
৪২) ন্যায় দর্শনের পরামর্শ কাকে বলা হয়েছে? অথবা ন্যায় মতে পরামর্শ বলতে কী বোঝো?
উ:- ন্যায় দর্শনে ব্যাপ্তি বিশিষ্ট পক্ষধর্মতা জ্ঞানকে পরামর্শ জ্ঞান বলা হয়েছে-
” ব্যাপ্তিবিশিষ্ট পক্ষধর্মতা জ্ঞানং পরামর্শ।” যথা – ” বহ্নিব্যাপ্য ধূমবান্ অয়ং পর্বতঃ অর্থাৎ বহ্নি ব্যাপ্তি বিশিষ্ট ধূমবান্ এই পর্বত এই জ্ঞানই পরামর্শ জ্ঞান। ন্যায় মতে পরামর্শের জন্য অনুমিতি জ্ঞান হয়- “পরামর্শজন্যং জ্ঞানং অনুমিতি।”
৪৩) বৈশেষিক মতে, পদার্থ কয়প্রকার ও কী কী?
উ:- বৈশেষিক মতে, পদার্থ দুই প্রকার। যথা ভাব পদার্থ ও অভাব পদার্থ।
ভাব পদার্থ আবার ছয় প্রকার। দ্রব্য, গুন, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়।
৪৪) বিশেষের সংজ্ঞা দাও।
উ:- “বিশেষয়তি ইতরেভ্যঃ ব্যাবত্তয়তি ইতি বিশেষ”। অর্থাৎ যে ধর্মটি কোন বস্তুকে অন্যান্য ধর্ম থেকে পৃথকরূপে বুঝিয়ে দেয়। এটি বৈশেষিক স্বীকৃত সপ্ত পদার্থের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ। যেটি নিত্য ও নিত্য দ্রব্য মাত্রে বর্তমান অথচ গুন ভিন্ন পদার্থ। তাই এটি বিশেষ।
৪৫) ন্যায় দর্শন সম্মত বিভিন্ন প্রকারের লৌকিক সন্নিকর্ষ লিখ।
উ:- ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের সমন্বয়কে সন্নিকর্ষ বলে। এই সন্নিকর্ষ লৌকিক ও অলৌকিক ভেদে দুই প্রকার। লৌকিক সন্নিকর্ষ আবার ছয় প্রকার। যথা- সংযোগ সন্নিকর্ষ, সংযোগ সমবায় সন্নিকর্ষ, সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ, সমবায় সন্নিকর্ষ, সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ, বিশেষণ বিশেষ্য ভাব সন্নিকর্ষ।
৪৬) ন্যায় দর্শন স্বীকৃত প্রমাণ গুলির নাম লেখ।
উ:- ন্যায় দর্শনে যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালীকে প্রমাণ বলে। ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। যথা- প্রত্যক্ষ প্রমাণ, অনুমান প্রমাণ, উপমার প্রমাণ এবং শব্দ প্রমাণ।
৪৭) বৈশেষিক দর্শনে কতগুলি দ্রব্য স্বীকৃত? ক্রমানুসারে তাদের নাম লেখ।
উ:- বৈশেষিক দর্শনে ‘নব দ্রব্যানি’ অর্থাৎ নয় টি দ্রব্য স্বীকার করা হয়েছে। এই নয়টি দ্রব্য হল – পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল,দিক, আত্মা ও মন।
বৈশেষিকরা এই নয়টি দ্রব্যের সাহায্যে সমগ্র জগৎ এর ব্যাখ্যা করেছেন।
৪৮) যুতসিদ্ধ শব্দের অর্থ কী?
উ:- যে সকল দ্রব্য সংযোগ সম্বন্ধ বিশিষ্ট হয় অথবা যে দ্রব্য ব্যতীতও থাকতে পারে তাদের যুতসিদ্ধ বলে। যেমন – হাত হাত মোবাইল ফোন। বৃক্ষ বৃক্ষপ্রাণী।
৪৯) ন্যায় মতে হেত্বাভাস কী?
