বানভট্টের রচনাশৈলী সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। , বাণোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – পাঠ্যাংশ অনুসারে ব্যাখ্যা কর। বাণী বাণো বভূব- পাঠ্যাংশের আলোকে ব্যাখ্যা কর। বাণস্তু পঞ্চাননঃ- ব্যাখ্যা কর। গদ্যকবি হিসাবে বাণভট্টের রচনাশৈলী ও সাহিত্যগত প্রতিভা আলোচনা কর।
বানভট্টের রচনাশৈলী সংক্ষিপ্ত পরিচয় / গদ্যকবি হিসাবে বাণভট্টের রচনাশৈলী ও সাহিত্যগত প্রতিভা, বাণোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – পাঠ্যাংশ অনুসারে ব্যাখ্যা কর, বাণী বাণো বভূব পাঠ্যাংশের আলোকে ব্যাখ্যা কর, বাণস্তু পঞ্চাননঃ- ব্যাখ্যা কর।
বাণী বাণো বভূব – বানভট্টের রচনাশৈলী
ভূমিকা:- সংস্কৃত গদ্যসাহিত্য সাম্রাজ্যের অন্যতম অদৃশ্য হলেন বানভট্ট । কবিত্বশক্তি পরিমাপের অন্যতম কষ্টিপাথর হল গদ্য রচনা। বানভট্ট সে দিক থেকে সফল। কল্পিত বৃত্তান্ত অবলম্বনে রচিত ‘কাদম্বরী ‘ এবং ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘হর্ষচরিতম্‘- এই দুই গদ্যকাব্য বানভট্টকে সাফল্য এনে দিয়েছে। প্রমাণ হয়েছে নিসর্গ প্রতিভাধর কবিরা নিয়মের দাসত্ব না করে অবাধ বিচার করেন।
আর পাঠকচিত্ত নিরন্তর অধ্যয়নের মাধ্যমে রসাবধারন করত, আহার গ্রহণের কথাও ভুলে যান। ফলে পাঠকচিত্ত ব্রহ্মানন্দীর মতো লব্ধানন্দী হয়ে জগদানন্দে মেতে ওঠেন। মনোরম বর্ণ, পদবিন্যাস, রস ও ভাবের আড়ম্বরে সজ্জিত বাণভট্টের বানী পাঠক তরুন-তরুনীর মন হরণ করে। কবি ধর্ভদাসসূরী তাই বলেছেন –
” রুচিরস্বরবর্ণপদা রসভাববতী জগন্মনোহরতি।
তৎ কিং তরুনী, নহি নহি বাণী বাণস্য মধুরশীলস্য।।”
বানভট্টের রচনাশৈলী সম্পর্কে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমালোচকদের মত
শুধুমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতজ্ঞরাই নন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমালোচকগণ বানভট্টের রচনাশৈলীর অকৃপণ প্রশংসা করেছেন। অর্থগৌরবাপন্ন ও সুললিত পদবিন্যাস পাঞ্চালি নীতির মূল কথা, তা বানভট্টের রচনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ফলে ভারতীয় সাহিত্য মীমাংসকদের দ্বারা তিনি প্রশংসিত হয়েছেন-
“শব্দার্থয়োঃ সমো গুম্ফো পাঞ্চালীরীতিরিষ্যতে।
শীলাভট্টারিকাবাচি বাণোক্তিষু চ সা যদি।।”
