আত্মবোধপ্রকারণ : আত্মার একত্ব প্রতিপাদন

আত্মার শ্রুতিসিদ্ধ একত্ব ও অপরিচ্ছিন্নত্বকে ‘আত্মবোধ’ গ্রন্থানুসারে যথাশক্তি প্রতিপাদন কর। আত্মবোধপ্রকারণঅনুসারে আত্মার একত্ব প্রতিপাদন কর । Proving the oneness of the soul in bengali.

আত্মার একত্ব প্রতিপাদন : আত্মবোধপ্রকারণ

স্বমায়াকল্পিত মন ইত‍্যাদি নানা উপাধিতে প্রতিবিম্বিত হয়ে নানারূপে আত্মা প্রতিভাত হন। যদিও এই ভেদ কল্পিত। কল্পতরু গ্রন্থে বলা হয়েছে। অবিদ‍্যার কারনেই আত্মার জীবভাবের বন্ধন হয়। এই অবস্থায় আত্মার বহুত্ব ও প্রাদেশিক বুদ্ধি হয়ে থাকে। সুতরাং, ব‍্যবহারিক অবস্থায় আত্মার এই বহুত্ব বুদ্ধি কাল্পনিক মাত্র। তাই তাত্ত্বিক নয়, ভ্রান্ত। ব্রহ্ম ও আত্মার একত্ববিজ্ঞান হলে মায়াকল্পিত উপাধির নাশ হয়। আর তখনই নিরুপাধিক আত্মার অবস্থান সম্ভব হয়।

আত্মবোধপ্রকরণ গ্রন্থে শঙ্কর বলেছেন-

“যথাকাশো হৃষীকেশো নানোপাধিগতো বিভুঃ।
তদ্ ভেদাদ্ ভিন্নবদ্ ভাতি তন্নাশে কেবলোভবেৎ”।।

আলোচ‍্য শ্লোকস্থ ‘হৃষীকেশ’ শব্দে পরমাত্মা বিবক্ষিত হয়েছে। ‘ হৃষীক’ শব্দের অর্থ বিষয়গ্রাহক ইন্দ্রিয়। মন প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের কামসংকল্পাদি ব‍্যাপারের যিনি প্রবর্তক তিনিই হৃষীকেশ।

শরীর, ইন্দ্রিয়, মন ইত‍্যাদি মায়াকল্পিত উপাধিবশত আত্মা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতীত হওয়ায় বহু ও প্রাদেশিক বলে আপাতপ্রতীত হয়। অনাদি অজ্ঞানের নাশে ঐ ঐ উপাধির নাশ হলেই আত্মা এক – অভিন্ন রূপে প্রকটিত হয়।

আশঙ্কা হতে পারে, ঐক‍্য শব্দটি দ্বৈতসাপেক্ষ। কিন্তু আত্মা এক ও অদ্বিতীয়। তার আবার ঐক‍্য কিভাবে সম্ভব?

সমাধানে বলা হয়েছে, অখন্ডত্ববোধক ঐক‍্য বাস্তবিক দ্বিত্বসাপেক্ষ নয়। অখন্ড বস্তর বিষয়ে কল্পিত দ্বিত্বের দ্বারা এই ঐক‍্য সম্পাদিত হয়। যেমন- গৃহ প্রভৃতি উপাধিবশত গৃহাকাশ ও মহাকাশের মধ‍্যে দ্বিত্ব কল্পিত হয়। পরে গৃহের ধ্বংসে গৃহাকাশ ও মহাকাশের মধ‍্যে দ্বিত্ব ব‍্যবহার না হওয়ায় গৃহাকাশ ও মহাকাশের মধ‍্যে ঐক‍্য সুনিশ্চিত হয়।

এই ঐক‍্য বাস্তবিক দ্বিত্বের কারনে নয়, কল্পিত দ্বিত্বের কারনে। প্রকৃতপক্ষে, কিন্তু আকাশের অখন্ডত্ব এবং একত্বই সকলের কাছে পরিজ্ঞাত। এইভাবে অবিদ‍্যার নাশ হলে জীব ও ব্রহ্মের ভেদ ব‍্যবহারের যে অভাব সিদ্ধ হয়, তাকেই বোঝাতে জীব ও ব্রহ্মের মধ‍্যে ঐক‍্য শব্দের প্রয়োগ করা হয়। ঐক‍্য শব্দের অভিধেয়ত্ব ব্রহ্মে তত্ত্বগতভাবে সিদ্ধ হয় না। শ্রোতাদের বোধের জন‍্যই ব‍্যবহৃত হয়।

