সন্নিকর্ষ বলতে কি বোঝ? বিভিন্ন প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষ ব‍্যাখ‍্যা কর

তর্কসংগ্রহ অনুসারে সন্নিকর্ষ বলতে কি বোঝ? বিভিন্ন প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষ ব‍্যাখ‍্যা কর ?

সন্নিকর্ষ বলতে কি বোঝ? বিভিন্ন প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষ ব‍্যাখ‍্যা কর?

সন্নিকর্ষ অর্থ সম্বন্ধে
সন্নিকর্ষ ইন্দ্রের সঙ্গে বিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান 
সন্নিকর্ষ প্রকারভেদ দুই প্রকার-
 লৌকিক  ও অলৌকিক 
লৌকিক সন্নিকর্ষ ছয় প্রকার

উ:- ইন্দ্রিয় ও পদার্থের যে সমন্ধ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের  কারন হয় দর্শনের পরিভাষায় তাকে সন্নিকর্ষ বলে। সুতরাং সন্নিকর্ষ বলতে প্রত্যক্ষের পূর্বে কোন পদার্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের কিরূপ সম্বন্ধ তাই বোঝায়। জ্ঞান আত্মার ধর্ম। আত্মার সঙ্গে মনের, মনের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের এবং বিষয়ের সঙ্গে আলোর যখন সংযোগ ঘটে তখনই উদ্ভব হয় জ্ঞানের। আচার্য অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে লৌকিক সন্নিকর্ষ আলোচনা করেছেন।

লৌকিক সন্নিকর্ষ ছয় প্রকার-
” প্রত‍্যক্ষজ্ঞানহেতুরিন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষঃ ষডবিধঃ সংযোগঃ, সংযুক্ত সমবায়ঃ, সংযুক্তসমবেত সমবায়ঃ, সমবায়ঃ, সমবেতসমবায়ঃ, বিশেষণবিশেষ‍্যভাবশ্চেতি।।”

ইন্দ্রিয়গ্রাহ‍্য বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকার হতে দেখা যায়। গুন, ক্রিয়া, জাতি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ‍্য পদার্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ সম্বন্ধ সম্ভব নয় বলেই আচার্যগন সন্নিকর্ষ শব্দের প্রয়োগ করেছেন। এর ফলে সংযোগ সম্বন্ধের ন‍্যায় অন‍্যান‍্য সম্বন্ধ গুলোও অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে। তা না হলে গুন, ক্রিয়া, জাত‍্যাদির প্রত‍্যক্ষ জ্ঞান হতো না। মহর্ষি গৌতমকে অনুসরন করে অন্নংভট্টও সন্নিকর্ষ শব্দটি ব‍্যবহার করেছেন।


            বিভিন্ন প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-


i) সংযোগ সন্নিকর্ষ:-

লৌকিক সন্নিকর্ষের মধ্যে সংযোগ সন্নিকর্ষ হল প্রথম প্রকার। দ্রব‍্য বিশেষের সঙ্গে চক্ষুরিন্দ্রিয়ের যে সন্নিকর্ষ কার্যকর হয় তাকে সংযোগ সন্নিকর্ষ বলে। অন্নংভট্ট এই প্রসঙ্গে বলেছেন-

” চক্ষুষা ঘটপ্রত‍্যক্ষজননে সংযোগঃ সন্নিকর্ষঃ।”

অর্থাৎ যে স্থলে ঘটের চাক্ষুষ প্রত‍্যক্ষ হয়, সে স্থলে ঘটের সঙ্গে চক্ষুর সংযোগ সন্নিকর্ষ হয় থাকে।