বাণভট্টের রচনায় রীতিসমূহ
বানভট্টের রচনায় আমরা দেখি বৈদর্ভী, গৌড়ীয় পাঞ্চালী, লাটী, আবন্তী প্রভৃতি রীতিকে পাথেয় করে রচনা শুরু করলেও কোনো একটা রীতিকে প্রকটভাবে প্রতিপাদন করেননি।বরং ঐ সমস্ত রীতির আলের নিজস্ব রীতিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
পন্ডিতরা বলেন-
“অতিরেকেন পাঞ্চালীরীতিঃ অন্যপি রীতয়োঅল্পাধিকভাবেন পরিলক্ষ্যতে।।”
কাদম্বরী কথাকাব্যের ভয়ঙ্কর বিন্ধ্যাটবীর বর্ণনায় দেখি-” প্রেতাধিপনগরী যদা সন্নিহিত মৃত্যু ভীষণা মহিষাধিষ্টিতা চ”- এক অসাধারণ কবি প্রতিভার নিদর্শন। এছাড়া রয়েছে উজ্জয়িনীর জাঁকজমকপূর্ণ বর্ণনা। গৌড়ীয় রীতির নিদর্শন পাই মৃত্যুপথযাত্রী মহারাজ প্রভাকর বর্ধনের বর্ণনায়- ” আসন্নযমদর্শনোস্বেগাদিব চ কিঞ্চিদন্তঃ প্রবিষ্টতারকং চক্ষুর্দধান। শ্রিযং শাপ ইতি, মহীং মহাপাতকম্ ইতি, রাজ্যং রোভা ইতি, ‘ন রূপমালোকরতে, ন শীলহ পশ্যতি…..’ ইত্যাদি সংলাপোচিত কথোপকথনাদিতে বৈদর্ভী রীতির জ্বলন্ত উদাহরণ আমরা পাই।
বানভট্টের রচনায় গুনসমূহ:-
সমাস বাহুল্য ও জোগুন হল গদ্যকাব্যের প্রাণ।
কাব্যদর্শকার তাই বলেছেন-
‘ওজঃ সমাসভূয়স্ত্বম্ এতদ্ গদ্যস্য জীবিতম্।’
বানভট্টের রচনায় সমাসবহুল এরকম পদবিন্যাস আমরা পাই। তবে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট পদবিন্যাস বাক্যবিন্যাসের চমৎকারিতাকে ফুটিয়ে তোলে। বানভট্টের রচনায় মাধুর্য গুণের বাহুল্য আছে। তবে প্রসাদগুণ মোটেই বিরল নয়- বহুলোচন মাধুর্যং গুনঃ প্রসাদগুনোঅপি ন বিরলঃ। অথবা পূর্বাপরজলনিধিবেলালগ্না বনকারিকুলমদজলসেবকসংবর্ধিতেঃ রতিবিকচধবলকুসুমানকরমত্যুচ্চতয়া…..’ ইত্যাদি বর্ণনায় তা স্পষ্ট।
বানভট্টের রচনায় রসসমূহ:-
শৃঙ্গার, রৌদ্র, ভয়ানক, বীভৎস এবং করুণরস সন্নিবেশনে বানভট্ট ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কাদম্বরী কথাকাব্যে মহাশ্বেতার বিরল বেদনা চিত্রনে অনবদ্য বিপ্রলম্ভশৃঙ্গার রস পরিবেশন করেছেন।
মৃত্যু পথযাত্রী পিতাকে দেখে হর্ষের শোকবিহ্বলতা রচনার সভ্যতাকে প্রমাণ করে-
“হা নাথ! জীবিতনিবন্ধন! আচক্ষ্বা, ক্ব মামেকাকিনী মশবননামকরণবিমুচ্যযাসি।'(কাদম্বরী)
” অকান্ডে খল্বয়ং সমুপস্থিতো মহাপ্রলয়ো ব্যপ্র ইব বজ্রপাতঃ।
সুতরাং, বলতেই হবে – “( হর্ষচরিতম্)….
