যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা হতে সাক্ষী বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের মতামত আলোচনা করা হয়েছে ।
যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা হতে সাক্ষী বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের মতামত আলোচনা কর।
উ:- সমগ্র স্মৃতিসাহিত্যের মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্য রচিত যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা অন্যতম একটি স্মৃতি শাস্ত্র গ্রন্থ। এই স্মৃতিশাস্ত্রের ব্যবহারাধ্যায়ে চতুষ্পাদ স্ত্রীধন প্রভৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি সাক্ষী সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা করেছেন এবং এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে বাদী বিচারসভায় কোন বিষয় সম্বন্ধে বিচার সভার সদস্যদের সম্মুখে প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে যা অভিযোগ করবে তা লিখে জানাতে হবে। এবং সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তার জয় হবে। কিন্তু প্রতিবাদী যদি তা অস্বীকার করে এবং প্রমাণসহ তা বিচারসভায় উপস্থাপিত করতে পারে, তাহলে প্রতিবাদীর জয় হবে। এই ব্যবহারের ক্ষেত্রে জয় বা পরাজয় নির্ভর করে প্রমাণের উপর এবং বিবাদের ক্ষেত্রে সত্য অসত্য নির্ণয়ের জন্য রাজা প্রমান দর্শন করবেন।
স্মৃতিশাস্ত্রে এই প্রমাণ তিন প্রকার। যথা-
- i)লিখিত বা দলিল
- ii)সাক্ষী এবং
- iii)ভুক্তি বা ভোগ দখল।
“প্রমাণং লিখিতং ভুক্তিঃ সাক্ষিণশ্চেতিপরিকীর্ত্তিতম্।”
এই সকল প্রমাণের সাহায্যে উত্তমর্ণ অধমর্ণের কাছ থেকে তার অর্থ ফেরত পায়। দ্বিতীয় প্রমাণ সাক্ষী সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে সাক্ষী কি কি গুন থাকা উচিত, কারা মিথ্যা সাক্ষীরূপে পরিগণিত হবে এবং মিথ্যা সাক্ষীর কিরূপ দণ্ড হওয়া উচিত ইত্যাদি আলোচনা করেছেন।
সাক্ষীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মহর্ষি মনু বলেছেন-
‘সমক্ষদর্শনাৎ সাক্ষ্যং শ্রবণাচ্চৈব সিধ্যতি।’
অর্থাৎ বাদী ও প্রতিবাদীর কার্যাবলী প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করা ও তাদের কথাবার্তা শোনার ফলে বিবাদাস্পদ বিষয়ে সত্যাসত্য নির্ণয় যারা সহায়তা করে তাদের সাক্ষী বলা হয়। অর্থাৎ চক্ষুগ্রাহ্য বিষয়ে প্রত্যক্ষ দর্শন এবং শ্রবণযোগ্য বিষয়ের শ্রবণ থেকে সাক্ষ্য সিদ্ধ হয় । চক্ষু কর্ণ এই দুই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান সাক্ষী হতে পারে।
আচার্য নারদ মনে করেন সাক্ষী দুই প্রকার। যথা – কৃত সাক্ষী এবং অকৃত সাক্ষী-
” সাক্ষী দ্বিবিধঃ কৃতঃ অকৃতশ্চেতি।”
সাক্ষীরূপে যাকে নিরূপিত করা হয় তাকে বলে কৃত সাক্ষী। আর যাকে নিরূপিত করা হয় না তাকে বলে অকৃত সাক্ষী।
“সাক্ষীত্বেন নিরূপিতঃ কৃতঃ অনিরূপিতঃ অকৃতঃ।”
যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার মিতাক্ষরা টীকায় নারদ স্মৃতির উল্লেখ করে পাঁচ প্রকার কৃত সাক্ষীর কথা বলেছেন। যথা –
- i)লিখিত
- ii)স্মারিত
- iii) যদৃচ্ছাভিজ্ঞ
- iv) গূঢ়
- v) উত্তরসাক্ষী।