কেননা, ঘট একটি দ্রব‍্য। দ্রব‍্যদ্বয়ের পারস্পরিক সন্নিকর্ষ হয় যদি তারা অবয়ব – অবয়বী দ্রব‍্য না হয়। কারন অবয়ব- অবয়বী দ্রব‍্য সংযোগ নয়, সমবায়। চক্ষু ও ঘটের অবয়ব – অবয়বী ভাব না থাকায় এখানে সংযোগ সন্নিকর্ষ হয়েছে। চক্ষু, ত্বক ও মন এই তিনটিকে ইন্দ্রিয় দ্রব‍্যের প্রত‍্যক্ষ জ্ঞান হয় বলে  এদের সন্নিকর্ষকে সংযোগ সন্নিকর্ষ বলা হয়। তর্কদীপিকায় বলা হয়েছে –

“দ্রব‍্য প্রত‍্যক্ষ সর্বত্র সংযোগঃ সন্নিকর্ষ ইত‍্যর্থঃ”।

ii) সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ:-

লৌকিক সন্নিকর্ষের মধ্যে সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হলো দ্বিতীয় প্রকার সন্নিকর্ষ।  আমরা যখন ঘটকে প্রত্যক্ষ করি তখন ঘটস্থিত রূপকেও প্রত্যক্ষ করি। রূপের সঙ্গে চক্ষুরিন্দ্রিয়ের সংযোগ সম্বন্ধ সম্ভব নয়। এখানে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের পরম্পরা সম্বন্ধ অর্থাৎ চক্ষুর সঙ্গে ঘটের সম্বন্ধসংযোগ,  রূপের সঙ্গে ঘটের সম্বন্ধ সমবায়। অতএব, চক্ষুর সঙ্গে রূপের  সন্নিকর্ষ হল সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ-

” ঘটরূপপ্রত‍্যক্ষজননে সংযুক্তসমবায় সন্নিকর্ষ।”

গুন, জাতি ও কর্মের প্রত‍্যক্ষে সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। অতএব, ঘটরূপ প্রত‍্যক্ষে সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। অতএব, ঘটরূপ প্রত‍্যক্ষে সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হয়েছে। এরূপ ঘ্রাণ ও রসনার দ্বারা গন্ধ ও রস গৃহীত হলে এসব স্থলেও সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। তর্কদীপিকায় বলা হয়েছে- “সংযুক্ত সমবায়ম্ উদাহরতি ঘটরূপেতি।”

iii) সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ:-

লৌকিক সন্নিকর্ষের মধ‍্যে সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ হল তৃতীয় প্রকার সন্নিকর্ষ। ঘটে রূপ আছে, রূপে রূপত্ব জাতি আছে। এখানে চক্ষুর সঙ্গে ঘটের সম্বন্ধ সংযোগ, ঘটের সঙ্গে রূপের সম্বন্ধ সমবায়, রূপের সঙ্গে রূপত্ব জাতির সম্বন্ধ ও সমবায়। অতএব, চক্ষুর সঙ্গে রূপত্ব জাতির পরম্পরা সম্বন্ধ হল সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ। এজন‍্যই গ্রন্থাকার  বলেন- ‘রূপত্বসামান‍্যপ্রত‍্যক্ষে সংযুক্ত সমবেত সমবায়ঃ সন্নিকর্ষঃ।’ আমাদের চক্ষু, ত্বক ও মন এ তিনটে ইন্দ্রিয় যেমন দ্রব‍্য বিষয়ক জ্ঞান উৎপন্ন করে সেইরূপ কর্ণ, নাসিকা ও জিহ্বা এই তিনটে ইন্দ্রিয় শুধু গুন ও গুনে সমবেত গুনত্ব জাতির জ্ঞানোৎপত্তির কারণ হয়।

অন্নংভট্টের কথায়-

“চক্ষু সংযুক্তে ঘটে রূপং, তত্র রূপতস‍্যং সমবায়াৎ।”

         মন ইন্দ্রিয়ের সাহায‍্যে যখন মানস্ প্রত‍্যক্ষে আত্মারূপ দ্রব‍্যটির দর্শন ঘটে তখন সংযোগ সন্নিকর্ষ হয়, যখন আত্মার সুখ, দুঃখাদিগুনের প্রত‍্যক্ষ হয়, তখন সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হয় এবং সুখত্বাদি জাতির প্রত‍্যক্ষ হলে হবে সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ।

iv) সমবায় সন্নিকর্ষ:-

চতুর্থ প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষ হল সমবায় সন্নিকর্ষ। “

