অর্থশাস্ত্র অনুসারে দূত কয় প্রকার কি কি? দূতের সংজ্ঞা ও কার্যাবীল লেখ?
দূত কয় প্রকার কি কি? প্রতি প্রকার দূতের সংজ্ঞা ও কার্যাবীল লেখ?
প্রাচীন রাজনীতিতে দূতের ভ‚মিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। এক কথায় দূতই রাজার মুখ ও চোখ। বিশেষ করে পররাষ্ট্র বিষয়ে দূত অপরিহার্য। কারন দূতের মাধ্যমেই বিভিন্ন রাজাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কারন দূতের মুখ দিয়ে একরাজা নিজ বক্তব্য অপর রাজাকে শোনাতেন। সুতরাং বিভিন্ন রাজা ও রাজ্যের মধ্যে কিধরনের স¤পর্ক স্থাপিত হবে সেটা প্রধানত: দূতের আচার আচরণ ও বক্তব উপস্থাপনের উপর নির্ভর করত।
মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে
দূত এব হি সন্ধত্তে ভিনত্ত্যেব চ সংহতান্।
দূতস্তৎ কুরুতে কর্ম ভিদ্যন্তে যেন মনবা:।।
তাই রাজনীতিবিদ আচার্য কৌটিল্য রাজ্য শাসনে দূতের গুরুত্ব বিবেচনা করেই তাঁর অর্থশাস্ত্র সমূহ গ্রন্থে দূত প্রনিধি প্রকরনে দূত প্রেরন, পরদেশে দূতের আচার ও করনীয় কার্য সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি প্রথমে বৈশিষ্ট্য অনুসারে তিন শ্রেনীর দূতের উল্লেখ করেছেন।
যথা
১. নিসৃষ্টার্থ দূত ২. পরিমিতার্থ দূত ও ৩. শাসনহর দূত।
১. নিসৃষ্টার্থ দূত
যে সমস্ত দূত সম্পূর্নরূপে অমাত্য গুন সম্পন্ন হয় অর্থাৎ সদ্বংশ জাত, প্রজ্ঞাবান, বিশুদ্ধ স্বভাব, মানসিক জড়তা পম্পন্ন, বিশ্বাস ভাজন এবং রাজার প্রতি ভক্তিবান, তাদের নিসৃষ্টার্থ দূত বলে। এই জাতীয় দূতেই পররাজ্যে দূতাবাস, গুপ্তচর নিয়োগ, সংবাদ সংগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে চরম ক্ষমতা সম্পন্ন হয়।
২. পরিমিতার্থ দূত
যে সমস্ত দূতের মধ্যে অমাত্যোচিত গুনের এক চতুর্থাংশ কম তাদের বলা হয় পরিমিতার্থ দূত। সুতরাং ক্ষেমতায় ও পদ মর্যাদায় নিসৃষ্টার্থ অপেক্ষা নূন্যতম হওয়ায় একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ভার দিয়ে পরিমিতার্থ দূতকে পররাজ্যে প্রেরন করা হয়।
৩. শাসনহর দূত :
এ জাতীয় দূতের মধ্যে অমাত্যোচিত গুনাবলীর অর্দ্ধেক পরিমান থাকে। এ জাতীয় দূত গুন হৈশিষ্ট্যে পরিমিতার্থ দূত অপেক্ষ ন্যূনতম। তাই এই জাতীয় দূতকে একটি মাত্র শাসন বা সংবাদ যথাস্থানে নিবেদন করার জন্য প্রেরন করা হয়।
কৌটিল্য বলেন দূত যখন দেখবেন যে তাঁর যানবাহন অনুগামী ভৃত্য ও তাঁর প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যথাযথ ব্যবস্থা হয়েছে তথনই তিনি শত্রু রাজার দেশে গমন করবেন। শত্রু রাজার কাছে নিজের প্রভ‚ত শাসন সম্পর্কে শত্রুরাজা সে রূপ জিজ্ঞাসা করবেন, সেই ভাবে উত্তর দেবেন।এমন ভাবে উত্তর দিতে হবে যাতে শত্রুরাজারে নিজের বশে আনতে পারা যায়।
সমস্ত বিষয় জেনে শুনে দূত পররাজ্যে গমন করবেন। দূতকে শত্রু রাজার অটবীপাল, অন্তপাল, পুরমুখ্য ও রাষ্ট্রমুখ্যদের সংঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে হবে। দূত নিজ প্রভুর এবং শত্রুরাজার সৈন্য নিবেশ স্থান, যুদ্ধ করাবার যোগ্য ভ‚মি এবং যুদ্ধ থেকে অপসারনের অনুকুল ভ‚মি পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষন করবেন। শত্রুর দুর্গ ও জনপদের পরিমান কতখানি তাও দূত উপলব্ধি করবেন।
শত্রুর রাজ্যে শস্য ও সুবর্ণাদির উৎপত্তি জানিত সারদ্রব্য কত আছে, জনসাধারনের জীবিকা অর্জনের উপায় কেমন আছে এবং রাজ্যের রাজার দুর্বলতা জনিত দোষ কতটা আছে তা সবেই দূত জানবেন।
