ভারতীয় দর্শন: বুদ্ধদেবের চতুর্থ আর্যসত‍্য

বুদ্ধদেবের চতুর্থ আর্যসত‍্য ব‍্যাখ‍্যা কর।

বুদ্ধদেবের চতুর্থ আর্যসত‍্য ব‍্যাখ‍্যা

উ:- ভারতীয় দর্শনে বিশেষত বৌদ্ধ দর্শনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তথা সমস্ত প্রাণীর ঐক্য সাধনে পথপ্রদর্শক হলেন বুদ্ধদেব তিনি ছিলেন জীবনবাদী দার্শনিক জগতের সমস্ত বিষয় পরিদর্শন করে দেখলেন অজস্র মানুষের দুঃখ এই দুঃখের হাত থেকে কিভাবে মানুষ পরিত্রান পেতে পারে জগতে সৃষ্টিতত্ত্বের যেসব প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়ে কাল নষ্ট না করে তিনি দুঃখ জরজর মানুষকে মুক্তির উপায় বলে দিয়েছিলেন এমনকি মানুষ যাতে হিংসা-বিদ্বেষ এড়িয়ে পৃথিবীতে শান্তি পায় তাই তার ধর্মনীতির উদ্দেশ্য।
বুদ্ধদেব তখনকার যুগে সামাজিক ধর্ম নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা দেখে উপনিষদের অনেক প্রচ্ছন্ন কথা নতুন আকারে ব্যক্ত করেছিলেন সাধনা শীর্ষে গিয়ে বুদ্ধদের চারটি আর্য সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন চারটি আর্যসত্য হল-

  • ক) জগৎ দুঃখময় (দুঃখ)
  • খ) দুঃখের কারণ আছে ( দুঃখ সমুদয়)
  • গ) দুঃখের নিবৃত্তি আছে (দুঃখ নিরোধ)
  • ঘ) দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে (দুঃখ নিরোধমার্গ)।

ক) বুদ্ধদেবের আর্যসত‍্য – জগৎ দুঃখময়

ভগবান বুদ্ধের মতে জীবন দুঃখময়-‘সর্বং দুঃখম্’ – সবই দুঃখময়।

“দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন
তবুও আশার নেশা ছুটিল না একি দায়।।”

এ সংসারে দুঃখ ছাড়া কিছু নেই। জরাব‍্যাধি শোক তাপে দুঃখ, জনমে দুঃখে, আকাঙ্ক্ষায়, উৎকণ্ঠায়, হতাশায় দুঃখ, প্রিয়জনের বিচ্ছেদে দুঃখ, অপ্রিয়র সাথে সংযোগে দুঃখ, ক্লেশে দুঃখ।

জীবন দুঃখময় বলে ভারতীয় দার্শনিকরা বাস্তববাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন কাঁটা আছে মনে রেখে যদি কেউ সযত্নে মাছটুকু বেছে খায় তাহলে তার মধ‍্যে খাদ‍্যসুখ লাভ করে। আবার কেউ যদি মনে করে মাছে কাঁটা নেই এইভাবে সবটুকু খেয়ে ফেলে তাহলে সে খাদ্য সুখের পরিবর্তে দুঃখভোগ লাভ করে। যে সুখ হাতছানি দেয় তা আলেয়া, আলেয়ার পিছনে ছুটে দুঃখের মরুতে মাথা খুঁড়ে লাভ কি?

যৎ অনিত‍্যং তৎ দুঃখম্’।

যা অনিত‍্য তা দুঃখে ভরা। তাই যে সুখের মাঝে দুঃখ জড়িয়ে রয়েছে, তা হল আপাত সুখ। অর্থাৎ সংসার দুঃখে ভরা।

খ) বুদ্ধদেবের আর্যসত‍্য -দুঃখের কারণ আছে :-

দ্বিতীয় আর্যসত‍্যে বুদ্ধদেব দুঃখের কারণ বা হেতু নির্দেশ করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় আর্যসত‍্যটি প্রতীত‍্য সমুৎবাদ বা কার্যকারণ সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত।
এই নিয়ম অনুযায়ী ও পৃথিবীতে যে কোন ঘটনার পিছনেই কোন না কোন কারণ আছে। কারণ, ছাড়া কোনো কার্য ঘটতে পারে না। সকল কিছুর অস্তিত্বই শর্তের অধীন। কোন কিছুই শর্তহীন নয়। সেরূপ দুঃখেরও কারণ আছে। অকারণে দুঃখ ঘটতে পারে না।

বুদ্ধদেব বলেছেন জাতি বা জন্ম হল জ্বরা, মরণ প্রভৃতি দুঃখের কারণ। মানুষ সংসারে জন্মেছে বলেই তার এত দুঃখ এত কষ্ট। যদি সে জন্ম না নিত তাহলে তাকে এত দুঃখ ভোগ করতে হত না। জন্মই তাই সকল দুঃখের কারণ। অবিদ‍্যা থেকে জন্ম নেয় সংস্কার, সংস্কার থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান থেকে নামরুপ,নামরূপ থেকে ষড়ায়তন, ষড়ায়তন থেকে স্পর্শ, স্পর্শ থেকে বেদনা, বেদনা থেকে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা থেকে উপাদান, উপাদান থেকে ভব, ভব থেকে জন্ম, জন্ম থেকে জরামরাণ। কার্যকারণ শৃঙ্খলা এই বারোটি নিদানকে বলা হয়। দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র। এই দ্বাদশ নিদানই মানুষকে বারবার সংসারে চাকার মতো ঘোড়ায় জন্ম, দুঃখভোগ ও পূর্বজন্মের মধ্য দিয়ে।

