বাক্যপদীয় : ভর্তৃহরি

ভর্তৃহরি রচিত সংস্কৃত ব্যাকরণ দর্শন বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বাক্যপদীয় সম্পর্কে যা জানো লেখ।

ভর্তৃহরি রচিত বাক্যপদীয় সম্পর্কে যা জানো লেখ


ভূমিকা:- সংস্কৃত ব্যাকরণ দর্শন বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল বাক্যপদীয়।

গ্রন্থটির রচয়িতা :-

সংস্কৃত ব‍্যাকরণের দর্শনের ক্ষেত্রে ভর্তৃহরি প্রধান পুরুষ। তাঁর রচিত ‘বাক‍্যপদীয়’ নামক গ্রন্থখানি  আজও শ্রেষ্ঠ গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়।

ভর্তৃহরি সময়কাল :-

তাঁর সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু বিতর্ক থাকলেও বলা যায় যে তিনি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ভর্তৃহরি রচনাসমূহ:- 

ভর্তৃহরির নামে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রচলিত আছে, এর মধ্যে ব্যাকরণ শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ গুলি হল – বাক্যপদীয়। বাক‍্যপদীয়- এর ওপর রচিত স্বোপজ্ঞটীকা,  পতঞ্জলির মহাভাষ্যের ওপর লেখা টীকা  ‘মহাভাষ্য – দীপিকা’ ভাগবৃত্তি, শব্দধাতু-সমীক্ষা প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে বাক্যপদীয় গ্রন্থখানিই বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায়,  স্বোপজ্ঞটীকা এবং মহাভাষ্যদীপিকা-র কিছু কিছু অংশ পাওয়া যায়, শব্দধাতুসমীক্ষা পাওয়া যায় না। এছাড়া কেউ কেউ ভর্তৃহরিকে ভর্তিকাব্যম্ (নামান্তর রাবণবধম্)  কাব‍্যের রচয়িতা বলে মনে করেন। তিনখানি শতক কাব‍্যও তার নামের সাথে যুক্ত হয়ে আছে- শৃঙ্গারশতক, নীতিশতক এবং বৈরাগ্য শতক।

ভর্তৃহরির গুরু :-

গুরু বসুরাতের কাজ থেকে শব্দবিদ্যা সম্পর্কে বিশেষ উপদেশ লাভ করে ভর্তৃহরি তাঁর পূর্বাচার্যদের (পাণিনি, কাত্যায়ন, পতঞ্জলি, ব‍্যাড়ি,  বাজপ‍্যায়ন প্রভৃতি আচার্যগনের)  প্রামাণিক গ্রন্থগুলি পর্যালোচনা করে বাক্যপদীয় নামক গ্রন্থখানি  রচনা করেন।

বাক্যপদীয়-এর অপর নাম:- 

গ্রন্থটি ‘আগম সংগ্রহ’ বা আগম-সমুচ্চয়’ নামেও বহু স্থানে উল্লেখিত হয়েছে।

বাক্যপদীয় গ্রন্থের গঠন ও বিষয়বস্তু:-

শব্দশাস্ত্র বিষয়ক অত্যন্ত গহন গম্ভীর আলোচনায় গ্রন্থটি পরিপূর্ণ। গ্রন্থটি তিনটি কান্ডে বিভক্ত – ব্রহ্মকান্ড, বাক্যকান্ড এবং  প্রকীর্ণকান্ড। এজন্য এই গ্রন্থখানিকে অনেক সময় ত্রিকান্ডী  নামেও অভিহিত করা হয়। ব্রহ্মকান্ডের অপর নাম আগমকান্ড এবং প্রকীর্ণকাণ্ডের অপর নাম পদকান্ড।

বাক্যপদীয় গ্রন্থের ব্রহ্মকান্ডের প্রথম কারিকাটিতেই ভর্তৃহরি তাঁর সিদ্ধান্ত – তথা তাঁর দর্শনের মূল কথাটি বলে দিয়েছেন-
“অনাদিনিধনং ব্রহ্ম শব্দতত্ত্বং যদক্ষরম্।
বিবর্ত্ততেঅর্থভাবেন প্রক্রিয়া জগতো যতঃ।।”

বস্তুত ভর্তৃহরি হলেন শব্দাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। তাঁর মতে, শব্দাত্মক ব্রহ্ম অনাদি, নিধনরহিত, অক্ষর এবং নিত্য। তাঁর মতে, জগৎ শব্দ ব্রহ্মেরই বিবর্ত। এজন্য তাঁকে শব্দবিবর্তবাদের প্রবক্তাও বলা হয়। ব্রহ্মকান্ডের আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে স্ফোট, ধ্বনি ও নাদের পারস্পরিক প্রভেদ, ব‍্যাকরণাগমের প্রয়োজন।শব্দাদ্বৈতবাদিগণের মতে, মোক্ষের স্বরূপ বেদাঙ্গ বটে।

বাক‍্যপদীয় গ্রন্থটির দ্বিতীয়কান্ডে অর্থাৎ বাক‍্যকান্ডে মূলত বাক‍্যের স্বরূপ বিবেচিত হয়েছে এবং প্রকীর্ণকান্ডে দ্রব‍্য, গুন, জাতি, দিক, কাল ক্রিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়গুলি পর্যালোচিত হয়েছে।

বাক্যপদীয়-এর টীকা ও টীকাকারসমূহ:-

ভর্তৃহরির এই বাক্যপদীয় গ্রন্থটির ওপর অনেক পণ্ডিত টীকাটিপ্পনী ব্যাখ্যা প্রভৃতি রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে প্রথম ও দ্বিতীয় কান্ডের কিছু অংশের ওপর ভর্তৃহরির নিজের লেখা স্বোপজ্ঞবৃত্তি পাওয়া যায়। এছাড়া হেলারাজ, পূণ‍্যরাজ,ফুল্লরাজ প্রমুখ টীকাকারগনও বাক‍্যপদীয়ের ওপর টীকা লিখেছিলেন। হেলারাজের টীকায় বেশি প্রসিদ্ধ। তার টীকার নাম শব্দপ্রভা।  আধুনিক যুগেও পন্ডিত এই মহাগ্রন্থটিকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। এদের মধ্যে চারুদেব শাস্ত্রী, সত্যকামবর্মা, গৌরীনাথ শাস্ত্রী, রঘুনাথ শর্মা, বিষ্ণুপুর ভট্টাচার্য্য প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মূল্যায়ন :-

পরিশেষে বলা যায় যে,  ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় গ্রন্থের সমাপ্ত শুধুমাত্র ব্যাকরণের বিষয়বস্তু আলোচিত হয়নি। এই গ্রন্থে খুব সহজ-সরল ভাবে মুখ্য তত্ত্বেরও উপবেশ দেওয়া হয়েছে।তাই এই গ্রন্থটি সকলের কাছে সমাদৃত।

Comments