মুণ্ডকোপনিষদ সম্পর্কে আলোচনা করে ১২ টি মন্ত্রের শব্দার্থ সহ অর্থ দেওয়া হল । মুণ্ডকোপনিষদ হল উপনিষদ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি জ্ঞানী গুরুকে খোঁজ করার গুরুত্ব, আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি, দুর্বিজ্ঞানের ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। মুণ্ডকোপনিষদ ধ্যান এবং অনুশাসনের মাধ্যমে স্পষ্ট জ্ঞানের অর্জন ও মুক্তির উপায় নির্ধারণ করে। এটি বৈদিক জ্ঞানের পথ, মনোনিগ্রহ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির উপদেশ করে।
মুণ্ডকোপনিষদ
উপনিষদ্ | উপ-নি-সদ্+ক্বিপ্ |
মুণ্ডকোপনিষদ্ এর মন্ত্র সংখ্যা | ৬৪টি |
মুণ্ডকোপনিষদ্ এর প্রথম উপদেষ্টা | ব্রহ্মা |
মুণ্ডকোপনিষদ্ কোন বেদের অন্তর্গত | অথর্ববেদ |
মুণ্ডকোপনিষদ কি?
উপনিষদ্ শব্দটি সদ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। উপ-নি-সদ্+ক্বিপ্=উপনিষদ্। সদ্ ধাতুটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা- বিনাশ করা, দেখা বা বোঝা এবং মিলিত হওয়া। তাই উপনিষদ শব্দটির অর্থ হল গুরু সমীপে বসে মিথ্যা বা অজ্ঞানতাকে দূর করে সত্য তথা আত্মাকে বোঝা।
মুণ্ডকোপনিষদ্ এর মন্ত্র সংখ্যা ৬৪টি।মুণ্ডকোপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মবিদ্যা বিষয়ক তত্ত্বের প্রথম উপদেষ্টা হলেন ব্রহ্মা, তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র অথর্বাকে এ বিদ্যা প্রদান করেন। অথর্বা অঙ্গীরা নামক এক ঋষিকে এই বিদ্যার কথা বলেন। অবশেষে ঋষি অঙ্গিরা সেই ব্রহ্মবিদ্যা ঋষি শৌণককে শুনিয়েছিলেন। মুণ্ডকোপনিষদ্ অথর্ববেদের অন্তর্গত।
মুন্ডকোপনিষদ্-এর এরূপ নামকরণ সম্বন্ধে তিনটি অভিমত প্রচলিত আছে।
- i) মন্ডপ শব্দটি মূল্য ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। যার অর্থ হল মুন্ডন করা। এই উপনিষদ অজ্ঞানতা দূর করে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো প্রজ্জ্বলিত করে। তাই এরূপ নামকরণ হয়েছে।
- ii) আবার অনেকের মতে অথর্ববেদের উপনিষদ গুলির মধ্যে এই উপনিষদটি শ্রেষ্ঠ। তাই এর নাম হয়েছে মুণ্ডক। মুণ্ড শব্দটির অর্থ হল মাথা। মাথা যেমন মানুষের শ্রেষ্ঠ অঙ্গ তেমনি এই উপনিষদটি অথর্ববেদীয় উপনিষদ গুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় এরূপ নামকরণ হয়েছে।
- iii) আবার কেউ কেউ বলেন মুন্ডক নামক ঋষি এই উপনিষদের উপদেষ্টা বলে এইরূপ নামকরণ হয়েছে।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র গুলির শব্দার্থ ও অনুবাদ
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-১
তস্মিন্(সেই ব্রহ্ম) পর-অবরে (যিনি কারনরূপে শ্রেষ্ঠ আবার কার্যরূপে নিকৃষ্ট) দৃষ্টে (তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে ) অস্য (সেই দ্রষ্টার) হৃদয়গ্রন্থিঃ (হৃদয়স্থিত কামনা বাসনা) ভিদ্যতে (বিনাশ পায়) সর্বসংশয়াঃ (সকলপ্রকার সংশয় গুলি) ছিদ্যন্তে (ছিন্ন হয়) চ কর্মণি (এবং কর্মের ফলসমূহ) ক্ষীয়ন্তে (ক্ষয়প্রাপ্ত হয়)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-২
