ঋগ্বেদের দার্শনিক সূক্তগুলি মূল্যায়ণ করো। ঋকবেদের উল্লেখযোগ্য দার্শনিক সূক্তগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে মূল্যায়ন করা হল।
ঋগ্বেদের দার্শনিক সূক্তগুলি মূল্যায়ণ
উ:- ধর্মীয় চিন্তাধারা অনুসরণ করলে ঋগ্বেদের সূক্তগুলিতে দেবতাতত্ত্বের এক বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পূর্বের অবস্থা ছিল বহু দেবতাবাদ, পরে তা অতি দেবতাবাদের মধ্য দিয়ে একেশ্বর বাদে পরিণত হয়েছে। ব্যবহারিক জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থতার জন্য যে যজ্ঞীয় ধর্মকর্মের সূত্রপাত ঘটেছিল ঋগ্বেদের সংহিতার মধ্যেই তা ক্রমশ দার্শনিক জিজ্ঞাসায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাই দার্শনিক চিন্তার সূত্রপাত ঘটায়। উদাহরণ স্বরূপ নাসদীয় সূক্তকে উল্লেখ করা যেতে পারে-
” কো অদ্ধা বেদ কইহ প্রবোচৎ
কুত অজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।”
অর্থাৎ এই সৃষ্টি কোথা থেকে এলো? কে তাকে জানে? কে তা বলতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর প্রাই দশমণ্ডলের অঘমর্ষন সূক্ত তে-
“ঋতঞ্চ সত্যঞ্চা ভীদ্ধাৎ তপসোঅধ্যজায়তঃ
দিবঞ্চ পৃথিবীঞ্চান্তরিক্ষমথ স্বঃ।।”
অর্থাৎ ঋত ও সত্য, পরে রাত্রি ও সমুদ্রের উদ্ভব হয়েছে। এই সমুদ্র থেকে সংবৎসর সৃষ্টি হয়েছে। এরপর সৃষ্টিকর্তা দ্বারা চন্দ্র-সূর্য স্বর্গ মর্ত্য এবং আকাশ সৃষ্টি হয়েছে।
ঋকবেদের উল্লেখযোগ্য দার্শনিক সূক্ত
ঋকবেদের উল্লেখযোগ্য দার্শনিক সূক্তগুলি হল-
- (i) ইন্দ্রসূক্ত (২/১২)
- (ii) হিরণ্যগর্ভসূক্ত(১০/১২১)
- (iii) দেবীসূক্ত(১০/১২৫)
- (iv) রাত্রি সূক্ত(১০/১২৭)
- (v) পুরুষ সূক্ত( ১০/ ১৯০)
- (vi) নাসদীয় সূক্ত(১/১২৯)
- (vii) অস্যবামীয় সূক্ত। (১/১৬৪)
i) ইন্দ্র সূক্ত :-
ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলের ইন্দ্রসূক্ত ইন্দ্রের সর্বাতিশায়ী মহিমা প্রকাশিত হয়েছে। ঋগ্বেদের সূক্তগুলিতে ইন্দ্রদেবতার উদ্দেশ্যেই সব্বোর্চ ২৫০ টি মন্ত্র রয়েছে। এমনকি শ্রেষ্ঠত্বের বিচারেও সর্বাগ্রে। তিনি তাঁর মহিমার দ্বারা সমস্ত জগৎকে ব্যপ্ত করে রেখেছেন।
” যো জাত এব প্রথমো… স জনাস ইন্দ্রঃ’।
ii) হিরণ্যগর্ভ সূক্ত :-
ঋকবেদের দশম মন্ডলের হিরণ্যগর্ভ সূক্তটি দার্শনিক সূক্তগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বহু দেবতার অস্তিত্বে সন্ধিহান ঋষি এই সূক্তে হিরণ্যগর্ভকেই জগৎপ্রপঞ্চের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা রূপে বর্ণনা করেছেন –
” হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।”
ডঃ রাধাকৃষ্ণন এই প্রসঙ্গে বলেছেন এই মন্ত্রটিতে আমরা একেশ্বরবাদের বীজরূপে অতি দেবতাকেই পাই।
iii) দেবীসূক্ত :-