শ্রোত্রেন শব্দসাক্ষাৎকারে সমবায়ঃ সন্নিকর্ষঃ।” অর্থাৎ শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা শব্দ প্রত‍্যক্ষের স্থলে সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। শব্দ আকাশের গুন। গুন গুনীতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে, অতএব, আকাশে শব্দ সমবায় সম্বন্ধে থাকে। শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা শব্দ প্রত‍্যক্ষ শব্দের সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয় সমবায় সন্নিকর্ষই হবে।
       এখন প্রশ্ন জাগে দূরস্থিত শব্দের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হয় কি ভাবে? দীপিকা টীকায় এ প্রশ্নের স্বয়ং উত্থাপন করে উত্তর দিচ্ছেন অন্নংভট্ট। তিনি বলেছেন – “বীচিতরঙ্গন‍্যায় বা কদম্বমুকুলন‍্যায়।” অনুসারে শব্দ থেকে শব্দান্তরের সৃষ্টি হয়ে ক্রমশ তা কর্ণ বিবরস্থিত আকাশের সঙ্গে সমন্বিত হয় এবং আকাশস্থিত শব্দের সঙ্গে  সমবায় সম্বন্ধে শব্দের প্রত‍্যক্ষ হয়। এজন‍্য শব্দ প্রত‍্যক্ষের কারণ রূপে সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করা হয়।

V) সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ:-

“শব্দত্বসাক্ষাৎকারে সমবেতসমাবায়ঃ সন্নিকর্ষঃ।”

অর্থাৎ শব্দ যেমন প্রত্যক্ষ হয় তেমনি শব্দের সমবেত শব্দত্ব জাতির প্রত্যক্ষ হয়। শ্রবণেন্দ্রিয়ের সঙ্গে শব্দত্ব জাতির সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। শব্দত্ব জাতি শব্দ গুনে সমবায় সম্বন্ধে থাকে, প্রসঙ্গত স্মরণ  রাখা প্রয়োজন যে, যে ইন্দ্রিয় দ্বারা যে দ্রব্য প্রত্যক্ষ গোচর হয়, সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই সেই দ্রব্যের গুন, জাতি এবং সেই দ্রব্যের অভাবেরও প্রত্যক্ষ হবে।

vi) বিশেষণ বিশেষ‍্যভাব সন্নিকর্ষ:-

” অভাব প্রত‍্যক্ষে বিশেষণবিশেষ‍্যভাবঃ সন্নিকর্ষঃ।”

অর্থাৎ অভাব প্রত‍্যক্ষে বিশেষণ বিশেষ‍্যভাব সন্নিকর্ষ হয়। যেমন- ‘ঘটাভাববৎ ভূতলম্’ বললে ভূতলের যে প্রত‍্যক্ষ হয় সেখানে ভূতলটি বিশেষ‍্য এবং ঘটাভাবটি বিশেষণ। তাই এদের সম্বন্ধটি বিশেষণ বিশেষ‍্যভাব বলে অভাব প্রত‍্যক্ষে বিশেষ‍্যভাব সন্নিকর্ষ স্বীকার করা হয়।
   
        আচার্য অন্নংভট্ট ইন্দ্রিয় ও অর্থের সন্নিকর্ষ জন্য জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বলেছেন।  এজন্য ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানের অসাধারণ কারণ অর্থাৎ করন বলা হয়। সুতরাং প্রত‍্যক্ষ প্রমার কারণ হওয়ায় ইন্দ্রিয়ই প্রত‍্যক্ষ প্রমাণ বলে গ্রাহ‍্য। কিন্তু প্রত‍্যক্ষের লক্ষণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সন্নিকর্ষই প্রত‍্যক্ষ জ্ঞানের অব‍্যবহিত পূর্ববর্তী ব‍্যাপার বলে ঠিক হতো। মনে হয় অন্নংভট্ট এখানে প্রাচীন মতের অনুসরণ করেছেন।

Comments