তত্র (সেখানে অর্থাৎ সেই ব্রহ্মে) সূর্যঃ ন ভাতি (সূর্য দীপ্তি পায় না) ইমাঃ (এই সকল) চন্দ্রতারকং বিদ্যুতঃ( চন্দ্র, তারকা এবং বিদ্যুত সমূহ) ন ভান্তি(প্রকাশ পায় না) কুতঃ-অয়ম্-অগ্নিঃ(এই অগ্নি কীভাবে তাকে প্রকাশ করবে) সর্বম্(সমস্ত বিশ্বসংসার) তম্-এব(তাকেই) অনুভাতি (অনুসরন করে) ভান্তম্(প্রকাশিত হয়) তস্য ভাসা (তার দীপ্তিতে) ইদং সর্বং বিভাতি(সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়।)
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং -৩
সখায়া (পরস্পরের মধ্যে সখ্য ভাবসম্পন্ন) সযুজা(সর্বদা সংযুক্ত) দ্বা সুপর্ণা(দুটি পাখি) সমানম্ বৃক্ষম্(একই বৃক্ষকে অর্থাৎ দেহকে ) পরিষস্বজাতে(আশ্রয় করে অবস্থান করেও) তয়োঃ অন্যঃ (তাদের মধ্যে একটি) স্বাদু (মিষ্টি ) পিপ্পলম্(ফল) আত্তি (ভোগ করে) অন্যঃ(অন্য আর একটি) অন্নশন্ (কার্যফল ভোগ না করে) অভিচাকশীতি(শুধুমাত্র দেখে)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং-৪
পুরুষঃ(জীবাত্মা) সমানে বৃক্ষে নিমগ্নঃ(একই বৃক্ষে বা দেহে অবস্থান করেও) অনীশয়া(অজ্ঞানতাবশত) মুহ্যমানঃ (মোহগ্রস্ত হয়ে) শোচতি(কেবল শোক করে থাকে)। যদা (যখন সে) জুষ্টম্ (যোগীজনের দ্বারা আরাধিত) অন্যম্ ঈশম্ (ঈশ্বরের মহিমাকে দর্শন করে ) তদা (তখন) বীতশোকঃ( শোকমুক্ত হয়)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং – ৫
ক্ষীণদোষাঃ (চিত্তশুদ্ধ/দোষমুক্ত) যতয়ঃ (তপস্বীগণ) যম্ পশ্যন্তি (যাকে উপলব্ধি করেন) এষহি (এই সেই) জ্যোতির্ময়ঃ শুভ্রঃ আত্মা (জ্যোতির্ময় শুদ্ধ বা পবিত্র আত্মা) অন্তঃ শরীর (হৃদয়াকাশে ) নিত্যম্ (সর্বদা )সত্যেন তপসা-সম্যকজ্ঞানেন- ব্রহ্মচর্যেন (সত্যের দ্বারা, তপস্যার দ্বারা যথাযথ জ্ঞানলাভ ও ব্রহ্মচর্যের দ্বারা ) লভ্য( লাভের যোগ্য)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং – ৬
সত্যম্ এব জয়তে(সত্যই জয়যুক্ত হয়) ন অনৃতম্(মিথ্যা নয়) সত্যস্য পরমম্ নিধানম্(সত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়) যত্র(যেখানে আছে) তত্র (সেখানে) আপ্তকামাঃ ঋষয়ঃ (কামনা বাসনাহীন ঋষিগন) যেন হি পন্থা আক্রমন্তি (যে পথে গমন করেন) তৎ দেবযানঃ (সেই দেবযান নামক পন্থা) সত্যেন বিততঃ (সত্যের দ্বারাই আবৃত)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং – ৭
তৎ (তা অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম) বৃহৎ (মহান) দিব্যম্( জ্যোতির্ময়) অচিন্ত্যরূপম্(অচিন্তনীয়) সূক্ষ্মাৎ-সূক্ষ্মতরম্(যা, অতিসূক্ষ্ম পদার্থ থেকেও সূক্ষ্মতররূপে) বিভাতি (প্রকাশমান)। তৎ (সেই ব্রহ্ম) দূরাৎ সুদূরে (অজ্ঞানদের নিকট দূর থেকেও অতিদূরে ) চ (এবং) ইহ (এখানে অর্থাৎ এইদেহে ) অন্তিকে (জ্ঞানীদের নিকট অতিকাছে অবস্থান করে) ইহ (এই জগতে) পশ্যৎ সু( আত্মদ্রষ্টাদের ) গুহায়াম্ এব( বুদ্ধিরূপ গুহার মধ্যে) তৎ নিহিতম্( সেই ব্রহ্ম অবস্থিত)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং- ৮
