সংস্কৃত ভাষায় বৈজ্ঞানিক (প্রযুক্তিগত) সাহিত্যের একটি ধারনা দাও। ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস আলোচনা করা হল । Discuss the history of Indian science and technology in Sanskrit.
সংস্কৃত ভাষায় প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সাহিত্যের একটি ধারনা
কৌটিল্যের মতে, বিদ্যার শাখা চারটি- আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা, দন্ডনীতি। পরবর্তীকালে তাত্ত্বিকগন কর্তৃক বিন্যাস নিম্নরূপ-
বিদ্যা- দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, শিল্প, ধর্ম।
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সাহিত্যের একটি ধারনা বা অন্যান্য বিদ্যার পরিধি
সুপ্রাচীন ভারতবর্ষেও জ্ঞানের সর্ববিধ শাখায় অকল্পনীয় মাত্রায় উন্নতি ঘটেছিল। সংস্কৃত ভাষায় বৈজ্ঞানিক (প্রযুক্তিগত) সাহিত্যের একটি ধারনা দাও। ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস আলোচনা করা হল । Discuss the history of Indian science and technology in Sanskrit আমাদের আলোচ্য প্রশ্ন অনুযায়ী কাব্যের পরিধি থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান সংক্রান্ত বা অন্যান্য বিদ্যার পরিধি এখানে আলোচিতব্য। এর বিভিন্ন শাখা গুলি হল-
১) আয়ুর্বেদ বা চিকিৎসাশাস্ত্র
- i)অশ্বিনীকুমারদ্বয় রচিত ‘অশ্বিনীসংহিতা’ ও ‘নাড়ীনিদান’,
- ii) শিবরচিত ‘কৈলাশকারক’ ও ‘বৈদ্যরাজতন্ত্র’
- iii) চক্রপানিদত্ত রচিত ‘শৈবসিদ্ধান্ত’।
আরো পড়ুন বিস্তারিত – প্রাচীন ভারতে আয়ুর্বেদচর্চার পরিচয়
পুরানে প্রাচীন আর্যদের কিছু রচনা উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন-
- i) ধন্বন্তরি রচিত ‘চিকিৎসাতত্ত্ব বিজ্ঞান,
- ii) দিবোদাস রচিত ‘চিকিৎসাদর্শন’,
- iii) নকুল রচিত ‘বৈদ্যকসর্বজ্ঞ’,
- iv) কাশীরাজ রচিত ‘চিকিৎসাকৌমুদী’।
আত্রেয় প্রবর্তিত চরকসংকলিত চরকসংহিতা প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের সম্পূর্ণ অনবদ্য রচনা। শল্যচিকিৎসা সংক্রান্ত প্রামাণ্যসংকলনটির নাম সুশ্রুতসংহিতা। প্লাস্টিকসার্জারী সংক্রান্ত আলোচনাও এখানে আছে।
চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভাজনগুলি পুনরায় নিম্নরূপ-
- ক. শারীরতত্ত্বঃ- ভাস্করভট্ট রচিত ‘শারীরপদ্মিনী’।
- খ. নিদানঃ- বিজয়বক্ষিত প্রণিত ‘ব্যাখ্যানুমধুকোষ’।
- গ. ভৈষজ্যতত্ত্বঃ- রাজবল্লভ রচিত ‘দ্রব্যগুন’।
- ঘ. কৌমারভৃত্যঃ- রাবন রচিত ‘কুমারভৃত্য’।
- ঙ. স্বাস্থ্যতত্ত্বঃ- গোবিন্দরায় রচিত ‘ স্বাস্থ্যতত্ত্ব’।
- চ. পথ্যতত্ত্বঃ- সুষেন রচিত ‘অন্নপানবিধি’।
- ছ. নারীবিজ্ঞানঃ- শঙ্কর সেন রচিত ‘নাড়ীপরীক্ষা’।
২) জ্যোতির্বিদ্যা
ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের অন্তর্গত ‘বেদাঙ্গজ্যোতিষ’ প্রাচীনতম উৎস। তবে প্রাচীন ভারতে সবথেকে বড় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের তার তিনটি রচনা পাওয়া যায়- ‘আর্যভট্টীয়’, ‘আর্যাষ্টশতক’ এবং ‘দশগীতিকাসূত্র’।
এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল-
