মুণ্ডকোপনিষদ হতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র ব্যাখ্যা দেওয়া হল । মুণ্ডকোপনিষদ হতে গুরুত্ত্বপূর্ণ ৫ টি মন্ত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া হল ।
মুণ্ডকোপনিষদ হতে মন্ত্র ব্যাখ্যা
- মুন্ডকোপনিষদ্ হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
- মুণ্ডকোপনিষদে বর্ণিত আত্মার স্বরূপ
- মুণ্ডকোপনিষদ অনুসারে আত্মতত্ত্বলাভের উপায়
——–>>>>>>> মুণ্ডকোপনিষদ ১২ টি মন্ত্রের শব্দার্থ সহ অর্থ <<<<<<——
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-১ (ব্যাখ্যা)
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে।।
উৎস:- আলোচ্য মন্ত্রটি অথর্ববেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদের দ্বিতীয় মুন্ডকের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে সংকলিত।
প্রসঙ্গ:- ঋষি অঙ্গিরা ঋষি শৌণককে ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে উপদেশ প্রদানকালে ব্রহ্মদর্শনের ফলে দ্রষ্টার কীরূপ অবস্থা হয়, সে প্রসঙ্গে আলোচ্য মন্ত্রটির অবতরণা করেছেন।
তাৎপর্য:- এই বিশ্ব সংসারে সমগ্র জীবজগতের মধ্যে মানুষেই জ্ঞান লাভের যোগ্য। আবার কামনা বাসনা জনিত অভিমানের দ্বারা মানুষ মাঝেমধ্যে অজ্ঞানতার পরিচয় দেয়। মানুষ চিন্তা করে আমিই কর্তা। এই জগতে সবকিছুই আমার। কিন্তু এইভাবের দ্বারা নিজ অন্তঃকরণকে সে শুদ্ধ করতে পারে না। আত্মার সাক্ষাৎ দর্শন হলে মানুষের মধ্যে এই অভিমান দূর হয় সর্ব সংশয় ছিন্ন হয়।
মানুষের মন সর্বদা সংশয়কূল। মরণকাল পর্যন্ত মানুষ মনের সংশয়ে পীড়িত হয়। একমাত্র ব্রহ্ম দর্শনের ফলেই সমস্ত সংশয় দূর হয়। যে ব্যাক্তি ব্রহ্মের সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তার কামনা – বাসনা জনিত সমস্ত কর্মফল ক্ষয় পায়। শরীর ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কর্ম মানুষকে করতে হয়। কিন্তু আত্মদ্রষ্টা ব্যক্তিগণ অনাসক্তভাবে সেই কর্ম সম্পন্ন করেন।
ব্রহ্মকে পরাবর বলা হয়েছে। যা সব কিছুর অতীত তাই পর। আবার যা সৃষ্টিতে প্রকাশিত তাই অবর। ব্রহ্ম একদিকে সর্বাতীত, অপরদিকে সর্বগত। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাকে উভয় ভাবেই দর্শন করেন। সেই ব্রহ্ম কারণরূপে শ্রেষ্ঠ এবং কার্য রূপে নিকৃষ্ট।
ব্রহ্মদর্শনের ফলে আত্ম-দ্রষ্টা ব্যক্তিগণ সমস্ত কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন। শরীর যাত্রা নির্বাহের জন্য তিনি শুধু নিষ্কাম কর্ম করে মোক্ষ লাভ করেন।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-২ (ব্যাখ্যা)
” ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোঅয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।”
উৎস:- আলোচ্য মন্ত্রটি অথর্ববেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদের দ্বিতীয় মুন্ডকের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে সংকলিত।
প্রসঙ্গ:- ঋষি অঙ্গিরা ঋষি শৌণককে ব্রহ্ম বিষয়ক উপদেশ প্রদানকালে ব্রহ্মের তথা পরম আত্মার স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচ্য মন্ত্রটির অবতরণা করেছেন।
তাৎপর্য:- আমরা জানি চন্দ্র সূর্য তারকারাজিও অগ্নির আলোয় এই জগতের সব কিছু প্রকাশিত হয়। কিন্তু সর্ব প্রকাশক সূর্যও ব্রহ্মকে প্রকাশ করতে পারেনা। ঋষি অঙ্গিরার মতে,সূর্য চন্দ্র তারকা ও বিদ্যুৎ এই সমস্ত জ্যোতিষ্ক পদার্থ গুলির স্বতঃপ্রকাশক সামর্থ্য নেই। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম নিজেই স্বপ্রকাশক। তার অনুগত হয়েই ঐ সমস্ত জ্যোতিষ্ক বস্তুগুলি প্রকাশিত হয়। ব্রহ্মের দীপ্তিতেই সবকিছুই দীপ্তিমান। জল এবং কাঠ যেমন নিজের উত্তাপে অন্য বস্তুকে দগ্ধ করতে পারেনা, একমাত্র দহনকারী অগ্নির দ্বারাই অন্য বস্তুকে দগ্ধ করে, তেমনি চন্দ্রসূর্যাদি জ্যোতিষ্ক পদার্থগুলিও ব্রহ্মের দীপ্তিতেই এই জগত সংসারকে প্রকাশ করে। ব্রহ্মের দীপ্তির কাছে অন্য সকল জ্যোতিষ্ক পদার্থের দীপ্তি ম্লান হয়ে যায়।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-৪ (ব্যাখ্যা)
” সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহ-
নীশায়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশা-
মস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।”
উৎস:- আলোচ্য মন্ত্রটি অথর্ববেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদের তৃতীয় মুন্ডকের প্রথম খণ্ড থেকে সংকলিত।
প্রসঙ্গ:- ঋষি অঙ্গিরা ঋষি শৌণককে ব্রহ্ম বিষয়ক উপদেশ প্রদানকালে উপমা অলঙ্কারের সাহায্যে জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ বর্ণনা করে মোহগ্রস্ত জীবের পরিণতি এবং তা থেকে মুক্তির উপায় প্রসঙ্গে আলোচ্য মন্ত্রটির অবতরণা করেছেন।
