ঋকসংহিতার ষষ্ঠ মন্ডলের ৬৪ তম সূক্তকে অবলম্বন করে ঊষা দেবীর স্বরূপ প্রদর্শন করা হল । ঊষা দেবীর স্বরূপ অর্থাৎ এই সূক্তে ঊষা দেবীর যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হল।
ঋকসংহিতার ষষ্ঠ মন্ডলের ৬৪ তম সূক্তকে অবলম্বন করে ঊষা দেবীর স্বরূপ
অবস্থান | ঋকবেদ- ষষ্ঠ মন্ডল- ৬৪ তম সূক্ত |
ঋষি | বৃহস্পতির পুত্র ভরদ্বাজ ঋষি |
ছন্দ | ত্রিষ্টুপ্ |
দেবতা | ঊষা |
মন্ত্র সংখ্যা | ৬টি |
ভূমিকা :- ঋকবেদের দেবগোষ্ঠীতে অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, যম, বিষ্ণু প্রভৃতি পুরুষ দেবতা যেমন আছেন তেমনই আবার পৃথিবী,রাত্রি, সরস্বতী প্রভৃতির স্ত্রী দেবতাও আছেন।ঋষিরা পুরুষ দেবতার বর্ণনায় যেমন তৎপর দেবীদের মাহাত্ম্যকীর্তনে তারা তেমন তৎপর নন। তারা কবিদৃষ্টি নিয়ে দেবীদের কমনীয় রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। উষা হলেন এমনই এক দেবী যাঁর রূপ বর্ণনায় কবিঋষির আবেগ প্রকাশ সীমাহীন। উষা রূপ লাবণ্যময়ী ও স্মারক এক তরুণী। প্রনয়কাঙ্ক্ষী হয়ে সূর্য তার পশ্চাৎ ধাবন করেন। উষা মানবী নন। তিনি হলেন দেবী। তিনি সুখ-সমৃদ্ধি দায়িনী এবং কর্মের প্রেরণদাত্রী।
ঊষা দেবী সূক্তের ঋষি ছন্দ দেবতা :-
ঋকবেদের ষষ্ঠ মন্ডলের ৬৪ তম সূক্তটি ৬ টি মন্ত্রের সমাহার। এই সূক্তের দেবতা ঊষা। ঋষি হল বৃহস্পতির পুত্র ভরদ্বাজ এবং ছন্দ হল ত্রিষ্টুপ্।
ঊষা দেবী স্বরূপ :-
এই সূক্তে ঊষা দেবীর যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নে বর্ণিত হয়েছে-
ঊষা দেবী দীপ্তিমতী ও শুক্লবর্ণা :-
ঊষা দীপ্তিমতী। তাঁর বর্ণ শুক্ল। সমুদ্র হতে শ্বেতবর্ণ ঊর্মিসমূহ যেরূপ উত্থিত হয়। ঊষাও সেইরূপ দ্যুলোক হতে উত্থিত হয়েছেন। ঊষা ও ঊর্মি উভয়ের শ্বেতত্ব প্রসিদ্ধ।
ঋষির দৃষ্টিতে-
” উদু শ্রিয় ঊষসো রোচমানা অস্থুরপাং নোর্ময়ো রুশন্তঃ।
কৃণোতি বিশ্বা সুপথা সুগাণ্যভৃদু বস্বী দক্ষিণা মঘোণী।।”
মঙ্গলময়ী, তেজস্বিণী ও লাবণ্যময়ী নারী ঊষা দেবী
ঊষা দেবী নিত্য মঙ্গলময়ী রূপে আবির্ভূত হন। রাত্রির অন্ধকারে মানুষ যত পাপ করে ঊষার শুভ্রজ্যোতির স্পর্শে সকল পাপ দূর করে চারিদিক পবিত্র করে দেন। তিনি তেজস্বিনী। তার রূপের সীমা পরিসীমা নেই। তিনি যেন এক লাবণ্যময়ী নারী।
ঋষির দৃষ্টিতে-
” ভদ্রা দদৃক্ষ উর্বিযা বি ভাস্যুৎ তে শোচির্ভানবো দ্যামপপ্তন্।
আবির্বক্ষঃ কৃণুষে শুম্ভমানোষো দেবি রোচমানা মহোভিঃ।।”