রসভরেন সমস্ত এব মত্তো ন কিঞ্চিদপি চেতয়তে জানোঅয়ম্।”
চরিত্রচিত্রনে নৈপুণ্য:-
বানভট্টের রচনা চরিত্র-চিত্রন তাঁর একটি মহৎ কৃতিত্বের স্বাক্ষর। কাদম্বরী-তে চন্দ্রাপীড়, কাদম্বরী, শুকনাস, মহাশ্বেতা, পুণ্ডরীক ও পত্রলেখা চরিত্রগুলি খুবই সাবলিলভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। ‘হর্ষচরিতম্’ আখ্যায়িকায় পুষ্যভূতি বংশের রাজা প্রভাকরবর্ধন, রানীযশোবতী, রাজ্যবর্ধন, রাজশ্রী ছাড়াও বৈদ্যকুমারাদি চরিত্র চিত্রণে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
শব্দচয়নে দক্ষতা:-
শব্দচয়নের বেলায় বানভট্ট যেন রঙ্গশালায় প্রবেশ করেছেন। অসাধারন ব্যুৎপত্তিজ্ঞানের ভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে তিনি শব্দকোষাগারে প্রবেশ করেছেন। ফলে স্বার্থক হয়েছে তার শব্দার্থসম্বন্ধ কল্পনা। এই কল্পনায় রয়েছে অর্থপূর্ণ ভাবের প্রাধান্য। সুতরাং তাঁর রচনা মানেই রবি ঠাকুরের ভাষায় এক চিত্রশালা। যৌবন বয়সে লাগামছাড়া হয়ে দেশ বিদেশে তিনি একসময় ভ্রমণ করত যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তা তার কল্পনার জালে ধরা পড়েছে। ভূয়োদর্শন এবং পর্যবেক্ষণ শক্তিকে তিনি কাজে লাগিয়ে তৎকালীন সামাজিক, প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক তথ্যসমূহকে প্রতিপাদন করেছেন। তাঁর কল্পনায় এবং রচনায় জাগতিক তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও বাদ পড়েনি। সাহিত্যরসিকরা তাই বলেছেন- ‘বাণোচ্ছিষ্টং জগত্ সর্বম্। সব মিলিয়ে তাঁর কাব্য এক গহন অরণ্যে পরিণত হয়েছে।
বানভট্টের রচনায় অলংকারসমূহ :-
উপযুক্ত অলংকার সন্নিবেশন বান রচনার অন্যতম প্রশংসনীয় দিক। তাঁর রচনায় উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, অর্থাপত্তি, বিরোধাভাস, শ্লেষ প্রভৃতি অলংকার ছাড়াও দীপক, স্বভাবোক্তি, পরিসংখ্যা প্রভৃতি অলংকারকে তিনি চাতুর্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন। চন্দ্রদেব তাই প্রশংসা করে বলেছিলেন-
“শ্লেষে কেচন শব্দগুম্ফবিষয়ে চেচিদরসে চাপরে।
অলংকারে কতিচিত্ সদর্থবিষয়ে চাণ্যৈ কথাবর্ণনে।
আসর্বত্র গভীরধীকরকবিতাবিন্ধ্যাটবীচাতুরী
কবিকুম্ভিকুম্ভভিদূরো বাণস্তু পঞ্চানন্ঃ”।।
তিনপ্রকার গদ্যবন্ধেই পারদর্শিতা:-
গদ্যবন্ধের তিনপ্রকার রচনা যথা উৎকলিকা, চূর্ণক ও মুক্তকে বাণভট্ট শুধুমাত্র পারদর্শীতাই দেখাননি, সর্বব্যাপী প্রতিভা, অভিনবকথা, গ্রাম্যতা দোষ, রহিত রচনা, বর্ণনা শক্তি, অযত্নপ্রবর্তিত শ্লেষালংকারের প্রয়োগ, রসের পূর্ণাভিব্যক্তি – এ সমস্ত বক্রোক্তিমার্গের রচনাকে প্রকাশ করে। দণ্ডী তাই বলেছিলেন- “যত্নেব চ বিচিত্রবক্রোক্তিবিজম্ভিতং হর্ষচরিতে প্রাচুর্যেণ ভট্টবাণস্য বিভাব্যতে।”
মূল্যায়ণ:-বানভট্টের রচনাশৈলী
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বাণভট্টকে সমালোচনাগ্রস্ত করেছেন। বাণভট্ট তাঁর কাব্যতে তৎকালীন পাঠকসমাজের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর কাব্য ভুলে যেতেন, তেমনি রবি ঠাকুরের ভাষায় অফিসের বেলা বয়ে গেলেও বুঝতে পারতেন না। সুতরাং বাণভট্ট হলেন স্বার্থক গদ্যকবি।
গোবর্ধনাচার্য তাই প্রশংসার ছলে বলেছিলেন-
” জাতা শিখণ্ডিণী প্রাগযথা শিখণ্ডী তথাবগচ্ছামি।
প্রাগলভ্যমধিকমাপ্তুং বাণী বাণো বভূবেতি।।”
- হর্ষচরিত: ব্যাখ্যা – 6
- হর্ষচরিত: ব্যাখ্যা – 5
- হর্ষচরিত: ব্যাখ্যা -3
- হর্ষচরিত: ব্যাখ্যা -1
- হর্ষচরিত: ব্যাখ্যা – 2
- হর্ষচরিত: ব্যাখ্যা -4
- বানভট্টের রচনাশৈলী সংক্ষিপ্ত পরিচয়