উ:- যা ‘হেতুবদ্ আভাসন্তে’- অর্থাৎ যা হেতু নঢ়, কিন্তু হেতু মনে হয়, তাকে হেত্বাভাস বলে। যেসব পদার্থ হেতু নয়, কিন্তু হেতুর সঙ্গে সাদৃশ্য বশতঃ হেতু বলে ভ্রম হয়, হেত্বাভাস বলতে এমন দুষ্টু হেতুকে বোঝায়। ন্যায় দর্শনে ব্যভিচার ইত্যাদি হেতুর দোষকেও হেত্বাভাস বলে। অনেক ক্ষেত্রে হেতুর সমস্ত না থাকার জন্য তা প্রকৃত হেতু হতে পারে না। এই প্রকার হেতুর দোষও হেত্বাভাস।
৫০) ন্যায় দর্শন সম্মত হেত্বাভাস গুলির নাম লিখ।
উ:- ন্যায় মতে হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার। যথা- i)সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস,
ii) বিরুদ্ধ হেত্বাভাস,
iii) সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস,
iv) অসিদ্ধ হেত্বাভাস,
v)বাধিত হেত্বাভাস।
হেত্বাভাসের প্রকারভেদ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- “সব্যভিচার – বিরুদ্ধসৎপ্রতিপক্ষাঅসিদ্ধবাধিতাঃ পঞ্চ হেত্বাভাসাঃ।”
৫১) ন্যায় দর্শনে পঞ্চাবয়বী ন্যায় কি?
উ:- পরার্থানুমানের ক্ষেত্রে পঞ্চাবয়বী ন্যায় প্রয়োগ করা হয়েছে। পঞ্চ অবয়বী ন্যায়ের পাঁচটি অবয়ব হল-
i) প্রতিজ্ঞা- পর্বতোবহ্নিমান্।
ii) হেতু- ধূমত্বাৎ।
iii) উদাহরণ-যো যো ধূমবান্ স স বহ্নিমান্ যথা মহানসম্।
iv) উপনয়- তথা চায়ম্।
v) নিগমন- তস্মাত্তথেতি।
এরূপ পঞ্চবয়বী ন্যায়বাক্য প্রয়োগের পর অনুমিত প্রমাণিত হয়- ‘ পর্বতো বহ্নিমান্’ – পর্বতে আগুন আছে।
৫২) বৈশেষিক দর্শন সম্মত অভাবের বিভিন্ন বিভাগ গুলি কি কি?
উ:- বৈশেষিক দর্শনে অভাবকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা সংসর্গাভাব ও অন্যোন্যাভাব।
সংসর্গাভাব আবার তিন প্রকার। যথা- প্রাগভাব, ধংসাভাব ও অত্যন্তাভাব।
অভাবের বিভাগ প্রসঙ্গে শ্রীমৎ অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেছেন-
” অভাবশ্চতুর্বিধ- প্রাগভাবঃ প্রধ্বংসাভাবোঅত্যন্তাভাবোঅন্যোন্যাভাবশ্চেতি” অর্থাৎ অভাব চার প্রকার। যথা প্রাগভাব, প্রধ্বংসভাব, অত্যন্তাভাব ও অন্যোন্যাভাব।
৫৩) তর্কসংগ্রহানুসারে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা দাও।
উ:- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দভেদে প্রমাণ চতুর্বিধ। প্রত্যক্ষই প্রথম প্রমাণ।
‘ প্রত্যক্ষজ্ঞানকরণং প্রত্যক্ষম্ ‘ অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের করণকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে। আচার্য অন্নংভট্ট প্রত্যক্ষের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-” ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্যং জ্ঞানং প্রত্যক্ষম্।” অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষ রূপ সম্বন্ধ থেকে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলে।
৫৪) ‘ভূতলে ঘট নাই’ – এক্ষেত্রে যে অভাব পরিলক্ষিত হয় তার নাম লেখ।
উ:- ‘ভূতলে ঘট নাই’ বললে ভূতলটি ঘটাভাববিশিষ্ট রূপে অভাবের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। এক্ষেত্রেও অভাবটি প্রাগভাবের অন্তর্গত।
৫৫) সাংখ্য মতে, গুন কী?