তমঃ নাশিনী ঊষা দেবী
রাত্রির শেষে ঊষার প্রতীক্ষায় সকলে উদগ্রীব হয়ে থাকে। লোহিত বর্ণ, দীপ্তিমান রশ্মি সমূহ,সুভগা, বিস্তীর্ণা, প্রথমান- এইগুলি ঊষা দেবীকে বহন করে আনে। বীর সেনারা যেরূপ শত্রু দূর করে। উষাদেবী সেরূপ তমঃ দূর করে পৃথিবীতে আলোর বন্যা এনে দেন। ঋষির দৃষ্টিতে-
” বহন্তি সীমারুণাসো রুশন্তো গাবঃ সুভগামুর্বিয়া প্রথানাম্।
অপেজতে শূরো অস্তেব শত্রুন্ বাধতে তমো অজিরো ন বোলহা।।”
ধনপতি:-
ঊষার আলোয় পর্বতসমূহ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি এক নিমেষে বিস্তীর্ণ সমুদ্রকে অতিক্রম করেন। ঊষা ধনবতী ও ধনদাত্রী। ঊষার নিকট সকলে তাদের অভিলাষিত ধন প্রার্থনা করে। ঋষির দৃষ্টিতে-
” সুগোত তে সুপথা পর্বতেষ্ববাতে অপস্তরসি স্বভানো।
সা ন আ বহ পৃথুযামন্নৃষ্বে রয়িং দিবো দুহিতরিষয়ধ্যৈ।।”
জ্যোতির্ময়ী ও পূজনীয়া ঊষা দেবী
দ্যুলোক দুহিতা ঊষা জ্যোতির্ময়ী। অশ্ববাহিত বিশালরথে উপবিষ্টা সকলের পূজনীয়া। ঊষার আলোয় নিদ্রা থেকে উত্থিত মানবগন প্রথমেই ঊষাকে নিবেদন করেন তাদের অন্তরের শ্রদ্ধা। ঋষির দৃষ্টিতে-
” সা বহ যোক্ষভিরবাতোষো বরং বহসি জোষমনু।
ত্বং দিবো দুহিতর্যা অ দেবী পূর্বহূতৌ মংহনা দর্শতা র্ভূঃ।।”
ঊষা দেবীর স্বরূপ, মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব
উপসংহার:- ঋষি কবি মন্ত্রে মন্ত্রে ঊষাকে আসবার জন্য আহ্বান করেছেন। ঋষির প্রার্থনা ঊষার কাছে যে মনুষ্যদিগের ভোগযোগ্য অন্ন আছে, সেই অন্ন যেন তিনি দান করেন। পুত্র যেমন মাতার আদরের ধন, ঋষি সেইরূপ ঊষার অত্যন্ত প্রিয় হতে চেয়েছিল। ঊষার স্নেহে তিনি ধন্য হতে চেয়েছেন।
ঊষা সূক্ত-ঋকবেদ-ষষ্ঠমণ্ডল-৬৪তম সূক্ত
“বহন্তি সীমারুণাসো রুশন্তো গাবঃ সুভগামুর্বিয়া প্রথাণাম্।
অপেজতে শূরো অস্তেব শত্রূন্ বাধতে তমো অজিরো ন বোলহা”।। (৬.৬৪.৩)
অনুবাদ:- লোহিতবর্ণ,দীপ্তিমান্ রশ্মিসমূহ,সুভগা,বিস্তীর্ণা,প্রথমান- এই ঊষা দেবতাকে বহন করে। ক্ষেপনশীল বীর যেরূপ শত্রু দূর করে, সেইরূপ ঊষা তমঃ দূর করেন এবং ক্ষিপ্রগামী সেনানায়কের ন্যায় তমঃপুঞ্জকে বাধা দেন।
উৎসঃ:- অয়ম্ মন্ত্রঃ ঋগ্বেদস্য ষষ্ঠমণ্ডলস্য ঊষাসূক্তে আম্নাতঃ।
ঋষিঃ দেবতা ছন্দঃ চ :- অস্য মন্ত্রস্য ভরদ্বাজঃ ঋষিঃ ঊষা দেবতা, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দঃ চ।
প্রসঙ্গঃ:- অস্মিন্ মন্ত্রে ঋষিঃ ভরদ্বাজঃ ঊষসঃ স্বরূপম্ প্রকাশয়তি।