দূত পর রাজার অনুমতি নিয়ে পররাজ্যে প্রবেশ করবেন। প্রান সংশয় জেনেও দূতকে নিজের প্রভুর প্রেরিত বার্তা উপস্থাপন করতে হবে। তখন শত্রুরাজা যুদি দূতের কাছে সন্নভাব দেখান, তাকে সম্মান দেখিয়ে তার বাক্য সমাদের করে শোনেন, তাঁর দৌত্যে বিশ্বাস করেন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ন্ত্রন করেন ; এই সমস্ত লক্ষন দেখে বুঝে নিতে হবে শত্রুরাজা দূতের উপর সন্তুষ্ট, আর এর বিপরীত অবস্থা হলে বুঝতে হবে অসন্তুষ্ট।শত্রুরাজা কর্তৃক বিদায় না পাওয়া পর্যন্ত দূত শত্রু রাজ্যের অবস্থান করবেন। তাকে সবসময় সম্মান পেয়েও দূত গর্ব বা আনন্দ বোধ করবেন না। শত্রু রাজার বাক্য অনভিপ্রেত হলেও তা দূতকে সহ্য করতে হবে। শত্রুরাজার দেশে দূত স্ত্রীসঙ্গ ও মদ্যপান বর্জন করবেন। পররাজ্যে দূতকে একাকী শয়ন করতে হবে। কেননা মানুষ মাত্রই সুপ্ত ও মত্ত অবস্থায় নিজের মনোভাব প্রকাশ করে ফেলে।
পররাজ্যে থাকা কালে দূতের আর একটি বড় কাজ হলো গুপ্তচর নিয়োগ। সেশানে তাপস বেশধারী বা বনিক বেশধারী গুপ্তচরদের সাহায্যে পররাজ্যের প্রজাদের মধ্যে ভেদ কার্য সম্পাদন করবেন।
যারা অভেদ্য তাদেরও প্রভ‚ত প্রতি মনোভাব এবং তাদের দোষগুলি জেনে নিতে হবে। যদি গুপ্তচরদের সাথে কথাবার্তার সুযোগ না থাকে তাহলে তিনি ভিক্ষুক মাতাল এ সমস্ত ব্যক্তিদের প্রলাপ থেকে তাছাড়া তীর্থ ও আশ্রমাদি পুন্য স্থান ও দেবালয়ে বিচরন কারী গৃঢ় পুরষদের কথোপকথন থেকে এবং ভিত্তিতে প্রদর্শিত চিত্র ও বিশেষ অক্ষর লেখার সংজ্ঞা দ্বারা শত্রুর সব সমাচার উপলব্ধি করবেন এবং যথাযোগ্য ভেদ ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।
অপর দিকে শক দ্বারা জিজ্ঞাসিত হলেও তিনি নিজ রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা তাঁর কাছে প্রকাশ করবেন না। অপনি তো সব জানেন এরূপ বলে শত্রু রাজাকে এড়িয়ে যাবেন। অথবা তাতে কাজ না হলে ততটুকু বলবেন যাতে তাঁর দৌতকার্য সিদ্ধ হয়। কার্য সিদ্ধি হলেও যদি শত্রুরাজা তাকে অবরূদ্ধ করবেন অর্থাৎ ফিরে যেতে নাদেন তাহলে তিনি অবরূদ্ধের কারন জেনে নিতে প্রয়াসী হবেন।
দূতের কার্যাবলী সম্পর্কে কৌটিল্যের মত হল শত্রুর কাছে নিজ প্রভ‚ত শাসন নিবেদন ও নিজ প্রভ‚র কাছে শত্রু দেশের বৃত্তান্ত জ্ঞাপন পূর্বকৃত সন্ধি রক্ষন, শত্রুর কাছে যথাসম্ভব নিজ রাজার প্রতাপ প্রদর্শন মিত্র সংগ্রহ, ভেদনীতি প্রয়োগ, শত্রুর সুহৃদগনের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি। শত্রু রাজার বন্ধু ও রতেœর অপহরন সকলেই দ‚তের কাজ।
উপসংহার
কৌটিল্য বলেছেন রাজা নিজদূতগনের মাধ্যমে উক্ত সকল কর্মসমূহ করাবেন। তাছাড়া শত্রুর রাজার দূতগনের উপর প্রতিদূত ও অপসর্প নামক গুপ্তচর নিয়োগ করে থাকবেন। স্বদেশে দৃশ্যমান ও পরদেশে অদৃশ্য রক্ষী পুরুষগনের দ্বারা ক্ষোর ব্যবস্থা করবেন। শত্রুদূতগন মিত্র সংগ্রহাদি কার্য করতে না পারে।
অর্থশাস্ত্র হতে অন্যন্য টীকাগুলি দেখতে ক্লিক করুন
অর্থশাস্ত্র হতে অন্যন্য প্রশ্ন ও উত্তর গুলি দেখুন (Arthashastra Sanskrit Hons Pass Notes)
- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে দূতএর প্রকারভেদ দূতের সংজ্ঞা ও কার্যাবীল লেখ?
- অর্থশাস্ত্র অনুসারে শাসন রচনার উদ্দেশ্যগুলি কয়টি ও কী কী? ব্যাখ্যা কর।
- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মন্ত্রাধিকার অনুসারে রাজলেখের দোষ ও গুণ
- রাজলেখ বলতে কী বোঝ? রাজলেখ কয় প্রকার ও কী কী?
- পদ কাকে বলে? পদ কয় প্রকার ও কী কী?
- উপায় কয়টি ও কী কী?
- কৌটিল্যের মতে দূতের গুনাবলী কি কি? পররাষ্ট্রে দূতের কার্যাবলী আলোচনা কর ।
- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মন্ত্রাধিকার অনুসারে মন্ত্রনার স্থান ও কৌটিল্য কীভাবে তার পূর্বসূরীদের মত খন্ডন করেছেন ।