উ:- সাংখ্য মতে প্রকৃতির ত্রিগুণাত্মিকা। সুতরাং জগত কারণ প্রকৃতির উপাদান হল গুনত্রয়। এই ত্রিগুণের সাম্যবস্থার নাম প্রকৃতি এবং বিষম্যাবস্থার নাম সৃষ্টি। ত্রিবিধগুন পৃথক স্বভাব বিশিষ্ট। সত্ত্বগুণ লঘু এবং প্রকাশক। রজঃ গুণ গতি এবং সঞ্চারনের কারণ ও তমঃ গুণ সত্ত্ব ও রজের প্রতিবন্ধক।
৫৬) যোগ দর্শনে অষ্টাঙ্গিক মার্গ কি কি?
উ:- চিত্তবৃত্তিনিরোধরূপ যোগ লাভের জন্য যোগ দর্শন অষ্টবিধ সাধন বা উপায় অনুশীলনের উপদেশ দিয়েছেন। এগুলি হল- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়ম, প্রত্যাহার, ধারনা, ধ্যান, সমাধি।
৫৭) যোগ দর্শনে যোগ কথার অর্থ কি?
উ:- যোগ কথার সাধারণ অর্থ হলো যুক্ত হওয়া। তাই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ যোগ নামে অভিহিত। কিন্তু যোগ দর্শনে সংযোগ অর্থে যোগ শব্দের প্রয়োগ হয়নি। ব্যাস ভাষ্য অনুসারে যোগ কথার অর্থ সমাধি।-“যোগঃ সমাধিঃ।” পাণিনী বলেছেন- ” যুজ্ সমাধৌ।” যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন জীবাত্মা ও পরমাত্মার সংযোগই যোগ। কিন্তু পতঞ্জলি তার যোগ সূত্র গ্রন্থের যোগের লক্ষণ দিয়েছেন -” যোগঃ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ”। অর্থাৎ চিত্তবৃত্তি সমূহের নিরোধই যোগ।
৫৮) শঙ্করের বেদান্তকে কেবলাদ্বৈত বলে কেন?
উ:- শঙ্করের মতে জগতের পারমার্থিক সত্ত্বা এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছুর কোন অস্তিত্ব নেই। তাই শঙ্করের বেদান্তকে কেবলাদ্বৈত বলা হয়।
৫৯) বেদান্ত মতে, বেদান্ত শব্দের অর্থ কী?
উ:- বেদান্ত দর্শন ভারতীয় আস্তিক দর্শন সমূহের অন্যতম। মাধ্বাচার্য বেদান্ত দর্শনকে ‘সর্বদর্শনশিরোমণি’ আখ্যা দিয়েছেন। বেদান্ত দর্শন উপনিষদকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে বেদান্ত শব্দের অর্থ হল- বেদের অন্ত বা অবশেষ। প্রতিটি বেদ চার ভাগে বিভক্ত- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সুতরাং বেদের অন্তিম অংশ বলতে উপনিষদকে বোঝায়। সুতরাং এদিক থেকে উপনিষদ দর্শন বা উপনিষদ ভিত্তিক দর্শন যথার্থই বেদান্ত দর্শনের অধিকারী।
৬০) ন্যায় দর্শনে আত্মাকে কেন বিভু বলা হয়?
উ:- ন্যায় দর্শনে আত্মা হল নিত্য দ্রব্য। আত্মার উৎপত্তি নেই । শরীর অনিত্য। শরীরে বিনাশ আত্মা বিশিষ্ট হয়-” নঅন্যতে অন্যমানে শরীরে।” আত্মা বিভু বা সর্বব্যাপী। আত্মার কোন অবান্তর মহত্ব বা সীমিত পরিসর নেই। কারন যা সীমিত তাই অংশযুক্ত এবং যা কিছু অংশযুক্ত তাই বিনাশশীল। আত্মার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই।
৬১) বৈশেষিক দর্শনে অভাব বলিতে কী বোঝ?