অন্বয়ঃ- অস্য মন্ত্রস্য অন্বয়ঃ যথা- অরুণাসঃ রুশন্তঃ গাবঃ সুভগাম্ উর্বিয়া প্রথাণাং সীমা বহন্তি। শূরো অস্তেব তমঃ অপেজতে। বোলহা অজিরো ন শত্রুন্ বাধতে।
সায়ণভাষ্যম্:- সায়ণাচার্যঃ ইমম্ মন্ত্রম্ এবম্ ব্যাখ্যাতবান্ – অরুণাসঃ লোহিতবর্ণাঃ রুশন্তঃ দীপ্যমানাঃ গাবঃ রশ্ময়ঃ। সুভগাম্ উর্বিয়া উর্বী বিস্তীর্ণাং প্রথাণাং প্রথমাণাং সীম্ ত্রণাম্ উষোদেবতাং বহন্তি। সেয়মূষোদেবতা শূরো অস্তেব বীরঃ ক্ষেপ্তেব শত্রূন্ তমঃ অপেজতে অপগময়তি। বোলহা সেনায়াঃ অজিরো ন ক্ষিপ্রগামী শত্রূন্ যথা বাধতে তমাংসি বাধতে চ।
সরলার্থঃ:- অস্য মন্ত্রস্য সরলার্থঃ যথা – রক্তবর্ণঃ রশ্ময়ঃ ঊষোদেবতাম্ বহন্তি। বীরাঃ সেনানায়কাঃ যথা শত্রূন্ নাশয়ন্তি তদ্বৎ ঊষোদেবী তমঃ হত্বা পৃথিব্যাম্ আলোকম্ আনয়তি ইতি শিবম্।
ঊষাসূক্ত- ষষ্ঠমণ্ডল-৬৪ তম সূক্ত
” ভদ্রা দদৃক্ষ উর্বিযা বি ভাস্যুৎ তে শোচির্ভানবো দ্যামপপ্তন্।
আর্বিবক্ষঃ কৃনুষে শুম্ভমিনোষো দেবি রোচমানা মহোভিঃ”। ৬.৬৪.২
অনুবাদঃ- হে ঊষাদেবী তুমি কল্যানরূপে দৃষ্ট হয়েছে এবং বিস্তৃত হইয়া শোভা পাচ্ছ। তোমার দীপ্তিমান্ রশ্মিসমূহ অন্তরীক্ষে উৎপতিত হইতেছে। তুমি মহৎ তেজঃ সমূহে শোভমানা ও দীপ্যমানা হইয়া প্রকাশ করিতেছে।
উৎসঃ:- অয়ম্ মন্ত্রঃ ঋগ্বেদস্য ষষ্ঠমণ্ডলস্য ঊষাসূক্তে আম্নাতঃ।
ঋষিঃ দেবতা ছন্দঃ চ :- অস্য মন্ত্রস্য ভরদ্বাজঃ ঋষিঃ ঊষা দেবতা, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দঃ চ।
প্রসঙ্গঃ :- অস্মিন্ মন্ত্রে ঋষিঃ ভরদ্বাজঃ উষসঃ স্বরূপম্ প্রকাশয়তি।
অন্বয়ঃ :- অস্য মন্ত্রস্য অন্বয়ঃ যথা- ঊষো দেবি, ভদ্রা দদৃক্ষে। ঊর্বিযা বি ভাসি। তে শোচিঃ ভানবঃ দ্যাম্ উৎ অপপ্তন্। মহোভিঃ শুম্ভমানা বক্ষঃ আবিঃ কৃণুষে।
সায়নভাষ্যম্:- সায়নাচার্যঃ ইমম্ মন্ত্রম্ এবম্ ব্যাখ্যাতবান্ – হে ঊষো দেবি ভদ্রা কল্যানী দদৃক্ষে দৃশ্যসে। ঊর্বিযা বিস্তীর্ণা চ বি ভাসি। শোচিঃ শোচিষঃ দীপ্যমানাঃ ভানবঃ রশ্ময়ঃ দ্যাম্ অন্তরিক্ষম্ উৎ অপপ্তন্ উৎপতন্তি। কিঞ্চ হে ঊষো দেবি মহোভিঃ শুম্ভমানা শোভমানা রোচমানা দীপ্যমানা বক্ষঃ ত্বদীয়ং রূপম্ আবিঃ কৃণুষে প্রকটীকরোষি।
সরলার্থঃ :- অস্য মন্ত্রস্য সরলার্থঃ যথা- ঊষা দেবী সদা কল্যানকারিণী। সা দেবী সমগ্রবিশ্বম্ ব্যাপ্য বিরাজতে। তস্যাঃ রশ্ময়ঃ অন্তরিক্ষম্ উৎপতন্তি। ঊষা স্বতেজসা শোভমানা দীপ্যমানা চ ভাতি ইতি দিক্।
আরো পড়ুন –