আর অকৃত সাক্ষী ছয় প্রকার যথা –
- i)গ্রাম সাক্ষী
- ii) প্রাডবিবাক
- iii) রাজা
- iv) ব্যবহারী
- v) অর্থীপ্রেরিত
- vi) কূলসাক্ষী।
এদের মধ্যে দলিল পত্রাদিতে যাদের নাম লেখা থাকে তারা হলো লিখিত সাক্ষী। যাদের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে হয় তাদের বলা হয় স্মারিত সাক্ষী। যারা সাক্ষী বিষয়ে জ্ঞাত হয় এবং অনুরোধে সাক্ষী দেয় তারা যদৃচ্ছাভিজ্ঞ সাক্ষী। আবার যারা অজ্ঞাতভাবে থেকে বিবাদ বিষয়ে শুনে সাক্ষী দেয় তাহলে গূঢ় সাক্ষী। যারা সাক্ষীদের কথা শুনে সাক্ষ দেয় তারা হল উত্তর সাক্ষী।
সাক্ষী হতে গেলে কতগুলি গুণ থাকা একান্ত প্রয়োজন। আচার্য যাজ্ঞবল্ক্য তাই বলেছেন-
“তপস্বিণো দানশীলাঃ কুলীনাঃ সত্যবাদিনঃ।
ধর্মপ্রধানা ঋজবঃ পুত্রবন্তো ধনান্বিতাঃ।।
ত্র্যবরা সাক্ষিণো জ্ঞেয়াঃ শ্রৌত্রস্মার্ত্তক্রিয়াপরাঃ।
যথাজাতি যথাবর্ণং সর্বে সর্বেষু বা স্মৃতাঃ।।”
অর্থাৎ সাক্ষীগন তপঃ পরায়ণ, দানশীল,সৎ বংশজাত, সত্যবাদী, ধর্মপরায়ন, সরলবুদ্ধি, পুত্রবান ও ধনবান হবেন। এদের সংখ্যা তিনের কম হবেনা। এরা বৈদিক ও স্মৃতিশাস্ত্র সম্মত ক্রিয়াবান হবেন। সাক্ষীদের জাতি ও বর্ণ অনুসারে নির্বাচন করা হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে যে কেউ সকলের সাক্ষী হতে পারে।
গ্রামের অধিবাসীরা যে সাক্ষী দেয় তাকে বলা হয় গ্রাম সাক্ষী। প্রাডবিবাক শব্দের অর্থ হল লেখক, সভ্য প্রমুখদের সামনে কোন বিবাদ উপস্থিত হলে এরা যদি সাক্ষী দেয়, তাহলে এদের বলা হবে প্রাড্ বিবাক সাক্ষী। রাজা সাক্ষী দিলে তাকে বলা হবে রাজসাক্ষী, অর্থীর সঙ্গে যে একই কাজ করে সে সাক্ষী হলে তাকে বলে কার্যাধিকারী সাক্ষী। অর্থীর দ্বারা প্রেরিত ব্যক্তি সাক্ষী হলে তাকে অর্থীপ্রেরিত সাক্ষী বলা হবে এবং কুল বিবাদের ক্ষেত্রে স্ববংশীয় ব্যক্তি যদি সাক্ষী দেন তাহলে তাকে কূলসাক্ষী বলা হয়।
সকলেই কিন্তু সাক্ষী হওয়ার যোগ্য নয়। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন- স্ত্রীলোক,বালক,বৃদ্ধ, মাতাল, পাগল,বিকলাঙ্ক, চোর,অভিশপ্ত ব্যক্তি, ব্রহ্ম হত্যাকারী- এই সমস্ত ব্যক্তিরা সাক্ষী হওয়ার যোগ্য নয়। তিনি বলেছেন ব্রাহ্মণের সাক্ষী হবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের সাক্ষী হবে ক্ষত্রিয় এবং স্ত্রীলোকের সাক্ষী হবে স্ত্রীলোক।
“সাহসী দৃষ্টদোষশ্চ নির্ধূতাদ্যাস্ত্বসাক্ষিণঃ। “
বাদীর এবং বিবাদীর উভয় সম্মত একজন ধর্মজ্ঞ সাক্ষীও হতে পারে। বিচারক অর্থী,প্রত্যর্থীর সামনে সাক্ষীগণকে শপথ গ্রহণ করাবেন। শপথ গ্রহণ করার পর সাক্ষী যদি ঋণ বিষয়ে সাক্ষী না দেয় এবং কিছু না বলে তাহলে রাজা সুদসহ সমস্ত ঋণ তার দ্বারা উত্তমর্ণকে দেওয়াবেন এবং রাজা দণ্ডস্বরূপ স্বয়ং ঋণের দশম অংশ গ্রহণ করবেন-
” রাজ্ঞা সর্বং প্রদাপ্যঃ স্যাৎ ষট্ চত্বারিংশকেঅহনি।।”
সাক্ষী গণের মধ্যে যদি দ্বিমতের সৃষ্টি হয়, তাহলে অধিক সংখ্যক সাক্ষীর মতই গৃহীত হবে। আর যদি সম সংখ্যক দুই দল সাক্ষীর মধ্যে ভেদ সৃষ্টি হয় তাহলে গুণীজনের মতই গ্রহণ করা হবে। আবার গুণী জনের মধ্যেও যদি মতবিরোধ দেখা যায় তাহলে বেদধ্যয়নহেতু অধিক গুনযুক্ত সাক্ষীর মত গ্রহণ করা হবে-
