আত্মবোধপ্রকরণ: অজ্ঞানের দূরীকরণ বা নিরাকরণ কিভাবে সম্ভব?

অজ্ঞানের দূরীকরণ বা নিরাকরণ কিভাবে সম্ভব? আত্মবোধপ্রকরণ, এম.এ

অজ্ঞানের দূরীকরণ বা নিরাকরণ কিভাবে সম্ভব? আত্মবোধপ্রকরণ

উঃ- অনাদিকাল থেকেই অজ্ঞানকবলিত জীব জন্মান্তরীণ কর্মানুরোধে পুনঃ পুনঃ নানাবিধ জন্মলাভ করে ভয়ঙ্কর দুঃখাগ্নিজ্বালায় নিয়ন্তর নিপীড়িত হয় এবং অসহনীয় আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দুঃখরাশি প্রশমণের জন্য লৌকিক ও বৈদিক কর্মকে উপায় রূপে নির্বাচন করে। কিন্তু ফল আকাঙ্ক্ষা প্রযুক্ত অশাস্ত্রীয় ও শাস্ত্রীয় কোনো কর্মই দুঃখ গুলিকে কখনোই অত্যন্ত উচ্ছেদ করতে পারে না। কেননা জন্মই দুঃখের কারণ। আর জন্মের কারণ আত্মবিষয়িণী অবিদ্যা। সুতরাং অবিদ‍্যার সমূলে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত দুঃখের একান্ত উচ্ছেদ ও অত্যন্ত উচ্ছেদ সম্ভব হবে না।

একমাত্র জ্ঞানই হবে বন্ধন উপাদান মূল অজ্ঞানের বিনাশক। এখানে জ্ঞান শব্দে আত্মবিষয়ক অপরোক্ষ নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানই বিবক্ষিত। বক্তব্য এই কর্ম ও জ্ঞান সমুচ্চিত কর্ম অবিদ্যার নাশক হতে পারে না। কেননা, কর্ম অবিদ‍্যাসম্ভূত।

অবিদ‍্যা যার সাধক, সেটি অবিদ‍্যার নাশক হবে কি করে? ‘যৎ যস‍্য সাধকং ন তত্তস‍্য নিবর্ত্তকম্’। অর্থাৎ অবিদ‍্যাই কর্মের উপজীব্য, কর্ম যদি বিচিত্র শক্তির প্রভাবে অবিদ‍্যার বিনাশক হয়, তবে স্বোপজীব্যবিরোধহেতু কর্ম নিজের বিনাশরই হেতু হয়। আর অবিদ্যামূলক হওয়ার কর্ম অবিদ‍্যাত্মকই হবে। অতএব, অবিদ‍্যার সঙ্গে কর্মের সহাবস্থান ঘটায় কর্ম অবিদ‍্যার বিরোধী হতে পারে না। তাই কর্ম অবিদ‍্যার বিনাশক হবেনা। ফলত কর্ম বন্ধন নাশের হেতু হবেনা। বলা বাহুল্য, কর্ম বলতে এখানে সকাম কর্মই বিবক্ষিত। কামনা বা ফলাসক্তি বন্ধনেরি কারণ হয়। সুতরাং কাম্য কর্ম গুলি বেদবিহিত হলেও বন্ধনেরই হেতু হওয়ায় মোক্ষের পরিপন্থী হয়। একারণে নিষিদ্ধ কর্মের ন‍্যায় কাম্য কর্মও মুমুক্ষুগণের বর্জনীয়।