উ:- নিয়ত পদার্থবাদী বৈশেষিক সম্প্রদায় সম্মত সপ্তম পদার্থ হল অভাব। বৈশেষিক দর্শনে অভাব হল পদার্থ। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। অতএব, ভাব ভিন্ন পদার্থের ‘টেবিলে কলমটি আছে’ এইরূপ যেমন ভাব বস্তুর অভাব তেমনি ‘টেবিলে ঘটটি নেই’ এইরূপ আমাদের অভাবের জ্ঞানহ্ময়। রঘুনাথ শিরোমি বলেছেন- “ইদম্ ইহ ন, ইদম্ ইদম্ ন ভবতি ” প্রভৃতি নঞ্ আদি শব্দের দ্বারা নিষেধ বোধক জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় অভাব।
৬২) জৈন দর্শনে স্যাৎ শব্দটির অর্থ কী?
উ:- জৈন দর্শন স্বীকৃত স্যাৎ পদটি অস্ত্যর্থক অস্ ধাতু নিষ্পন্ন। যার অর্থ হতে পারে। জৈন মতে একটি দ্রব্যের মধ্যে অসংখ্য গুন সন্নিবিষ্ট থাকে। যার কয়েকটি মাত্র জ্ঞাত হয়। তাই বস্তুটির গুনগুলি উল্লেখ করার আগে স্যাৎ পদটি উল্লেখ করলে বস্তুটির আংশিক গুন যে জ্ঞানের বিষয় তা জানা যায়।
৬৩) বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ কোনটি? ঐ গ্রন্থের রচয়িতা কে?
উ:- বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র। ব্রহ্মসূত্রের রচয়িতা হলেন মহর্ষি বাদরায়ণ।
৬৪) চার্বাকদের জড়বাদী বলা হয় কেন?
উ:- ভারতীয় দর্শনে জড়বাদী দর্শন বলতে আমারা চার্বাক দর্শনকেই বুঝে থাকি। চার্বাক দর্শনে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায় এই ভূতচতুষ্টয় হতে জগতের উৎপত্তি ব্যাখ্যাত হওয়ায় চার্বাককে জড়বাদী দার্শনিক সম্প্রদায় বলে। অতএব, চার্বাক দেহাতিরিক্ত কোনো চৈতন্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
৬৫) প্রতীত্যসমুৎপাদ কথাটির অর্থ কী?
উ:- প্রতীত্যসমুৎপাদ এর প্রতীত্য কথার অর্থ হল- যা কেন কিছুর অধীন এবং সমুৎপাদ এর অর্থ হল আবির্ভাব বা উৎপত্তি হওয়া। সুতরাং প্রতীত্যসমুৎপাদ এর অর্থ হল কোনো কিছুকে অবলম্বন করে কোনো কিছুর উৎপত্তি। প্রতীত্যসমুৎপাদ মতে, যে কোনো কার্য কারণের উপর নির্ভর করে উৎপন্ন হয় বলে একে ‘কার্যকারণতত্ত্ব’ও বলা হয়।
৬৬) কারণ ব্রহ্ম বলতে কী বোঝায়?
উ:- বৃহদার্থক বৃহ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ব্রহ্ম শব্দের অর্থ সর্ববৃহৎ। এই ব্রহ্ম মায়া বিশিষ্ট হয়ে সমগ্র জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ হন। মায়াশক্তির প্রভাবে ব্রহ্ম হতে স্থূল জগতের উৎপত্তি হওয়ায় তাকে কারণ ব্রহ্ম বলা হয়।
৬৭) বৈশেষিক মতে, বিশেষের কোন জাতি থাকে না কেন?
উ:- বৈশেষিক মতে নিত্যদ্রব্যের ভেদক ধর্মকে বিশেষ বলে। নিত্যদ্রব্যসমূহের পারস্পরিক ভেদের জন্য বিশেষ স্বীকৃত হলেও বিশেষগুলির পারস্পরিক ভেদের জন্য অন্য বিশেষ স্বীকারের প্রয়োজন নাই। একমাত্র বিশেষই ভেদক। তাই বহুর মধ্যে একের প্রতীতির জন্য যে সামান্য বা জাতি স্বীকার করা হয়, বিশেষের ক্ষেত্রে সেই সামান্য বা জাতি স্বীকার করা হয় না।
৬৮) চারটি আর্যসত্য কি কি?