তাৎপর্য:- জীব এবং ঈশ্বর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে একই দেহে অবস্থান করে। কিন্তু জীব সংসারের মায়ায় মোহগ্রস্ত হয়ে ঈশ্বরকে ভুলে শুধুমাত্র দেহের সেবায় মগ্ন থাকে। দেহের সুখ ও দুঃখেই সে নিজেকে সুখী বা দুঃখী মনে করে। মোহাচ্ছন্ন জীব নিজেকে ক্ষুদ্র ক্ষীণ এবং শক্তিহীন মনে করে। এই অভাব থেকেই জীবদেহে কামনা বাসনা ইত্যাদি জন্ম হয়। কামনা পূরণ না হলে জীব শোকে দুঃখে পীড়িত হয়। এই দৈনদশা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করা। মোহগ্রস্থ জীব ইস্বরের অনুগ্রহে যদি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তাহলেই সে উপলব্ধি করতে পারে- সে আর কামনা বাসনাযুক্ত ক্ষুদ্র জীব নয়। তখন তার সমস্ত দৈনদশা দূর হয় সে নিজের মহিমা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়। তাকে শোক বা দুঃখ স্পর্শও করতে পারে না।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-৭ (ব্যাখ্যা)
বৃহচ্চ তদ্দিব্যমচিন্ত্যরূপং
সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি।
দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ
পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্।।”
উৎস :- আলোচ্য মন্ত্রটি অথর্ববেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদের তৃতীয় মুন্ডকের প্রথম খণ্ড থেকে সংকলিত।
প্রসঙ্গ:- ঋষি অঙ্গিরা ঋষি শৌণককে ব্রহ্ম বিষয়ক জ্ঞান প্রদানকালে পরমাত্মার স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচ্য মন্ত্রটির অবতরণা করেছেন।
তাৎপর্য:- সত্য,তপস্যা, সম্যকজ্ঞান এবং নিত্য ব্রহ্মচর্যের দ্বারা যাকে লাভ করা যায় সেই ব্রহ্ম সর্বত্র পরিব্যপ্ত বলেই তিনি বৃহৎ তথা মহান। ব্রহ্ম স্বপ্রকাশমান,তাকে চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি জ্যোতিষ্ক পদার্থ গুলি ও প্রকাশ করতে পারেনা। ব্রহ্মের দীপ্তিতেই ঐ সমস্ত পদার্থ গুলি প্রকাশিত হয়। ব্রহ্ম ইন্দ্রিয় সমূহের অগোচরে থাকায় তার রূপকে চিন্তা করা যায় না। তাই তিনি অচিন্তনীয়। অতি সূক্ষ্ম পদার্থ থেকেও এই ব্রহ্ম সূক্ষ্মতর। শুধুমাত্র জ্ঞানী তথা বিদ্বান ব্যক্তিরাই নিজ হৃদয়াকাশে এই ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ব্যক্তিদের পক্ষে সহস্র জন্মেও এই ব্রহ্ম অপ্রাপ্য। তাই তাদের নিকট ব্রহ্ম দূর থেকে অতি দূরে বিরাজ করেন। অথচ জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তাকে নিজ দেহে উপলব্ধি করেন। তাই তাদের কাছে ব্রহ্ম নিকটতম। ব্রহ্ম মানুষের বুদ্ধিরূপ গুহাতে নিহিত আছেন। বিদ্বানগন তাঁকে উপলব্ধি করতে পারলেও অজ্ঞানীরা অবিদ্যায় আবৃত থাকায় তাঁকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-১২ (ব্যাখ্যা)
“যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে-
অস্তং গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়।
তথা বিদ্বান্নামরূপাদ্বিমুক্তঃ
পরাৎপরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্।।”
উৎস:- আলোচ্য মন্ত্রটি অথর্ববেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদের তৃতীয় মুন্ডকের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে সংকলিত।
প্রসঙ্গ:- ঋষি অঙ্গিরা ঋষি শৌণককে আত্মজ্ঞান লাভের উপায় সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করে উপমা অলংকারের সাহায্যে কীভাবে ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মের সঙ্গেই একাত্মতা স্থাপন করতে সক্ষম হন – এই প্রসঙ্গে আলোচ্য মন্ত্রটির অবতরণা করেছেন।
তাৎপর্য:- গঙ্গা যমুনা নর্মদা প্রভৃতি নদীগুলি বিভিন্ন নামে প্রবাহিত হয়। বিভিন্ন স্থানে তাদের রূপও ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু তারা যখন সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়, তখন পৃথক পৃথক নাম ও রূপ হারিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে একাত্ম তথা অভিন্ন হয়ে যায়। জীবও আত্মজ্ঞান লাভের পূর্বে অবস্থান করেন। তাদের শারীরিক গঠনও ভিন্ন ভিন্ন হয়। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভের পর তারা নিজের নাম ও রূপ সম্পর্কে চিন্তা করেন না। তারা যখন নিজ সংকীর্ণ গন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে পরমব্রহ্মকে লাভ করে তখন ব্রহ্মের সঙ্গেই অভিন্ন হয়ে যায়। সুতরাং ব্রহ্মজ্ঞান লাভের দ্বারাই মানুষের মধ্যে নাম- রূপ ইত্যাদি জনিত অহংকার সম্পূন্নরূপে দূর হয়।