বাক্যপদীয় গ্রন্থ অনুসারে শব্দ ব্রহ্মের স্বরূপ লিখ?
বাক্যপদীয় গ্রন্থ অনুসারে শব্দ ব্রহ্মের স্বরূপ
উ:- আচার্য ভর্তৃহরি লিখিত বাক্যপদীয় গ্রন্থের প্রথম আলোচ্য বিষয় হল শব্দব্রহ্মের স্বরূপ। সে বিষয়ে প্রথম কারিকাটি হল-
” অনাদিনিধনং ব্রহ্ম শব্দতত্ত্বং যদক্ষরম্।
বিবর্ত্ততেঅথর্ভাবেন প্রক্রিয়া জগতো যতঃ।।”
শব্দব্রহ্ম কি
উপনিষদসমূহে অদ্বৈত সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মকেই একমাত্র ‘তত্ত্ব স্বীকার করেছেন, সেই ব্রহ্ম হলেন শব্দব্রহ্ম। অর্থাৎ ভর্তৃহরিও অদ্বৈতবাদী এবং ব্রহ্মবাদী। তবে তিনি শব্দব্রহ্মে বিশ্বাসী, ঔপনিষদ ব্রহ্মে নয়। এই শব্দব্রহ্ম থেকেই বাহ্য ও অভ্যন্তর ভাবরাজি সমন্বিত এই বিশালপ্রপঞ্চের উদ্ভব।
আচার্য শঙ্কর যেমন তাঁর অদ্বৈতবাদে জগতকে ব্রহ্মেরই বিবর্ত বলে অভিহিত করেছেন, আচার্য ভর্তৃহরিও অনুরূপভাবে এই বিশাল প্রপঞ্চকে শব্দাত্মক ব্রহ্মেরই বিবর্তরূপে অভিহিত করেছেন, পরিণামরূপে নয়। ( পরিনাম বা বিকার শব্দ সমার্থক। যেমন- দই হল দুধের পরিনাম বা বিকার অর্থাৎ পরিনামবাদ অনুসারে পরিনামীর মূল বিষয় ফেরা সম্ভব নয়। যেমন-দই এর দুধে রূপান্তর সম্ভব নয়। যেমন- দই এর দুধে রূপান্তর সম্ভব নয়। কিন্তু বিবর্তবাদ অনুসারে বিবর্তিত বস্তুর আকার পূর্বের রূপে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। যেমন- বুদবুদ হল জলের বিবর্ত, পরিণাম নয়। বুদবুদ জলে রূপান্তরিত হতে পারে)। সুতরাং ভর্তৃহরি শব্দবিবর্তবাদের প্রবক্তা, শব্দ পরিণামবাদের নয়। বাক্যপদীয় গ্রন্থে যে- শব্দব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, সেই ব্রহ্ম শ্রোতগ্রাহ্য স্থূল শব্দ নয়, তা হল স্ফোটাত্মক নিত্য শব্দ। (স্ফোট, ধ্বনি-বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা, এই গ্রন্থের ভূমিকা অংশে ও পরমলঘুমঞ্জূষা গ্রন্থের আলোচনাতে প্রদত্ত হয়েছে।
শব্দ ব্রহ্মের স্বরূপ
এই ব্রহ্ম আদি ও নিধনরহিত, অক্ষরস্বরূপ। সেই এক শব্দব্রহ্মই ভিন্ন ভিন্ন শক্তির আশ্রয়ত্ব নিবন্ধন প্রাকৃতজনের নিকটে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভাত হন। এই বিষয়টিকেই
আচার্য ভর্তৃহরি নীচের কারিকার দ্বারা বুঝিয়েছেন-
” একমেব যদাম্নাতং ভিন্নং শক্তিব্যপাশ্রয়াৎ।
অপৃথকত্বেঅপি শক্তিভ্যঃ পৃথকত্বেনেব বর্ত্ততে।।” (বাক্যপদীয় ১/২)
অর্থাৎ যে শব্দব্রহ্ম শ্রুতিসমূহে একইরূপে কীর্তিত হয়েছে, সেই ব্রহ্মই ভিন্ন ভিন্ন শক্তির আশ্রয় হওয়ায়, শক্তিসমূহ থেকে বস্তুতঃ অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পৃথক বা ভিন্নরূপে ভাসমান হয়। শক্তিসমূহ পরস্পর ভিন্ন হওয়ায় তার আধার যে শব্দব্রহ্ম, তিনিও ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হন। যদিও তিনি ভেদরহিত।
প্রশ্ন হতে পারেঃ শক্তিসমূহ যদি পরস্পর ভিন্ন এবং আধার ব্রহ্ম থেকে বস্তুতই ভিন্ন হয়, তবে ব্রহ্মের অদ্বৈতত্ব কিভাবে সম্ভব?
এর উত্তরে ভর্তৃহরির বক্তব্য হল যে – ব্যাকরণশাস্ত্রে শক্তি ও শক্তিমান – এই উত্তরের মধ্যে ভেদ বাস্তব নয়, সেটি কল্পিত মাত্র। সুতরাং পরমার্থতঃ শব্দব্রহ্ম এবং তদাশ্রিত শক্তি অপৃথক হওয়ায় শক্তিসমূহের মধ্যেও পরস্পর ভেদ থাকতে পারে না। তথাপি শব্দব্রহ্ম থেকে শক্তিসমূহ যেমন- পৃথক, অনুরূপ শক্তি সমূহও পরস্পর পৃথকরূপে অবিদ্যাবশতঃ ভাসমান হয়। কিন্তু এই ভেদ বাস্তব নয়। ফলে শব্দব্রহ্মের অদ্বৈতত্ত্বের কোনও ব্যাখ্যাত হতে পারে না।
শব্দব্রহ্মের প্রধান শক্তি
এই শব্দব্রহ্মের একটি অন্যতম প্রধান শক্তি হল- কালশক্তি। শব্দব্রহ্মের নানাবিধ শক্তি বর্তমান এবং যদিও সেই শক্তিসমূহ শব্দব্রহ্ম থেকে অতিরিক্ত নয়, তথাপি অবিদ্যাপ্রভাবে পৃথকরূপে প্রতিভাত হয়। ব্রহ্মের কালশক্তিকে আশ্রয় করেই পরিদৃশ্যমান জগৎ প্রপঞ্চের অত্যন্ত বৈচিত্র্য-যার মূল হচ্ছে জন্মাদি ছটি ভাববিকার। এই ভাববিকারবশতঃ পদার্থরাজির বৈলক্ষণ্য অর্থাৎ, ভাববেদ হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কারিকাটি হল-
“অধ্যাহিতকলাং যস্য কালশক্তিমুপাশ্রিতাঃ।
জন্মাদয়ো বিকারাঃ ষড্ ভাববেদস্য যোনয়ঃ।।”