ভারতীয় দর্শন: যোগ দর্শনের পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তি ব‍্যাখ‍্যা

ভারতীয় আধ‍্যাত্মদর্শন যোগ দর্শনের বিভিন্ন পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তি ব‍্যাখ‍্যা কর।

যোগ দর্শনের পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তি ব‍্যাখ‍্যা কর।

উ:- ভারতীয় আধ‍্যাত্মদর্শন যোগ দর্শনের প্রভাব অপরিসীম। মহর্ষি পতঞ্জলি এই দর্শনের প্রণেতা। পতঞ্জলির নামানুসারে এই দর্শনকে পাতঞ্জল দর্শনও বলা হয়। মহর্ষি বেদব্যাস রচিত যোগভাষ‍্য পতঞ্জল সূত্রেরই  সুন্দর ও সংক্ষিপ্ত ভাষ্য। প্রাচীন ভারতে সাংখ‍্য ও যোগ এই দুটি ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের নাম প্রায় সব অর্থে ব্যবহৃত হয়। মহাভারত ও গীতাতে এই দুই সম্প্রদায় এক বলেই বর্ণনা করা হয়েছে।  গীতায় বলা হয়েছে-

” ‍যৎ সাংখ‍্যৈঃ প্রাপ‍্যতে স্থানং তদ্  যোগৈরপিগম‍্যতে।
এবং সাংখ‍্যঞ্চ যোগঞ্চ যঃ পশ‍্যতি স পশ‍্যতি।।”

            √যুজ্+ঘঞ্=যোগ। যুজ্ ধাতু থেকে যোগ শব্দ নিষ্পন্ন হলেও যোগদর্শনে যোগ দর্শনে অর্থ সংযোগ নয়। ধাতুর অর্থ বহুপ্রকার হতে পারে-‘ধাতুনামণেকার্মত্বাৎ’। পতঞ্জলি স্বয়ং যোগ শব্দের অর্থ করেছে- ‘ যোগঃ সমাধিঃ।’

         মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে চিত্তবৃত্তি সমূহের নিরোধই হল যোগ- ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।’ সাংখ‍্য যোগদর্শনে বুদ্ধি, অহংকার ও মন এই তিনটি অন্তঃকরণকেই চিত্ত বলা হয়। চিত্ত প্রকৃতির প্রথম পরিণাম,এতে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য থাকে। চিত্ত স্বরূপত অচেতন হলেও সত্ত্বের প্রাবল‍্য হেতু পুরুষের খুবই সন্নিকটে থাকে।  ফলে পুরুষের চৈতন্য এতে প্রতিবিম্বিত হয় এবং তখন অচেতন-চিত্ত চেতনায়মান অর্থাৎ চেতনের মতো মনে হয়। যখন চিত্ত ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুর আকার ধারণ করে। এরই নাম চিত্তবৃত্তি। চিত্তবৃত্তির মাধ‍্যমেই বস্তুজ্ঞান হয়। চলমান তরঙ্গে প্রতিবিম্বিত চন্দ্রকে যেমন গতিশীল মনে হয় তেমন অপরিণামী পুরুষের কোন বিকার বা পরিবর্তন না থাকলেও চিত্তবৃত্তিতে প্রতিফলনের ফলে পুরুষ বা আত্মাকে চিত্তবৃত্তির মতই পরিবর্তনশীল মনে হয়।

যোগ দর্শনে পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তির উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- প্রমাণ, বিপর্যয়, বিকল্প, নিদ্রা ও স্মৃতি –

‘প্রমাণ বিপর্যয় বিকল্প নিদ্রা স্মৃতয়ঃ।’

যোগ দর্শনের পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তির ব্যাখ্যা নিম্নে আলোচনা  করা হলো-

i) প্রমাণ:-

প্রমাণ হচ্ছে যথার্যজ্ঞান ও বৃত্তি। যোগ মতে, প্রমাণ তিন প্রকার। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ বা আগম। – ‘ প্রত‍্যক্ষানুমানাগমাঃ প্রমাণানি ‘ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ‍্যবস্তুর সংযোগজনিত চিত্তের যে বৃত্তি তাই প্রত‍্যক্ষ জ্ঞান বা প্রত‍্যক্ষবৃত্তি। এই প্রত‍্যক্ষবৃত্তি আবার দুই প্রকার হতে পারে। যথা- বাহ‍্য ও আন্তর প্রত‍্যক্ষ। দুষ্ট বস্তুর (হেতুর) সাহায‍্যে অদুষ্ট বস্তুর (সাধ‍্যের ) যে জ্ঞান বা বৃত্তি, তা হল অনুমানবৃত্তি। যেমন- ধূম দেখে বহ্নি সম্পর্কে জ্ঞান। আপ্তব‍্যক্তি অর্থাৎ যথার্থ বক্তার বাক‍্য শুনে শ্রোতার চিত্তে উৎপন্ন হয় তাই হল শব্দ জ্ঞান।