- i) বরাহমিহির রচিত ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’।
- ii) ব্রহ্মগুপ্তের ‘ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত’ ও ‘খন্ডখাদ্যক’।
- iii) ভাস্করাচার্যের ‘সিদ্ধান্তশিরোমনি’,
- iv) দ্বিতীয় আর্যভট্ট রচিত ‘আর্যসিদ্ধান্ত’,
- v) ভোজরাজ রচিত ‘রাজমৃগাঙ্গ’।
৩) ফলিতজ্যোতিষ
জ্যোতিষশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ট গ্রন্থ বৃহৎসংহিতার আলোচ্য বিষয় অষ্টগ্রহ ও ফল, রাশি সঞ্চরন, বর্ষফল, আবহবিদ্যা, প্রানীবিদ্যা, ভূবিদ্যা, স্থাপত্য ইত্যাদি।
- i) বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’, ‘বৃহৎজাতক ‘ ইত্যাদি।
- ii) ভট্টোৎপল রচিত ‘হোরাশাস্ত্র’।
- iii) রঙ্গনাথ রচিত ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’।
- iv) নরহরি রচিত ‘নরপতিজয়চর্চাস্বরোদয়’।
৪) গনিতবিদ্যা
- i) ব্রহ্মগুপ্ত ও ভাস্করাচার্য রচিত ‘গনিতজ্যোতিষেরগ্রন্থ’।
- ii) মহাবীর রচিত ‘গনিতসারসংগ্রহ’।
- iii) শ্রীনিবাস রচিত ‘গনিতচূড়ামনি’।
- iv) নারায়ণ রচিত ‘গনিতকৌমুদী’।
৫) কিমিয়াবিদ্যা
- i) নার্গাজুন রচিত ‘রসরত্নাকর’।
- ii) গোবিন্দ রচিত ‘রসহৃদয়’।
- iii) বাগভট্ট রচিত ‘রসরত্নসমুচ্চয়’।
- iv) ঢুন্ডুকনাথ রচিত ‘রসেন্দ্রচিন্তামনি’।
৬) রসায়নবিদ্যা
বিবিধ রোগের চিকিৎসায় জারণ, শোধন ইত্যাদি প্রক্রিয়া, আরোগ নিষ্কাশন, খার ও অম্লপাতন ইত্যাদি প্রক্রিয়া রসায়ন শাস্ত্রের অন্তর্গত ছিল। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়- “ A History of Hindu chemistry (pdf) ” গ্রন্থে বহুগ্রন্থের উল্লেখ আছে।
- i) সোমদেব রচিত ‘রসেন্দ্র চূড়ামনি’।
- ii) গোবিন্দচার্য রচিত ‘রসসার’।
- iii) দেবদত্ত রচিত ‘ধাতুরত্নমালা’।
- iv) মাধব রচিত ‘রসকৌমুদী’।
৭) ধাতুবিদ্যা
প্রাচীন ভারতবর্ষে ধাতুবিদ্যার অবিশ্বাস্য উন্নতি হলেও কোন রচনা উপলব্ধ হয়নি, কেবল তিনটি গ্রন্থের নাম উল্লেখিত আছে।
- i) লৌহার্নব,
- ii) লৌহপ্রদীপ,
- iii) খড়্গশাস্ত্র।
৮) সুরাপাতনবিদ্যা
‘চরকসংহিতা‘ গ্রন্থে ৮৪ রকম মদ্যের নাম ও প্রকারভেদ আলোচিত হয়েছে। মল্লিনাথের টীকায় ‘মদিরার্নব’ বই-এর উল্লেখ আছে।
৯) রত্নবিদ্যা
রত্নের ব্যবহার ও অনুশীলন তথা প্রভাব প্রাচীনকাল থেকে চর্চিত। গরুড় পুরানে ‘রত্নপরীক্ষা’ নামে একটি অধ্যায় আছে।
অন্যান্য গ্রন্থ-
- i) বুদ্ধভট্ট রচিত ‘রত্নপরীক্ষা’।
- ii) ‘রত্নসংগ্রহ’ (লেখক অজ্ঞাত)।
- iii) মনিমাহাত্ম্য।(লেখক অজ্ঞাত)।
১০) প্রাণীবিদ্যা
ত্রয়োদশ শতকে হংসদেব রচিত ‘মৃগপক্ষিশাস্ত্র’ নামক ১৭১২ টি শ্লোকে পশুপাখি বিষয়ক বহু তথ্য আছে।
১১) ভূগোল
বিবিধ পুরাণে ভূগোল বৃত্তান্ত পরিচ্ছেদে ভূগোল তত্ত্ব সম্পর্কিত বহু আলোচনা আছে। বলরাম দাস রচিত ‘ব্রহ্মাণ্ডভূগোল’ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বিষ্ণু, বায়ু ও কূর্মপুরাণে কিছু কল্পনা থাকলেও ভৌগোলিক তত্ত্বগুলি গুরুত্বপূর্ণ।
১২) অস্ত্রবিদ্যা
বিক্রমাদিত্য, সদাশিব (শার্ঙ্গদত্ত) প্রভৃতি আচার্যগন ধনুর্বিদ্যার গুরু ছিলেন। (বশিষ্টের নামে ধনুর্বেদ সংহিতা নামক গ্রন্থ প্রচলিত আছে)। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণসমূহে ধনুর্বান ভিন্ন অসংখ্য অস্ত্রের উল্লেখ আছে।
১৩) স্থাপত্য ও ভাস্কর্যবিদ্যা
- i) কাশ্যপ রচিত ‘শিল্পশাস্ত্র’।
- ii) শ্রীকুমার রচিত ‘শিল্পরত্ন’।
- iii) মন্ডন রচিত ‘রূপমন্ডল’।
১৪) পাকশাস্ত্র
- i) নল রচিত ‘ নলপাক’।
- ii) মনিরাম শর্মা রচিত ‘পাকবিজ্ঞান’।
- iii) কৃষ্ণপ্রসাদ রচিত ‘বৃহৎপাকসংগ্রহ’।
১৫) প্রযুক্তবিদ্যা
- i) ভোজ রচিত ‘সমরাঙ্গন সূত্রধার’।
- ii) ভরদ্বাজ রচিত ‘আশুবোধিনী’।
১৬) প্রসাধনবিদ্যা
- i) অগ্নিবেশ রচিত ‘অজ্ঞান-নিদান’।
- ii) গঙ্গাধর রচিত ‘গন্ধসার’।
- iii) নিত্যনাথ রচিত ‘রসরত্নাকর’।
১৭) কৃষিবিজ্ঞান
- i) পরাশর রচিত ‘কৃষিপরাসর’।
- ii) সুরেশ্বর রচিত ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ’।
- iii) শার্ঙ্গধর রচিত ‘উপবনবিনোদ’।
১৮) দর্শনসাহিত্য
হিন্দু ষড়দর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল- মৌলিক তত্ত্বগুলি বিভিন্ন প্রস্থানভেদে সূত্রাধারে বিন্যস্ত।
- i) সাংখ্য- ঈশ্বরকৃষ্ণ রচিত ‘সাংখ্যকারিকা’।
- ii) যোগ- পতঞ্জলির যোগসূত্র’।
- iii) পূর্বমিমাংসাঃ- জৈমিনী রচিত ‘মিমাংসাসূত্র’।
- iv) ন্যায়- গৌতম রচিত ‘ ন্যায়সূত্র’।
- v) বেদান্ত – বাদ্রায়ণ রচিত ‘ব্রহ্মসূত্র’।
- vi) চার্বাক – বিভিন্ন সংকলনমূলক গ্রন্থ।
১৯) অভিধানশাস্ত্র
- i) অমরসিংহ রচিত ‘অমরকোষ’।
- ii) বাসুকি রচিত ‘শব্দকোষ’।
২০) অলংকারশাস্ত্র
- i) ভরত রচিত ‘নাট্যশাস্ত্র’।
- ii) ভামহ রচিত ‘কাব্যালংকার’।
২১) ব্যাকরণশাস্ত্র
- i) পানিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী।
- ii) পাণিনি রচিত ‘সিদ্ধান্তকৌমুদী’।
- iii) বোপদেব রচিত ‘মুগ্ধবোধ’।
২২) ঐতিহাসিক কাব্য
- i) কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনী।
- ii) বানভট্ট রচিত হর্ষচরিত।
২৩) ধর্মশাস্ত্র
- i) কামঙ্গক রচিত ‘নীতিসার’।
- ii) ভোজ রচিত ‘যুক্তিকল্পতরু’।
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস সম্পর্কে মন্তব্য
এইভাবে আমরা দেখি যে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা শুধুমাত্র স্বীয় কল্পনার ডানায় নিত্য-নতুন মহাকাব্য, গীতিকাব্য ও নাট্যকাব্য রচনাতেই শান্ত ছিলেন না। তাঁদের ধী ও প্রজ্ঞা জীবনকে সামগ্রিকভাবে বিচার করেছিল। কবি ব্যক্তির তুলনায় একজন সার্বিক মানুষের পরিধি যে অনেক বড় এই তত্ত্ব অনুধাবণ করে তাঁরা যে অবিশ্বাস্য বৈচিত্র্যময় শাস্ত্রসাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তা আমাদের আজও প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে।
- আর্যভট্ট ও ভারতীয় গনিত
- দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য : ভারতীয় গণিতজ্ঞ
- ভারতীয় জ্যোতির্বিদ: ব্রহ্মগুপ্ত
- প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সাহিত্যের ধারনা
- আর্যভট্ট সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা
- বরাহমিহির-প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী
- (টীকা) আর্যভট্ট – উচ্চ মাধ্যমিক সংস্কৃত