“গুণিদ্বৈধে তু বচনং গ্রাহ্যং যে গুণবত্তমাঃ।”
যে বাদীর প্রার্থনার বিষয়টিকে সাক্ষীগন সত্য বলে ঘোষনা করে, সেই বাদীই জয়ী হয়। আর যে বাদীর প্রার্থনা বিষয়টি সাক্ষীগন মিথ্যা বলে প্রমাণ করেন সেই বাদীর পরাজয় হয়-
“অন্যথা বাদিনো যস্য ধ্রুবস্তস্য পরাজয়ঃ।।”
সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে কিনা তা তার লক্ষণ থেকে বুঝতে পারা যায়। মিথ্যা সাক্ষীর লক্ষণ সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন- মিথ্যাসাক্ষী নিজের দোষে অপ্রকৃতিস্থ হয়। সে কোথাও স্থির না থেকে অস্থির ভাবে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়ায়, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় ব্যস্ত থাকে ও বিচলিত হয়, নিয়ত পদচারনা করে ও দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, কখনো পা দিয়ে মাটিতে দাগ কাটে, কখনো বা হাত কাঁপতে থাকে, মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়, এদিক ওদিক তাকাতে থাকে, কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও ব্যস্ত হয়ে বহু কথা বলে থাকে। সুতরাং এইসব লক্ষণ থেকে সহজেই মিথ্যাসাক্ষী চেনা যায়। মিথ্যাসাক্ষীগন বিবাদে পরাজিত হলে যে পরিমাণ দণ্ডবিহিত হয়েছে, তার দ্বিগুণ অর্থ দণ্ডে তারা দণ্ডিত হবে। আর ব্রাহ্মণ যদি কূটসাক্ষী হয়, তাহলে সে রাজ্য থেকে নির্বাসিত হবে-
“বিবাদাদ্ দ্বিগুনং দণ্ডং বিবাস্যো ব্রাহ্মণঃ স্মৃতঃ।”
সত্য বললে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়াদি চার বর্ণের যদি বধের সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে সাক্ষী মিথ্যা বলবে। পরে অবশ্য মিথ্যা বলার জন্য যে পাপ তিনি করবেন তার থেকে মুক্তির জন্য সরস্বতী দেবীর উদ্দেশ্যে যোগ্য সম্পাদন করবেন-
” তৎ পাবনায় নির্বাপ্যশ্চরুঃ সারস্বতো দ্বিজৈঃ।”
এটাই হল আচার্য যাজ্ঞবল্ক্যের সাক্ষী সম্বন্ধে বিশদ্ আলোচনা।
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা-8
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা-7
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা-6
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা-5
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা-4
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা -3
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা – 2
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ব্যাখ্যা-1
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: যাজ্ঞবল্ক্যকে অনুসরন করে ঋণাদান ও বৃদ্ধি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: চতুষ্পাদ ব্যবহার
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: সাক্ষী বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের মতামত আলোচনা
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্ ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
- যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ব্যবহারাধ্যায় – সাধারন ব্যবহার মাতৃকা প্রকরণম্