উ:- আধ্যাত্মিক সাধনালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বুদ্ধদেব চারটি মহান সত্য লাভ করেন। বৌদ্ধ দর্শনে এই চারটি সত্য আর্যসত্য নামে পরিচিত।
চারটি আর্যসত্য হল-
i) দুঃখ আছে।
ii) দুঃখের কারণ আছে।
iii) দুঃখের নিরোধ আছে।
iv) দুঃখ নিরোধের উপায় আছে।
৬৯) পঞ্চমহাব্রত কি কি?
উ:- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ এই পাঁচটি হল জৈন নীতিশাস্ত্রসম্মত পঞ্চব্রত যা মুক্তিকামী প্রত্যেক ব্যাক্তির অবশ্য পালনীয়। মঠবাসী সন্ন্যাসীদের ক্ষেত্রে এই পাঁচটি ব্রত কঠোর ভাবে পালনীয় হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে এই পাঁচটি ব্রত হল পঞ্চমহাব্রত। পঞ্চমহাব্রত গুলি – অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ।
জৈনগন সম্যক চারিত্র লাভের দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। যথা – দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর। দিগম্বরগণ চরণপন্থী এবং শ্বেতাম্বরগণ উদারপন্থী।
৭০) সাংখ্য মতে, পুরুষের অস্তিত্বের সাধক হেতুগুলি কি কি?
উ:- সাংখ্যকারিকায় ঈশ্বরকৃষ্ণ পুরুষ বা আত্মার অস্তিত্বসাধক পাঁচটি হেতু প্রদর্শন করেছেন। যথা- i) সংঘাত।
ii) ত্রিগুণাদি বিপর্যয়।
iii) অধিষ্ঠান।
iv) ভক্তিভাব
v) কৈবল্যের জন্য প্রবৃত্তি।
৭১) মীমাংসকদের স্বীকৃত প্রমাণগুলির নাম লিখ?
উ:- প্রাচীন মীমাংসকেরা এবং বেদে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ এই তিনটিকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু প্রভাকর মিশ্রের মতে, প্রমাণ পাঁচ প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান,উপমান, শব্দ এবং অর্থাপত্তি। কিন্তু কুমারিল ভট্টের মতে, প্রমাণ ছয় প্রকার। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ, অর্থাপত্তি এবং অনুপলব্ধি।
৭২) শঙ্করের দর্শনকে অদ্বৈতবাদ বলা হয় কেন?
উ:- অদ্বৈতবাদীরা নির্গুন ব্রহ্ম বা শুদ্ধ চৈতন্যকে একমাত্র সত্যরূপে, জগৎকে মিত্যারূপে এবং জীবাত্মাকে পরমাত্মারূপে এবং জ্ঞানকে মুক্তির উপায় রূপে গ্রহণ করেন। তাই শঙ্করাচার্যের কথায়- ” ব্রহ্মসত্যংজগন্মিথ্যাজীবো ব্রহ্মৈব না পরঃ।” আচার্য শঙ্করের পূর্বে অনেকে অদ্বৈতবাদ প্রচার করলেও এই মতবাদ শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। শঙ্করাচার্যই অদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবর্তক ও প্রচারক। এজন্য শঙ্করের দর্শনকে বা তার মতবাদকেই অদ্বৈতবাদ বলা হয়।
৭৩) দর্শন কথার অর্থ কী?
উ:- ইংরেজী ফিলসফি শব্দটির প্রতিশব্দরূপে দর্শন শব্দটির ব্যবহার হয়। ব্যুৎপত্তির দিক থেকে ফিলসফি শব্দের অর্থ জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ, আর দর্শন শব্দের অর্থ সত্য দর্শন। জ্ঞানার্থক দৃশ্ ধাতুর উত্তর করণ বাচ্যে ল্যুট্ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন দর্শন পদটির অর্থ হল যার দ্বারা যথার্থ জ্ঞান লাভ করা হয়।
৭৪) ভারতীয় দর্শন কয়টি ভাগে বিভক্ত এবং কী কী?
