” স্বপ্নবাসবদত্তম্ ” নাটকের পঞ্চম অঙ্কের স্বপ্নদৃশ্যের নাটকীয় তাৎপর্য বর্ণনা দাও।
উ:- সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে কালিদাসের পূর্বযুগের কবিদের মধ্যে প্রথিত যশা নাট্যকার ভাসের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মহাকবি ভাস যে সব নাটক রচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্ ‘। এই নাটকে নাট্যকার যে সকল ঘটনার পরিচয় দিয়েছেন তাদের কোনোটিই অপ্রাসঙ্গিক নয়। বিশেষত, ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকের পঞ্চম অঙ্কে উদ্ধৃত বৎসরাজ উদয়নের স্বপ্নবৃত্তান্তটি গভীর নাটকীয় তাৎপর্য বহন করে। ভাস সম্বন্ধে বিখ্যাত গদ্যকবি বাণভট্ট তাঁর রচিত হর্ষচরিত ভাসের যশোলাভের কথা বলেছেন-
” সূত্রধারকৃতারম্ভৈর্নাটকৈর্বহুভূমিকৈঃ।
সপতাকৈর্যশোলেভে ভাসো দেবকুলৈরিব।।”
প্রাকৃত ভাষায় কবি বাক্ পতিরাজ তাঁর প্রসিদ্ধ ‘গৌড়বহ’ কাব্যে ভাসকে ‘জ্বলনমিত্র’ অর্থাৎ আগুনের বন্ধু বলেছেন। নাট্যকার জয়দেব তাঁর ‘প্রসন্নরাঘব’ নাটকে ভাসকে সরস্বতীর নির্মল হাসের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-
“ভাসো হাসঃ কবিকুলগুরুঃ কালিদাসো বিলাসঃ।”
ভাসের নাটকগুলোর মধ্যে ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকটি যে সমালোচনার আগুনে দগ্ধ হয়নি রাজশেখর তাঁর রচিত সূক্তিরত্নাবলীতে বলেছেন-
” ভাসনাটকচক্রেঅপি ছেকৈঃ ক্ষিপ্তে পরীক্ষিতুম্।
স্বপ্নবাসবদত্তস্য দাহকোঅভূন্ন পাবকঃ।।”
অর্থাৎ ভাসের নাটক সমূহ সমালোচনার অগ্নিতে দগ্ধ হলেও ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকটির সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।
এখন বিচার্য বিষয় হল এই যে, স্বপ্নদৃশ্যটি আলোচ্য নাটকের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা কিনা? নাটকের বিষয়বস্তুর পর্যালোচনা করলে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, রাজনীতি এর মূল কেন্দ্রে রয়েছে। পরাক্রান্তা শত্রুতে পরাজিত করার জন্য রাজার বিচক্ষণ, কূটনীতিও মন্ত্রী যৌগন্ধরায়নের দ্বারা বলবান প্রতিবেশী মগধ রাজ্যের রাজা দর্শকের ভগিনী পদ্মাবতীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের মাধ্যমে রাজ্য রক্ষার বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পেয়েছে।
রাজ্যরক্ষার জন্য বৎসরাজ পুনরায় মগধরাজ দর্শকের ভগিনী পদ্মাবতীকে বিবাহ করা সত্ত্বেও বাসবদত্তার প্রতি তাঁর প্রণয় আগের মতই গভীর ও নিবিড় ছিল।
” কা ভবতঃ প্রিয়া তদানীং তত্রভবতী বাসবদত্তা ইদানীং পদ্মাবতী বা?