জীব ও ব্রহ্মের এই দুরবগাহ ঐক‍্যতত্ত্বকে যে মননশীল ব‍্যাক্তি ছান্দ‍োগ‍্যোপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’, বৃহদারণ‍্যোপনিষদের ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ ইত‍্যাদি বেদান্ত বাক‍্যরাশি অপরোক্ষভাবে সম‍্যক্ অনুভব করেন, জীবব্রহ্মের ঐক‍্যবিষয়ে কোনো সংশয় অনুভব করেননা। তিনিই প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী।

আত্মার অপরিচ্ছিন্নত্ব প্রতিপাদন:

আত্মাকে যারা শরীরনিষ্ট বলে মনে করেন, তারা আত্মাকে পরিচ্ছিন্ন বলেন। তবে যে ‘আমি’ শব্দের ব‍্যবহার মানুষমাত্রেই প্রতিনিয়ত করে তাতে আত্মার পরিচ্ছিন্নত্বের একটি প্রতিভাস অসম্ভব নয়। আমার বুদ্ধি, আমার অনুভব ইত‍্যাদি বাক‍্যবন্ধের ব‍্যবহারে আস্তিক – নাস্তিক, বিদ্বান-অবিদ্বান সকলেই এই মিথ‍্যাবোধে আক্রান্ত হন

ত্রিকালদ্রষ্টা সত‍্যস্বরূপ ঋষিদের অনুভব অবশ‍্য ভিন্ন। উপনিষদের সর্বোচ্চ তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে আত্মা অপরিচ্ছিন্ন। আত্মার বাস্তবিক কোনো ভেদ নেই। সকলের স্বরূপভূত নিত‍্য অনতর্যামী এই আত্মা। বিদ‍্যারণ‍্যমুনির পঞ্চদশী গ্রন্থকে অনুসরন করে বলা যেতে পারে আত্মা সর্বব‍্যাপী বিভু। তাই আত্মার দেশগত কোনো পরিচ্ছেদ নেই। অনাদিনিধন আত্মা ত্রৈকালিক নিত‍্য বলে তার কালগত পরিচ্ছেদও নেই। আত্মা দেশকালাদি – অপরিচ্ছিন্ন অনন্ত অসীম।

আত্মার পরিচ্ছিন্নত্ব প্রতিপাদন:

আত্মাকে যে পরিচ্ছিন্ন মনে করা হয়, তার কারন অজ্ঞান। এক ও অখন্ড মহাকাশকে যেমন ঘট, পট প্রভৃতি উপাধিবশত বহু ও পরিচ্ছিন্ন বলে ভ্রম হয়,তেমনি অজ্ঞান ও শরীর ইত‍্যাদি উপাধির কারণে আত্মা পরিচ্ছিন্ন বলে প্রতীত হন।

আচার্য শঙ্কর ‘আত্মবোধপ্রকরণ’ গ্রন্থে ইতস্তত চমৎকার সব দৃষ্টান্তের অবতারনা করেছেন-

সূর্য যেমন মেঘে ঢাকা পড়লে দৃষ্টির অগোচর থাকে, তেমনই আত্মতত্ত্বের স্বরূপও অজ্ঞানের আবরনে আবৃত থেকে অনেকের কাছে অপ্রকাশিত থাকে। মেঘ সরে গেলে স্বয়ং প্রকাশ সূর্যের কিরণ দীপ‍্যমান হয়। সেইভাবে আত্মার সম‍্যক্ জ্ঞানে আত্মবিষয়ক অজ্ঞানের আবরণ উন্মোচিত হলে আমরা আত্মচৈতন‍জ‍্যোতির স্পর্শ পাই।

এইভাবে আচার্য‍্য স্বপ্রণীত আত্মবোধ গ্রন্থে এক ও অদ্বিতীয় আত্মার অপরিচ্ছিন্নত্বকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন-

“পরিচ্ছিন্ন ইবাজ্ঞানাত্তন্নাশে সতি কেবলঃ।
স্বয়ং প্রকাশতে হ‍্যাত্মা মেঘাপায়েঅংশুমানিব।।”


এই মর্মার্থ ব‍্যাখ‍্যায় মহামতি সরস্বতী লিখেছেন –

” বিবেকেন অবিবেকেহানাৎ আত্মা কেবল এব প্রকাশতে মেঘাবরণাভাবে ভানুবদ্ ইত‍্যর্থঃ”।

Comments