গ) বুদ্ধদেবের আর্যসত‍্য – দুঃখের নিবৃত্তি আছে :-

বুদ্ধদেবের তৃতীয় আর্যসত্যটি হলো দুঃখ নিরোধ। দুঃখের যেসব কারণ আছে সেই কারণগুলি দূর করলেই দুঃখ নিরোধ সম্ভব দুঃখ নিবৃত্তিই হল নির্বান।
এই পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয় তা অনিত‍্য। যার উৎপত্তি আছে তার বিনাশ আছে। নৈয়ায়িকরাও বলেন- “যৎ কৃতকং তদ্ নিত‍্যম্।” বৌদ্ধমতে অবিদ্যাই হল সমস্ত দুঃখের মূল কারণ। অবিদ‍্যার বিনাশ হলেই পরম্পরাক্রমে জ্বরামরণাদি দুঃখের নিরোধ সম্ভব। দুঃখের আত‍্যন্তিক নিবৃত্তিই হল নির্বাণ। নির্বাণ প্রাপ্ত হন যিনি তিনি পূজনীয়।
নির্বাণ লাভের পর সকল মানুষের কল্যাণে বুদ্ধদেব নিরলস কর্মসাধনা চালিয়ে যান। তিনি মনে করেন নির্বাণ লাভের পর মুক্ত লাভের পর মুক্ত ব্যক্তির দুঃখতাপে জর্জর সাধারণ মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদন করা উচিত।

ঘ) বুদ্ধদেবের আর্যসত‍্য -দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে:-

বৌদ্ধ দর্শনের চতুর্থ আর্য সত্য হল দুঃখ নিরোধ মার্গ। যে পথ ধরে নির্বাণ লাভ করা যায় বা দুঃখ থেকে চির মুক্তি পাওয়া যায় তাই হলো বুদ্ধদেবের চতুর্থ আর্য সত্য। এই পথের নাম অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই পথেই হল প্রকৃত পথ। যেখানে ভোগ বিলাসীতা নেই, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কৃচ্ছসাধন নেই। এই পথে রয়েছে করুন, মৈত্রী, সদাচার, একাগ্রতা ও সংযোগের চিহ্ন। এই আটটি পথ হল-

  • i) সম্যক দৃষ্টি,
  • ii) সম্যক সংকল্প,
  • iii) সম্যক বাক্,
  • iv) সম্যক কর্মান্ত,
  • v) সম্যক আজীব,
  • vi) সম্যক ব‍্যায়াম,
  • vii) সম‍্যক স্মৃতি,
  • viii) সম‍্যক সমাধি।

i) সম‍্যক দৃষ্টি:-

এই দৃষ্টি যথার্থ জ্ঞানকে সূচিত করে। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মিথ‍্যা দৃষ্টি হল দুঃখের মূল কারণ। মিথ‍্যা দৃষ্টির পরিবর্তন অনস্বীকার্য।

ii) সম‍্যক সংকল্প:-

এই সংকল্প ছাড়া মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না। এই জন্য সম‍্যক দৃষ্টির পাশাপাশি সম্যক সংকল্প জরুরি। এর দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলা হয়েছে-
” না লোভিয়া বোধিজ্ঞান দুর্লভ জগতে
না দেহ মোর এ আসন হতে।”

iii) সম‍্যক বাক্:-

সম্যক সংকল্পের জন্য চাই সম্যক বাক্ সংযম। সত্য গোপন, মিথ্যাভাষণ, পরনিন্দা, কটুবাক‍্য, প্রভৃতি থেকে বিবৃত হতে পারে। উপনিষদে বলা হয়েছে- “মণো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্।”

iv) সম‍্যক কর্মান্ত:-

সংযতভাবে আচরণ করাকে সম‍্যক কর্মান্ত মন্ত্র বলা হয়। লোভ,লালসা,বাসনা, পরিত‍্যাগ করা প্রয়োজন।

v) সম‍্যক আজীব:-

সম‍্যক উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করাকে বলা হয় সম্যক আজীব।

vi) সম‍্যক ব‍্যায়াম:-

সৎ চিন্তা অনুশীলন করাকে বলা হয় সমূহ ব্যায়াম। কুচিন্তা দূর করা, কুচিন্তা উৎপত্তি হতে না দেওয়া এবং সুচিন্তার অনুশীলন করা প্রভৃতি ব‍্যায়ামে মনকে শুদ্ধ রাখা প্রয়োজন।

vii) সম‍্যক স্মৃতি:-

নির্বাণ সাধনাকারী ব্যক্তিকে সর্বদাই স্মরণ রাখা প্রয়োজন। দেহ, মন, জাগতিক বস্তু সবই অনিত‍্য এবং অস্থায়ী।

Viii) সম‍্যক সমাধি:-

কোন ব্যক্তি যখন তার আচরণকে সংযত করে, অসৎ চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে, তখন ঐ ব্যক্তি সমাধির উপযুক্ত ব্যক্তি বলে পরিগণিত হয়। ওই ব্যক্তি নির্বাণ লাভ করে। নির্বাণ লাভ ঘটলে আর পুর্নজন্ম ঘটে না।

সুতরাং মুক্তি লাভের অন্যতম উপায় হিসেবে চতুর্থ আর্যসত‍্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

ভারতীয় দর্শন হতে অন্য পোস্ট গুলি

Comments