বয়স্য বসন্তকের এই প্রশ্নের উত্তরে রাজা উদয়ন বলেছিলেন-
“পদ্মাবতী বহুমতা মম যদ্যপি রূপশীলমাধুযৈঃ।
বাসবদত্তা বদ্ধং ন তু তাবন্মে মনো হরতি।।”
অর্থাৎ রূপ, শীল ও মাধুর্যে পদ্মাবতী আমার কাছে অত্যন্ত আদরনীয়া হলেও বাসবদত্তার প্রতি বদ্ধ আমার মনকে হরণ করতে পারেনি।
পঞ্চম অঙ্কে স্বপ্নে দেখা বাসবদত্তার সঙ্গে কথোপকথনের পর তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন বাসবদত্তা জীবিত আছেন। স্বপ্নের ঘোরে উদয়ন বাসবদত্তাকে দেখে এই দৃঢ় প্রত্যয়ে অবস্থিত হয়েছেন যে বাসবদত্তার প্রসাধহীন মুখ দেখে তাঁর চারিত্রিক সততা সম্পর্কেও নিঃসন্ধেহ হয়ে রাজা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বলেছেন-
“হা প্রিয়ে! হা প্রিয়শিষ্যে! দেহি মে প্রতিবচনম্।”
পরক্ষণে উদয়নের নিদ্রাভঙ্গ হলে বিদূষককে জানালেন বাসবদত্তা জীবিত আছেন-
” শয্যায়াম্ বসুপ্তং মাং বোধয়িত্বা সখো গতা।
দগ্ধেতি ধ্রুবতা পূর্বং বঞ্চিতঅস্মি রুমন্বতা।।”
রাজা উদয়ন সকল সময় বাসবদত্তার চিন্তায় মগ্ন থাকায় এই স্বপ্ন দেখেছেন বিদূষক মনে করিয়ে দিলে রাজা বলেন এ যদি স্বপ্ন হয় তা যেন চিরদিন সঙ্গী হয়ে থাকে-
” যদি তাবদয়ং স্বপ্নো ধন্যমপ্রতিবোধনম্
অথায়ং বিভ্রমো বা স্যাদ্ বিভ্রমোহ্যস্তু মেচিরম্।।”
বিদূষকের বিশ্বাস হচ্ছিল না বলে সে রাজার কথায় বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলেন সেই নগরে বাসবদত্তা নাম্নী যক্ষিনী বাস করে। রাজা হয়তো নিদ্রার ঘোরে তাকেই দেখেছেন। কিন্তু রাজা বারবার বিদূষককে বোঝাতে চাইলেন যে তিনি জাগরিত হয়ে বিরহব্রত ধারিনী বাসবদত্তাকেই দেখেছেন-
“স্বপ্নস্যান্তে বিবুদ্ধেন নেত্রবিপ্রোষিতাঞ্জণম্।
চারিত্রমপি রক্ষন্ত্যাঃ দৃষ্টং দীর্ঘালকং মুখম্।।”
এর পরবর্তী সময়ে শত্রু আরুনির বিরুদ্ধে উদয়ন যুদ্ধযাত্রায় উদ্যেগী হলেন। এখানেই পঞ্চম অঙ্কের পরিসমাপ্তি।
নাটকীয় ঘটনা বিন্যাসে এমনকি নাটকটির গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্যও এই স্বপ্নদৃশ্যের অবতারনার পওয়োজন ছিল।
স্বপ্নদৃশ্যের মধ্য দিয়ে রাজা উদয়ন বিরহব্রতধারিনী বাসবদত্তাকে দেখেছিলেন যার ফলস্বরূপ বাসবদত্তাকে গ্রহণ করার সময় তার চরিত্র বিষয়ে কোনোরূপ প্রশ্ন উদ্ধৃত হয়নি, এখানেই স্বপ্নদৃশ্যের তাৎপর্য।
রাজা উদয়নের হৃতরাজ্য পুনরূদ্ধারের জন্য বাসবদত্তা ও উদয়নের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলেও এই স্বপ্নদৃশ্যটি তাদেরকে পুনর্মিলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
একথা বলা যেতে পারে যে উদয়ন ও বাসবদত্তার চরিত্রের উপর স্বপ্নদৃশ্যের কিছুটা প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‘ নাটকে অভিজ্ঞান অঙ্কুরীয় কথা যেমন সমগ্র নাটকীয় কাহিনীর উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, চরিত্রের স্বপ্নদৃশ্যের সেরূপ কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। তবুও স্বপ্নবৃত্তান্তটি ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকের মিলনান্তক পরিণতির পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন।
সমালোচকদের মতে ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নামকরণটিতে নায়িকার নাম বাসবদত্তা থাকলেও নাটকীয় ঘটনার স্বপ্ন সম্পর্কীত দৃশ্যের উল্লেখ না থাকলেও কোনো হানি হত না অর্থাৎ উদয়ন স্বপ্নে বাসবদত্তাকে না দেখলেও নাটকটি পরিণতি লাভ করতে পারত একথা অকুন্ঠ চিত্তে বলে যায় না।