উ:- ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ক) আস্তিক ও নাস্তিক। আস্তিক দর্শন গুলির মধ্যে ছয়টি দর্শন প্রধান। যথা- সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত। এই ছয়টি ষড়দর্শন নামে প্রসিদ্ধ। নাস্তিক দর্শনের মধ্যে প্রসিদ্ধ হল – চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন।
৭৫) চার্বাক দর্শনের অপর নাম কি এবং কেন?
উ:- চার্বাক দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন।
চার্বাক মতে, ইহলোকই একমাত্র অস্তিত্বশীল। পরলোক বলে কিছু নাই। তাই সর্বদর্শন সংগ্রহে মাধবাচার্য বলেছেন- ” তস্য চার্বাকমতস্য লোকায়তমিত্যন্বর্থমপরনামধেয়ম্’ চার্বাকেরা বৈদিক যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সন্দেহমূলক কথাবার্তাও ভাবধারা প্রকাশ করতেন। সাধারণ মানুষ ইন্দ্রিয়সুখকে এবং ইন্দ্র সুখের সহায়করূপে অর্থকেই পুরুষার্থ মনে করেন এবং পারলৌকিক সবকিছুকে অস্বীকার করেন।তাই সাধারণ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় বলে এই মতবাদকে লোকায়ত দর্শন বলা হয়।
৭৬) পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা বলতে কী বোঝ?
উ:- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্ – বেদের এই চারটি পর্যায় স্বীকার করা হয়। এদের মধ্যে সংহিতা ও ব্রাহ্মণকে বলা হয় কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক উপনিষদকে বলা হয় জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে বৈদিক ক্রিয়াকর্মের স্বরূপ ও কর্ম বিষয়ক বেদবাক্য সমূহের তাৎপর্য বিবৃত হয়েছে। জ্ঞানকাণ্ডে আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি এবং জ্ঞান বিষয়ক বাক্য সমূহের অর্থ বিবৃত হয়েছে। বেদের কর্মকাণ্ডকে পূর্ব মীমাংসা বলা হয়। মহর্ষি জৈমিনি পূর্ব মীমাংসার সূত্র কার। অপরদিকে বেদের জ্ঞানকাণ্ডকে উত্তর মীমাংসা বলা হয়। মহর্ষি বাদরায়ন উত্তরমীমাংসা বা বেদান্তের সূত্র কার। পুর্ব মীমাংসাকে জৈমিণীকৃত মীমাংসা দর্শন বলা হয় এবং উত্তর মীমাংসাকে বেদান্ত দর্শন বলা হয়।
৭৭) বেদান্ত দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি?
উ:- বেদান্ত দর্শনের মূল আলোচ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হল-” ব্রহ্মসত্যং জগন্মিথ্যা জীবব্রহ্মৈবনাপরঃ”। অর্থাৎ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম বা জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন।
ভারতীয় দর্শন হতে অন্য পোস্ট গুলি
- ভারতীয় দর্শন: শূণ্যবাদ
- ভারতীয় দর্শন: অধ্যাস
- ভারতীয় দর্শন: পরার্থানুমান
- ভারতীয় দর্শন: সমাধি
- ভারতীয় দর্শন: বৌদ্ধদের ক্ষণিকবাদ
- ভারতীয় দর্শন: প্রতীত্যসমুৎপাদতত্ত্ব
- ভারতীয় দর্শন: নৈরাত্মবাদ বা অনাত্মবাদ
- ভারতীয় দর্শন: মায়া
- ভারতীয় দর্শন: ত্রিপিটক
- ভারতীয় দর্শন: পঞ্চীকরণ
- ভারতীয় দর্শন: সপ্তভঙ্গীনয়
- ভারতীয় দর্শন: জৈন দর্শন অনুসরণে স্যাদবাদ
- ভারতীয় দর্শন: বুদ্ধদেবের চতুর্থ আর্যসত্য
- ভারতীয় দর্শন: চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা – চার্বাক মতবাদের ব্যাখ্যা ও গ্রহণযোগ্যতা
- ভারতীয় দর্শন: যোগ দর্শনের পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তি ব্যাখ্যা
- ভারতীয় দর্শন: ছোট প্রশ্ন ও উত্তর