ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয় আলোচনা করা হাল। ‘তস্মাৎ নাস্তি বেদস্য পুরুষেয়ত্বম্’ -সায়ণ ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকাতে কিভাবে এই মত প্রতিষ্ঠা করেছেন তা আলোচনা করা হল ।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয় আলোচনা
প্রশ্ন – ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয় আলোচনা কর?। ‘তস্মাৎ নাস্তি বেদস্য পুরুষেয়ত্বম্’ -সায়ণ ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকাতে কিভাবে এই মত প্রতিষ্ঠা করেছেন তা আলোচনা কর ? ।
ভূমিকা – আচার্য সায়ণ ‘ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা’ -য় বেদের পৌরুষেয়ত্ব খন্ডন পূর্বক অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাঁরা বেদ পুরুষকর্ত্তৃক রচিত (পৌরুষেয় ) স্বীকার করেন তাঁদের অভিমত হল যেমন ব্যাস কর্ত্তৃক রচিত বলে মহাভারতকে বৈয়াসিক বলা হয়। বাল্মীকি কর্ত্তৃক রচিত বলে রামায়ণকে বাল্মীকীয় বলা হয়। অনুরূপভাবে বেদভাগেরও বিশেষ বিশেষ পুরুষনামের দ্বারা নামকরণ দেখে বেদ ও তত্তৎপুরুষ কর্ত্তৃক রচিত হয়েছে ইহাই অবধারিত হয়।
বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয় এই প্রসঙ্গে বেদের পৌরুষেয়ত্ব বিষয়ক মত
- i) যেমন কাঠক পৈপ্পলাদ কৌথুম প্রভৃতি সংজ্ঞা হতে এই বেদশাখা কঠ নামক পুরুষরচিত ইহা পিপ্পলাদ নামক ব্যাক্তির দ্বারা রচিত ইহা কুথুম নামক পুরুষ রচিত এটাই প্রতীত হয়ে থাকে। পাণিনীয় ব্যাকরণ অনুসারে তৎকর্ত্তৃক রচিত এই অর্থেই কঠাদি শব্দের উত্তর তদ্ধিত ষ্ণ প্রত্যয় হয়েছে জানতে হবে। এটা স্বীকার না করিলে ঐরূপ নামকরণের সার্থকতা থাকে না।
- ii) তাছাড়া বেদে জন্ম মরণশীল মনুষ্যের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় এর দ্বারা ঐ সকলের পরবর্তীকালীন বেদ রচিত হয়েছিল, ইহা স্পষ্টতঃ উপলব্ধ হয়। নচেৎ ঐ সকল বৃত্তান্ত বেদ -এ থাকত না। যেমন- ববর প্রাবাহানি এবং কুসুরুবিন্দ ঔদ্দালকি প্রভৃতি। প্রবহনের পুত্র ববর কামনা করেছিল উদ্দালকের পুত্র কুসুরুবিন্দ কামনা করেছিল, এর দ্বারা বেদ ববরাদির পরবর্ত্তী এটাই বোঝানো হয়েছে।অতএব বেদবাক্য পৌরুষেয় (পুরুষকর্ত্তৃক রচিত) যেহেতু ইহা বাক্য, কালিদাস রচিত রঘুবংশ গ্রন্থের ন্যায়, এইরূপ অনুমান প্রমাণের দ্বারাও বেদের পৌরুষেয়ত্ব সাধন করা হয়ে থাকে।
- iii) তাছাড়া বেদে কোনো স্থলে বনস্পতিগণ যজ্ঞ করেছিল সর্পগণ যজ্ঞ করেছিল এই সমস্ত কথা শ্রুত হয়ে থাকে এর দ্বারা বেদের অপ্রামাণ্যই (অযথার্থতাই ) সিদ্ধ হয়।
কারন অচেতন বনস্পতিগণের দ্বারা এবং চেতন হলেও বিদ্যা সম্পর্কহীন সর্পগণের দ্বারা যজ্ঞ করা একেবারেই অসম্ভব কার্য। ঐ রূপ অসম্ভব অর্থের প্রতিপাদক বেদ কোনো উন্মত্তের দ্বারা রচিত অতএব, তা অপ্রমাণ (অযথার্থ) এটাই প্রতীত হয়ে থাকে। - iv) তাছাড়া ভগবান বাদরায়ণ ব্যাসদেব ‘শাস্ত্রযোগিত্বাৎ’ এই ব্রহ্মসূত্রের দ্বারা ঋগ্বেদাদি সমগ্র বেদ যে ব্রহ্মের কার্য্য তা কন্ঠতঃ স্বীকার করেছেন, এর দ্বারা বেদের অপৌরুষেয়ত্ব(ব্রহ্মরূপ পুরুষ বিরচিতত্ব) বলা যায় না। এইভাবে বেদের পৌরুষেয়ত্ব ব্যবস্থাপন কোনো সম্প্রদায় ন্যায় বৈশেষিকাদিসম্প্রদায় করে থাকেন।
বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয় এই প্রসঙ্গে পৌরুষেয়ত্ব খন্ডনপূর্বক অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিস্থাপন
তদুত্তরে বেদের অপৌরুষেয়ত্ববাদিগণের মীমাংসক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের অভিমত এই যে,
- i) কাঠক, কৌথুম পৈপ্পলাদ তৈত্তিরীয় প্রভৃতি প্রকারে বেদশাখার নাম করণ দৃষ্টে ঐ সকল শাখা তত্তৎ পুরুষবিরচিত ইহা মনে করা চলিবে না। কারণ, পাণিনীয় ব্যাকরণ অনুসারে তাঁহার দ্বারা প্রোক্ত এই অর্থেও তদ্ধিত প্রত্যয় হইয়া থাকে। তাৎপর্য এই কঠ নামক ব্যাক্তি কর্তৃক যেই শাখা কথিত বা অধ্যাপিত (উপদিষ্ট) হয়েছে কঠেন প্রোক্তম্ এই অর্থে কাঠক হয়েছে অনুরূপ কৌথুম, পৈপ্পলাদ্, তৈত্তিরীয় শব্দগুলিও সমাধান জানতে হবে।
- ii) তাছাড়া ববর প্রাবাহানি প্রভৃতি বাক্য দৃষ্টে প্রবহনের পুত্র ববর ইহা অবধারন করা চলিবে না। ঐবাক্যের অর্থ হয়েছে ববর ধ্বনিযুক্ত প্রকৃষ্ট রূপে প্রবাহিত বায়ু। অতএব, জন্ম মরণশীল মনুষ্য বৃত্তান্ত থাকায় বেদ তৎপরবর্ত্তিকালে রচিত হয়েছে তা নয়।
- iii) বনস্পতিগণ যজ্ঞ করেছিল সর্পগণ যজ্ঞ করেছিল যা বেদে উক্ত হয়েছে তা অর্থবাদ বাক্য মাত্র। তারা স্বার্থে তাৎপর্যহীন যজ্ঞের প্রশংসায় তাদের তাৎপর্য। অর্থাৎ অচেতন বনস্পতিগণ বিদ্যাহীন সর্পগণও যখন যজ্ঞ করে তখন বিদ্যাবুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণগণ তো অবশ্যই যজ্ঞ কার্য্য করবেন। এইভাবে ব্রাহ্মগণকে যজ্ঞে প্রবৃত্ত করান ঐ সকল অর্থবাদ বাক্যের প্রয়োজন। তাতেই তাদের তাৎপর্য্য স্বীকৃত হয়ে থাকে। একারণ ঐ সকল বাক্যের দ্বারা বেদ বিধির বেদের প্রামাণ্য ক্ষুণ্ণ হয় না।
- iv) বাদরায়ণ ব্যাসদেব বেদান্ত দর্শনে ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ ‘ সূত্রের দ্বারা সমগ্র বেদ ব্রহ্মের কার্য্য যাহা বলেছেন তার দ্বারা বেদ মনুষ্যরূপ পুরুষ রচিত তা বোঝা যায় না। তা ব্রহ্ম রচিত -এটাই বোঝা যায়। কিন্তু ব্রহ্ম মনুষ্যরূপ পুরুষ না হওয়ায় বেদের অপৌরুষেয়ত্বই সিদ্ধ হয়ে থাকে।
সিদ্ধান্ত বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
বেদের অপৌরুষেয়ত্ববাদিগণ এই সকল যুক্তির দ্বারা বেদ যে কালিদাসাদিরচিত কাব্য গ্রন্থের ন্যায় বিরচিত নয় এবং তা জন্ম মরণশীল মনুষ্য বৃত্তান্তের জ্ঞাপক নয় এবং অপ্রমাণ (অযথার্থ) নয়, এটাই প্রতিপন্ন করেন।
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদের অনুবন্ধ
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে প্রমার উপস্থাপন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন