বাক্যপদীয় অনুসারে ষড়ভাববিকার আলোচনা করে কালশক্তির উপযোগিতা আলোচনা কর।
ষড়ভাববিকার আলোচনা করে কালশক্তির উপযোগিতা
ষড়ভাববিকার
পরিদৃশ্যমান জগত প্রপঞ্চের যে অনন্ত বৈচিত্র্য, তার মূলে রয়েছে জন্ম প্রভৃতি ছটি ভাববিকার। নিরুক্তকার যাস্ক তাঁর গ্রন্থে আচার্য বার্ষ্যায়ণির মত উল্লেখ করে বলেছেন-
” ষড়ভাববিকারা ভবন্তীতি হ স্মাহ ভগবান্ বার্ষ্যায়ণিঃ।জায়তে অস্তি বিপরিণমতে বর্ধতে অপক্ষীয়তে বিনশ্যতীতি।অর্থন্যে ভাববিকারা এতেষামেব বিকারাঃ।”
মহর্ষি পতঞ্জলিও এই মতের সমর্থন করেছেন তার মহাভাষ্য গ্রন্থ।
এখন জন্ম, বিদ্যমানতা, পরিবর্তন, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও নাশ-এই ছয় ভাববিকারের অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রথমে ভাববিকার বিষয়ে জ্ঞান আবশ্যক। ভাববিকারের অর্থ বুঝতে গেলে, ভাব ও বিকারের আলাদা আলাদা অর্থ জানা দরকার। এই দুটি শব্দের অর্থ টীকাকারদের মতে বিভিন্ন।
- ১) এক পক্ষের মতে ভাব শব্দের অর্থ ক্রিয়া। বিকার শব্দের অর্থ প্রকার।
- ২) অপরপক্ষের মতে ভাব শব্দের অর্থ পদার্থ। বিকার শব্দের অর্থ অবস্থা।
- ৩) তৃতীয়পক্ষের মতে ভাব শব্দের অর্থ শব্দ বা অর্থযুক্ত শব্দ সমষ্টি, এবং বিকার শব্দের অর্থঅবস্থানভেদ।
- ৪) সর্বশেষ মতটি হল- ভাব শব্দের অর্থ সত্তা বা মহাসামান্য যার অপর নাম আত্মা বা পরব্রহ্ম। বিকার শব্দের অর্থ অবস্থান্তর প্রাপ্তি।
ছটি ভাববিকার হল-
i) জায়তে:-
ছটি ভাববিকারের প্রথমটি হল –
‘জায়তে ইতি পূর্বভাবস্যাদিমাচষ্টে, নাপরভাবমাচষ্টে, ন প্রতিষেধতি।’
অর্থাৎ ‘জায়তে’ এই শব্দটি প্রথম বিকারের আদিকে (উপক্রম থেকে পরিসমাপ্তি পর্যন্ত জনিক্রিয়ার ব্যাপারসমূহকে )বোঝায়। পরবর্তী অস্তিত্ব বা ভাবকে বোধও করায় না আবার নিষেধও করেনা।
ii) অস্তি:-
দ্বিতীয় ভাববিকারটি হল-
“অস্তীতুৎপন্নস্য সত্ত্বস্যাবধারণম্”।
অর্থাৎ অস্তি এই কথাটি বললেই বোঝা যায়, যা জন্মেছে তা বিদ্যমান আছে, তার ধ্বংস হয়নি। অস্তি-এর দ্বারা বিপরিণামের
গ্রহণও হচ্ছে না প্রতিষেধও হচ্ছে না।
iii) বিপরিণমতে :-
তৃতীয়টি হল –
” বিপরিণমত ইত্যপ্রচ্যবমানস্য তত্ত্বাদ্বিকারম্।।”
অর্থাৎ বিপরিণমতে এই শব্দটি স্বরূপ হতে অবিচ্যুত দ্রব্যের তদ্ভাব অথবা স্বরূপ থেকে অন্যথাভাব পরিবর্তন বোধ করায়। অর্থাৎ কোনো বস্তুর বিপরিণাম হয়েছে বললে বুঝতে হবে- অস্তিত্বরূপ স্বরূপ থেকে বস্তুটির বিচ্যুতি ঘটেনি কিন্তু শুদ্ধ অস্তিত্ব থেকে তার বিক্রিয়া বা পরিবর্তন ঘটেছে। ‘ বিপরিণমতে’- পদের দ্বারা বৃদ্ধির গ্রহণ বা প্রতিবেধ হচ্ছনা।
iv) বর্দ্ধতে :-
চতুর্থ ভাববিকারটি হল-
‘বর্দ্ধত ইতি স্বাঙ্গাভ্যুচ্চয়ং সাংযৌগিককানাং বার্থানাম্।”
অর্থাৎ বর্দ্ধতে এই পদটি স্বীয় অঙ্গের দ্বারা বৃদ্ধি অথবা সংযোগ সম্বন্ধে অবস্থানশীল দ্রব্যের দ্বারা বৃদ্ধিকে বোঝায়। বর্দ্ধতে শব্দের দ্বারা অপক্ষয়ের গ্রহণও হচ্ছেনা প্রতিষেধও হচ্ছে না।
v) অপক্ষীয়তে:-
পঞ্চম ভাববিকারটি হল-
“অপক্ষীয়ত ইত্যনেনৈব ব্যাখ্যাতঃ প্রতিলোমম্।”
বৃদ্ধি শব্দের বিপরীত অর্থাৎ অপক্ষয় শব্দের অর্থ স্বীয় অঙ্গের অপচয়ে অথবা সাংযৌগিক দ্রব্যের অপচয়ে অপচয় বা হানি। অপক্ষয় শব্দের দ্বারা বিনাশের গ্রহণ ও প্রতিষেধ হচ্ছে না।
vi) বিণশ্যতি:-
শেষ বিকারটি হল-
‘ বিনশ্যতীত্যপরভাবস্যাদিমাচষ্টে ন পূর্বভাবমাচষ্টে ন প্রতিষেধতি।’
অর্থাৎ বিনশ্যতি- এই শব্দটি অপরভাবের আদিকে বোধ করায়। পূর্ববর্তী ভাবকে অর্থাৎ অপক্ষয়কে বোধও করায় না প্রতিষেধও করেনা।
কালশক্তির উপযোগিতা:-
এই ভাববিকারবশতঃ পদার্থের বৈচিত্র্য ও নানাত্ব সম্ভব হয়। কিন্তু জন্মাদিবিকার ক্রিয়া বা ভাবস্বরূপ, তা পরিবর্তনযোগ্য। সেটা সিদ্ধ নয়। তাদের বহু বিভাগ ও তাদের পৌর্বাপর্য বর্তমান।সুতরাং ভাব বা ক্রিয়া কালিক পৌর্বাপর্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। ভাববিকার বা ক্রিয়ার ভিত্তিস্বরূপ যে এই ক্রম, তার মূলে যে কাল, তা শব্দব্রহ্মেরই স্বাতন্ত্র্যাখ্য শক্তি। শব্দব্রহ্ম এই কালশক্তির প্রভাবে জন্মাদি ষডবিধ ভাববিকারের উল্লাসের সাহায্যে বিশ্বের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হন। কাল অখন্ড হলেও উপাধিভেদবশতঃ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ – এই ত্রিবিধভেদ কল্পিত হয়, যার ফলে কালেতেও ভেদ আরোপিত হয় এবং এই কল্পিত ভেদ অবশেষে শব্দব্রহ্মে আরোপিত হয়। এর ফলে শব্দব্রহ্ম অদ্বৈত এবং ক্রমশূণ্য হলেও কালের কল্পিত ভেদ আরোপের ফলে তিনিও নানা এবং পূর্বাপরীভাববিশিষ্টরূপে প্রতিভাত হন। এভাবে জগৎ সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন হতে পারে কালশক্তি কিভাবে জন্মাদি ষড্ ভাববিকারের নিয়ামক হয়?-
এর উত্তরে ভর্তৃহরি বলেন- কালের দুটি প্রধান শক্তি প্রতিবন্ধ (বাধা দেওয়া) ও অভ্যনুজ্ঞা দ্বারা কাল জন্মাদি ছটি ভাববিকারের নিয়ামক হয়।
সুতরাং আচার্য ভর্তৃহরি কালকেই লোকযন্ত্রের সূত্রকার বা নিয়ামক বলে একটি উদাহরণ দিয়েছেন-
” প্রতিবদ্ধাশ্চ যাস্তেন চিত্রা বিশ্বস্য বৃত্তয়ঃ।
তাঃ স এবানুজানাতি যথা তন্তুঃ শকূন্তিকাঃ।।” (বাক্যপদীয় ৩/১৫)
তন্তুর সাহায্যে যেমন শকুন্তিকার গতি নিয়মিত হয়, অনুরূপভাবে কাল শক্তিই প্রতিবন্ধ ও অভ্যনুজ্ঞারূপ ব্যাপার বলে বিশ্বের যাবতীয় বৃত্তিকে পরিচালনা করেছেন। কালের কোনো স্বাতন্ত্র্য না থাকলেও কালাখ্য স্বাতন্ত্র্যশক্তির আশ্রয় শব্দব্রহ্ম যথার্থই স্বতন্ত্র, অতএব এই বিশ্বপ্রপঞ্চের কর্তা।
মূলতঃ শব্দব্রহ্ম অদ্বৈত হলেও কালাখ্য শক্তির আশ্রয়বশতঃই তিনি যেমন নানারূপে প্রতিভাত হন, ঠিক সেইভাবেই এক শব্দব্রহ্ম সর্বপদার্থের বীজ অর্থাৎ কারণস্বরূপ হয়েও ভোক্তা, ভোগ্য এবং ভোগরূপে নানা ভাবে বিরাজ করেন। ভর্তৃহরিকৃত এই বিষয়ে কারিকাটি হল-
” একস্য সর্ববীজস্য যস্য চেয়মনেকথা।
ভোক্তৃ ভোক্তব্য রূপেন ভোগরূপেন চ স্থিতিঃ।।” (বাক্যপদীয় ১/৪)