নাট্যসাহিত্যে কালিদাসের স্থান নির্ণয় কর।
নাট্যসাহিত্যে কালিদাসের স্থান নির্ণয় কর
উ:- রসিককূলের মানস সরোবরের মুগ্ধ মরাল সাক্ষাৎ বাগদেবীর অবতার কবিকূলগুরু মহাকবি কালিদাস কেবল শ্রব্যকাব্য রচনাতেই কৃতিত্ব প্রদর্শন করেননি পড়ন্ত দৃশ্য কাব্য রচনাতেও অশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। নাট্যসাহিত্যে কালিদাসের স্থান নির্ণয় করতে গেলে বলতে হবে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি জীবন রসের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা মানব মনের বিচিত্র ভাব বিলাস তার অনুভবের মধ্যে ছিল বলেই তার রচিত নাটকগুলি এত সরস ও হৃদয়গাহী হয়ে উঠেছিল।
সুদূর অতীতের কোন শুভক্ষণে, কোন্ পূণ্যক্ষেত্রে এই বিশ্ব বিখ্যাত কবিকুল চূড়ামনি জন্মেছিলেন, তার পিতৃ পরিচয়ই বা কি তা আজও তমসাচ্ছন্ন। বিশ্বকবির আক্ষেপটি স্মরণ করেই আমাদের শান্তি পেতে হয়-
” হায়রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল।
পন্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল।।”
এমনকি ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পুলকেশীর সময়কালে রবিকীর্তির আইহোল শিলালিপিতে ভারবির সাথে কালিদাসের নাম প্রশংসা স্বরূপ উচ্চারিত হয়েছে-
” যেনাযোজি নবেশ্ম স্থিরমর্থবিধৌ বিবেকিনাজিনবেশ্ম।
স বিজয়তাং রবিকীর্তিঃ কবিতাশ্রিতকালিদাস ভারবিকীর্তিঃ।।”
নাট্যসাহিত্যের কালিদাস
কবিগুরু কালিদাস অন্যসব কাব্য যদি রচনা নাও করতেন, শুধু তিন খানি নাটক তিনি রচনা করতেন তাতেই তিনি চিরদিন ভূ-লোকে অমর হয়ে থাকতেন। তার রচিত তিনটি নাটক হল- মালবিকাগ্নিমিত্রম্, বিক্রমোর্বশীয়ম্ এবং অভিজ্ঞান শকুন্তলম্। সবই শৃঙ্গার রস মূলক। তখনকার সমাজ, সমাজের রীতিনীতি, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন তাই তার নাটকে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। নাট্যসাহিত্যে কালিদাসের স্থান নির্ণয় করতে হলে নাটকীয় আলোচনা করলে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে।
i) মালবিকাগ্নিমিত্রম্:-
মহাকবি কালিদাসের প্রথম রচিত মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটক। এটি পঞ্চমাঙ্ক বিশিষ্ট নাটক। বিদিশা অধিপতি মহারাজা অগ্নিমিত্র ও বিদর্ভরাজকন্যা মালবিকার প্রেম কাহিনীকে অবলম্বন করে এই নাটকটি রচিত। নায়িকা মালবিকা দস্যু হাতে নিপতিত হন এবং ঘটনাচক্রে মালবিকা অগ্নিমিত্রের রাজ্যে আশ্রয় লাভ করেন। এবং বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্নিমিত্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন।
অপরদিকে মালবিকাকে কাছে পেয়েও ধারিনীর তত্ত্বাবধানে তাকে দূরে যেতে হওয়ায় রাজা দুঃখে বলেছেন-
” অহং রথাঙ্গনামেব
প্রিয়া সহচরীব মে।
তামনুজ্ঞাত সম্পর্কা
ধারিনী রজনীব নৌ।।”
কালিদাস শুরুতেই নাটককে নতুন বলেছেন। কারণ এর মধ্যে প্রথম প্রথম যৌবনের জীবন তৃষ্ণার বিপুল আবেগ প্রেমের চঞ্চলতা রূপ ও তৃষ্ণার মোহ ইত্যাদি বিভিন্ন বৈচিত্র্যে নাটকটি উপভোগ্য করে তুলেছেন। কালিদাসের এই নতুন প্রচেষ্টা যে নিন্দা যোগ্য হবেনা এইজন্য নাট্যকার নাটকের প্রস্তাবনায় বলেছেন-
“পুরানমিত্যেব ন সাধুসর্বং ন চাপি কাব্যং নবমিত্যবদ্যম্।।”
এভাবে রূপ রসে চরিত্র চিত্যায়নের বৈচিত্র্যে নাটকটি সার্থক। নাট্যসাহিত্যে কালিদাসের স্থান বিষয়ে S.N De এর উক্তি প্রনিধানযোগ্য-
” The characterization is sharp and clear, and the expression polished elegant and even dainty there is nothing immature, clumsy or turgid in the drama.”