আরো কথা, মীমাংকসম্মত বিদ্যাসহিত কর্মও অবিদ‍্যার নাশক হবে না। সেখানে বিদ্যা বলতে দেবতার স্বরূপ বিদ্যা। দেবতার স্বরূপবিদ‍্যা অবিদ্যাই হবে। কেননা আত্ম বিদ্যা ছাড়া সমস্তবিদ্যাই অবিদ‍্যার অন্তর্গত। সুতরাং বিদ্যাসহিত কর্মও অবিদ‍্যার বিরোধী নয়। তাই তো অবিদ্যা নাশক হয় না। একমাত্র আত্মবিদ্যাই বিদ্যা। এই বিদ্যার সঙ্গে অবিদ্যার সহাবস্থান না হওয়ায় আলো ও অন্ধকারের মতো এই বিদ‍্যাই অবিদ‍্যার বিরোধী। তাই আলোর আগমনমাত্রে অন্ধকার যেমন বিধ্বস্ত হয়, তেমনি বিদ‍্যার আবির্ভাবই অবিদ‍্যা তিরোহিত হয় , তেমনি বিদ‍্যার আবির্ভাবই অবিদ‍্যা তিরোহিত হয়।

এই অভিপ্রায়েই আচার্য শঙ্কর বলেছেন-

“অবিরোধিতয়া কর্ম নাবিদ‍্যাং বিনিবর্ত্তয়েৎ।
বিদ‍্যাঅবিদ‍্যাং নিহন্ত‍্যেব তেজস্তিমিরসংঘব‍ৎ।।”

অর্থাৎ কর্ম অবিদ‍্যার অবিরোধী হওয়ায় অবিদ‍্যাকে বিনাশ করতে পারে না। পক্ষান্তরে বিদ‍্যাই অবিদ‍্যার বিরোধী হওয়ায় অবিদ‍্যাকে বিনাশ করে, যেমন- অন্ধকারের বিরোধী হওয়ায় আলো ঘন অন্ধকারের ধ্বংস করে, তেমনই এখানে বুঝতে হবে।

সুতরাং, শাস্ত্রকারেরা কর্মকে বন্ধনেরই কারণ বলেছেন। আর একমাত্র জ্ঞানকেই বলেছেন মুক্তির কারণ। তাই তত্ত্ববিদগণ কর্মমার্গকে পরিত‍্যাগ করে জ্ঞানমার্গকেই অবলম্বন করতে নির্দেশ করেছেন।

স্বয়ং বেদব‍্যাস বলেছেন-

“কর্মণা বধ‍্যতে জন্তুর্বিদ‍্যয়া চ বিমুচ‍্যতে।
তস্মাৎ কর্ম ন কুর্বন্তি যতয়ঃ পারদর্শিনঃ।।”

তত্ত্ববুভূৎসুগণের অনুসন্ধেয় এই যে, আচার্য‍্য শঙ্করের মতে, ভূমিকর্ষণজনিত সংস্কার যেমন কেবল বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপত্তির প্রতিই কারণ হয় না, বৃক্ষের সকল সমৃদ্ধির প্রতিও কারণ হয়, তেমনই যজ্ঞদান প্রভৃতি কর্ম নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠিত হলেও কেবলমাত্র বুদ্ধির প্রত‍্যক্ প্রবণতারূপ বিবিদিষা বা জ্ঞানোৎপত্তির প্রতি কারণ হয়না, বেদনেরও প্রতি কারণ হয়।

বহু জন্ম ধরে ঈশ্বর প্রীত‍্যর্থে অনুক্ষণ নিরভিসন্ধি যজ্ঞাদি কর্মসাধনা করলে ঈশ্বর অনুগ্রহে তত্ত্ববিবিদিষা হয় এবং তাদৃশ তপঃ কর্মসম্ভূত অদৃষ্টবশত সদগুরুর সান্নিধ‍্য লাভ ও তত্ত্বশ্রবণাদিক্রমে অবশ‍্যই ব্রহ্মজ্ঞান হয়। এইভাবে নিষ্কাম যজ্ঞাদি কর্ম চিত্তশুদ্ধির মাধ‍্যমে জ্ঞানোৎপত্তি ও জ্ঞান উভয়েরই সাধন হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, জ্ঞানমার্গী শংকর কর্মমার্গের একান্ত বিরোধী হলেও জ্ঞান ও মোক্ষের অভিব‍্যক্তিতে নিষ্কাম কর্মের অপরিহার্যতাকে একান্তরূপে অঙ্গীকার করেছেন।

Comments