ii) বিপর্যয় :-

বিপর্যয় হল সংশয় ও ভ্রান্তজ্ঞান দুই-ই। পতঞ্জলি বলেছেন- ‘বিপর্যয়ো মিথ‍্যাজ্ঞানমতদ্রূপপ্রতিষ্ঠম্।’ বিপর্যয়ই  হচ্ছে ভ্রান্ত জ্ঞান, কিন্তু জ্ঞানের অভাব নয়। চিত্ত বিষয়ের অনুরূপ না হয়ে যদি ভিন্ন রূপ হয় তাহলে তা ভ্রান্তজ্ঞান বা বিপর্যয়। রজ্জুতে সর্পজ্ঞান হচ্ছে ভ্রান্ত জ্ঞান বা মিথ্যাজ্ঞান। রজ্জুর স্থলে চিত্ত রজ্জুর জ্ঞান বা মিথ‍্যাজ্ঞান। রজ্জুর স্থলে চিত্ত রজ্জুর আকার গ্রহণ না  করে সর্পের আকার গ্রহণ করে বলে ‘রজ্জুতে সর্পজ্ঞান’ মিথ্যাজ্ঞান। সংশয় বিপর্যয়ের অন্তর্গত।

iii) বিকল্প:-

তৃতীয় প্রকার চিত্তবৃত্তি হল বিকল্প। পতঞ্জলি বলেছেন- ‘শব্দজ্ঞানানুপাতী বস্তুশূন‍্যো বিকল্পঃ।’ অর্থাৎ এমন অনেক বাস্তব অস্তিত্ব বিহীন শব্দ আছে। যা শুনলে একপ্রকার জ্ঞানবৃত্তি চিত্তে উৎপন্ন হয়, তারই নাম বিকল্প বৃত্তি। ঐরূপ বিকল্পবৃত্তির দ্বারা ব‍্যবহারও চলতে থাকে। যেমন – পুরুষের চৈতন্য। এক্ষেত্রে পুরুষও চৈতন্য ভিন্ন বলে মনে হয়। অথচ পুরুষ ও চৈতন্য অভিন্ন।  ‘পুরুষের চৈতন্য’, ‘শশশৃঙ্গ’ ইত্যাদি প্রয়োগে ভ্রমজ্ঞানের মত বাধিত হয়না। আবার বস্তুশূন্য হওয়ায় বিকল্প প্রমাণের অন্তর্গত নয়।

iv) নিদ্রা:

– চতুর্থ চিত্তবৃত্তি নিদ্রা। সুষুপ্তিকালীন অজ্ঞতা বা তমোগুণকে বিষয় করে যে বৃত্তি হয় তার নাম নিদ্রাবৃত্তি- ‘ অভাব প্রত‍্যয়ালম্বনাবৃত্তিঃ নিদ্রা।’ সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠে আমারা বলি – গাঢ় ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ায় কিছুই জানতে পারিনি, এভাবে আমাদের সুষুপ্তিকালীন অজ্ঞতার স্মরণ হয়। বাস্তবে সুষুপ্তিকালে যদি চিত্তের কোন বৃত্তি না হতো, তবে জাগরণে তার স্মরণ হতো না। অতএব, সুষুপ্তিকালে যে বৃত্তিটি ছিল তার নাম নিদ্রাবৃত্তি।

v) স্মৃতি:-

পঞ্চম চিত্তবৃত্তি হল স্মৃতি। ‘অনুভূত বিষয় অসম্প্রমোষঃ স্মৃতিঃ’ অর্থাৎ কোন বিষয় অনুভূত হলে যে সংস্কার উৎপন্ন হয়,  তজ্জনিত জ্ঞানকে স্মৃতি বলে।
        যত প্রকার চিত্তবৃত্তি হতে পারে সবই উক্ত পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তির অন্তর্গত। চিত্ত যখন কোন আবৃত্তি দিয়ে রূপান্তরিত হয় তখন আত্মার চৈতন‍্য তাতে প্রতিবিম্বিত হয়। এবং ঐ প্রতিফলিত চিত্তবৃত্তিকে তখন আত্মা নিজেরই বিকার বলে মনে করে। যতদিন চিত্তবৃত্তি থাকবে ততদিন আত্ম চৈতন্য তাতে প্রতিবিম্বিত হবে এবং বিবেক জ্ঞানের অভাবে চিত্তবৃত্তিকেই আত্মবৃত্তি মনে হবে। ফলে আত্মার নানাবিধ দুঃখভোগ অবশ্যম্ভাবী। এরই নাম বন্ধন। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে চিত্তবৃত্তির নিরোধ হওয়া চাই। চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ হলে আর আত্মার প্রতিফলন হবে না।

ভারতীয় দর্শন হতে অন্য পোস্ট গুলি

Comments