ii) বিক্রমোর্বশীয়ম্:-
কালিদাসের দ্বিতীয় সৃষ্টি বিক্রমোর্বশীয়ম্ নাটকটি পঞ্চমাঙ্ক বিশিষ্ট।পুরুরবা ও ঊর্বশীর প্রেম কাহিনী অবলম্বন করে এই নাটকের সূচনা। নাট্য শিল্পের অবমাননার দায়ে ঊর্বশীর উপর বর্ষিত হয় নাট্যাচার্য ভরতের অভিশাপ এবং এভাবে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের মিলন হয়। রাজা ঊর্বশীর অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে বিদূষকের কাছে বর্ণনা করেছেন-
” আভরণম্যাভরণং প্রসাদধনবিধেঃ প্রসাধন বিশেষঃ।
উপমাস্যাপি সখে প্রতুপমানং বপুস্তস্যাঃ।।”
কবি কালিদাস অপূর্ব কবিত্ব শক্তিতে এই বিয়োগান্তক কাহিনীটিকে মিলনান্তক রূপে পরিণত করেছেন। নাটকটি যেন গীতিকাব্যের করুন – কোমল পেলবতায় আচ্ছন্ন। পুরুরবার রোদনধ্বনির মধ্য দিয়ে কবি হৃদয়ের ক্রন্দনধ্বনি যেন কান পাতলেই শোনা যায়।
অভিজ্ঞানশকুন্তলম্:-
অমর কবি কালিদাসের অমর সৃষ্টি অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ সপ্তাঙ্ক নাটক। মহারাজা দুষ্যন্ত মৃগয়া ব্যাপদেশে কন্ব মুনির আশ্রমে এসে শকুন্তলার প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে গান্ধর্ব বিবাহ করেন। পরবর্তীকালে শকুন্তলার উপর বর্ষিত হয় কোপন স্বভাব ঋষি দুর্বাসার অভিশাপ– “বিচিন্তয়ন্তী যমনন্যমানসা।” অবশেষে শকুন্তলার বিরহের অনলে পরিশুদ্ধ হয়ে সপ্তাঙ্গে মারীচের আশ্রমে দুষ্যন্তের সঙ্গে মিলনে নাটকটির পরিসমাপ্তি হয়। সপ্তাঙ্গ বিশিষ্ট নাটকে চতুর্থ অংকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
” কালিদাসস্য সর্বস্বমভিজ্ঞান শকুন্তলম্।
তত্রাপি চ চতুর্থোঙ্ক যত্র যাতি শকুন্তলম্।।”
অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকে প্রাকৃতিক বর্ণনাই নয়, কালিদাস শকুন্তলার রূপের বর্ণনাতেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত-
“চিত্রে নিবেশ্য পরিকল্পিতসত্ত্বযোগা
রূপোচ্চয়েন মনসা বিধিনা কৃতানু।
শ্রীরত্ন সৃষ্টিরপরা প্রতিভাতি সা মে
ধাতুর্বিভূত্বমনুচিন্ত্য বপুশ্চ তস্যাঃ।।”
প্রকৃতির বর্ণনাতেও তিনি বলেছেন শকুন্তলার বিয়োগ ব্যথায় বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সমস্ত প্রাণীরা দুঃখে ভারাক্রান্তা।-
“মৃগের গলি পড়ে মুখের তৃণ
ময়ূর নাচে না যে আর
খসিয়া পড়ে পাতা লতিকা হতে
যেন সে আঁখি জলাধারঃ।।”
ছন্দমাধুর্য, অলংকার প্রয়োগ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অন্তরঙ্গতা, বর্ণনে, ত্যাগ নিষ্ঠা ও সংযমের পরাকাষ্টা নিদর্শনে কালিদাসের কৃতিত্ব অপরিসীম।
Herder শকুন্তলা প্রসঙ্গে বলেছেন-
“It is here that the mind and character of at a nation is brought to life before us.”
অন্যদিকে কালিদাসের বাক্ শিল্প তো প্রবাদের বিষয়ে যে কোন সাহিত্য স্রষ্টার আদর্শ। নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট বলেছেন-
“অমৃতেনৈব সংসিক্তা চন্দনেনেব চর্চিতা
চন্দ্রাংশুভিরিবোদঘৃষ্টাঃ কালিদাসস্য সূক্তয়ঃ।।”
মহাকবি কালিদাসের সম্পর্কে জয়দেব প্রসঙ্গ রাখবে বলেছেন-
” কবিকূলগুরুঃ কালিদাসো বিলাস।”
উপমা রূপ কল্পনা প্রসঙ্গে কালিদাস বলেছেন- যা কিছু উপমা যোগ্য ও সুন্দর তাদের সংগ্রহ ও যথাচিত সন্ধিবেশে স্বয়ং বিধাতা তাকে নির্মাণ করেছেন-
“সর্বোপমাদ্রব্যসমুচ্চয়েণ যথা প্রদেশং বিনিবেশিতেন।
সা নির্মিতা বিশ্বসৃজা প্রযত্নাদ্ একস্থসৌন্দর্য দিদৃক্ষয়েব।।”
সুতরাং নাট্যসাহিত্যে কালিদাসের স্থান সর্বোচ্চ ।