এই আত্মাকে চক্ষুষা (চক্ষুর/চোখের দ্বারা) বাচা অপি (বাক্যের দ্বারাও) অন্যৈঃ দেবৈঃ( অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারা) তপসা (তপস্যার দ্বারা) বা কর্মণা(অথবা কর্মের দ্বারা) ন গৃহ্যতে( লাভ করা যায় না)। ততস্তু (সেই কারনেই কিন্তু) জ্ঞান প্রসাদেন (জ্ঞানলাভের দ্বারা ) বিশুদ্ধসত্ত্বঃ (চিত্তশুদ্ধ) ধ্যায়মানঃ ( ধ্যান-পরায়ন ব্যাক্তিগন) তম নিষ্কলম্ (সেই নিরাকার বস্তুকে ) পশ্যতে (দর্শন করতে সক্ষম হন)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং -৯
অয়ম্ আত্মা(এই আত্মা) প্রবচনেন (বহুশাস্ত্র অভ্যাসের দ্বারা ) মেধয়া (মেধার দ্বারা ) বহুনা শ্রুতেন ( বহু শাস্ত্রবাক্যশ্রবণের দ্বারাও) ন লভ্য (লভ্য হয়)। এষঃ (এই বিদ্বান) যম্ এব বৃণুতে( যাকে বরণ করেন) তেন (তার দ্বারাই ) লভ্যঃ (লাভের যোগ্য) তস্য (তার নিকট) এষঃ আত্মা( এই আত্মা) স্বাম্(নিজের) তনুম্ (রূপকে) বিবৃণুতে(প্রকাশ করেন)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং :-১০
এনম্ (এই আত্মাকে) সম্প্রাপ্য(লাভকরে) ঋষয়ঃ (তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষিগন) জ্ঞানতৃপ্তাঃ( জ্ঞানলাভের দ্বারা তৃপ্ত হয়ে)কৃত -আত্মানঃ(পরম আত্মারূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে) বিতরাগাঃ (আসক্তিহীন হয়ে ) প্রশান্তাঃ( শান্তচিত্তে প্রশান্ত হন।) যুক্ত-আত্মানঃ (পরমাত্মার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে) তে ধীরাঃ (সেই বিবেকবান ব্যাক্তিগন) সর্বগম্ (সর্বত্র বিরাজমান ব্রহ্মকে) সর্বতঃ (চারিদিকে ) প্রাপ্য (উপলব্ধি করে) সর্বম্ এব ( সবকিছুতেই অর্থাৎ ব্রহ্মেই) আবিশন্তি (প্রবেশ করেন)।
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং -১১
সন্ন্যাসযোগাৎ (সন্ন্যাস যোগের দ্বারা) শুদ্ধসত্ত্বাঃ (বিশুদ্ধিচিত্ত) যতয়ঃ (তপস্বীগন) বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিত- অর্থাঃ(যারা বেদান্ত বিষয়ে জ্ঞানলাভে সুনিশ্চিত হয়েছেন) তে সর্বে (তারা সকলেই) পরামৃতাঃ (জীবিত অবস্থাতে) পরান্তকালে(এবং দেহাবসানের পরেও ) ব্রহ্মলোকেষু(ব্রহ্মে, অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে) পরিমুচ্যন্তি(পরিপূর্ণরূপে লাভ করেন / মুক্ত হন।)
মুণ্ডকোপনিষদ মন্ত্র নং -১২
যথা (যেভাবে) স্যন্দমানাঃ নদ্যঃ (প্রবাহমান নদীগুলি) নামরূপে বিহায়(নাম এবং রূপ পরিত্যাগ করে) সমুদ্রে অস্তং গচ্ছন্তি(সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়) তথা (যেভাবেই) বিদ্বান্ (ব্রহ্মজ্ঞব্যাক্তি ) নামরূপাৎ (নাম ও রূপ হতে) বিমুক্তঃ (মুক্ত হয়ে) পরাৎ(নিরাকার অবস্থায়) পরম্ দিব্যম্( শ্রেষ্ঠ এবং স্বপ্রকাশমান) পুরুষম্ (পরমাত্মাকে ) উপেতি(লাভ করেন)।