দার্শনিক সূক্তগুলির মধ্যে দেবী সূক্ত বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অনেকে একে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে মনে করেন। এই সূক্তে সর্বশক্তিময়ী পরমেশ্বরী সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর দ্বারা সমস্ত জগত নিয়ন্ত্রিত-
” অহমেব বাতইব প্রবা
ম্যারভমানা ভুবনানি বিশ্বা
পরো দিবা পর এনা পৃথি
ব্যৈতাবতী মহিমা সংবভুব।।”
অর্থাৎ আমি সকল ভুবন কে সৃষ্টি করতে করতে বায়ুর ন্যায় প্রবাহিত হই। মহিমার দ্বারা দুজনকে অতিক্রম করে, পৃথিবীকে অতিক্রম করে ইদৃশী হয়েছে।
iv) রাত্রিসূক্ত:-
রাত্রিসূক্তে রাত্রির রুপ বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে দেবী রুপিনী মহাশক্তির মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। তার কীর্তির দ্বারা তিনি সমগ্র জগতকে অন্ধকার দ্বারা আবৃত করে রাখেন এবং প্রয়োজনে তম রাশিকে দূর করেন-
” ও র্বপ্রা অমর্ত্যা নিবতো দেব্যুদ্বতঃ
জ্যোতিষা বাধতে তমঃ।।”
v) পুরুষসূক্ত:-
দশম মন্ডলের পুরুষসূক্তে তিনি বিরাট পুরুষ রূপে কল্পিত। তাঁর সহস্র শীর্ষ, সহস্রাক্ষ, সহস্রপাদ। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। পৃথিবীকে ব্যক্ত করেও তিনি তাকে অতিক্রম করে যান-
” সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষো সহস্রপাৎ
স ভূমিং সর্বতো বৃত্ত্বাত্য তিষ্ঠৎ দশাঙ্গুলম্।।”
vi) নাসদীয় সূক্ত:-
দার্শনিক সূক্তগুলির মধ্যে অতি সামান্য পরিমানে নাসদীয় সূক্তের আলোচনা থাকলেও তার ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই সূক্তে পরম আত্মার স্তুতি পরিলক্ষিত হয়। সৃষ্টি রহস্যের ব্যাকুলতা থেকে ঋষিদের অন্তরে প্রস্ফুটিত হয়েছে অসৎ থেকে সৎ এর উৎপত্তির রহস্য। যা এই সূক্তে নিপুণভাবে বর্ণিত হয়েছে।
vii) অস্যবামীয় সূক্ত:-
প্রথম মন্ডলের ১৬৪ সংখ্যক সূক্তে এই বিখ্যাত মন্ত্রটি পাওয়া যায়। যাতে বলা হয়েছে-
“একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যাগ্নিং”।
ঋকবেদের এই মন্ত্রটিতেই বহু দেবতা বাদের মধ্যে এক দেবতাবাদ অর্থাৎ একমেবাদ্বিতীয়ম্ পরম সত্ত্বাটির প্রথম সূচনা হয়েছে।
ঋগ্বেদের দার্শনিক সূক্তগুলির মূল্যয়ন
ঋগ্বেদের দার্শনিক সূক্তগুলির মূল্য অপরিসীম। এখানে ধর্মীয় চিন্তাধারার অনুসরণে দেবতাতত্ত্বের এক বিবর্তন যেমন বহুদেবতাবাদ, অতিদেবতাবাদ ও একেশ্বরবাদ লক্ষ্য করা যায়। বেদাচার্য ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য হিরণ্যগর্ভ সূক্তকে দর্শন জিজ্ঞাসার উৎস বলেছেন। এমনকি দার্শনিক সূক্তগুলি পরবর্তীকালের উপনিষদ ও বেদান্ত দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। প্রারম্ভিক পৃথিবীর অস্তিত্ব স্থাপনের জন্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দার্শনিক সূক্তগুলির মূল্য অপরিসীম।