ত্রিমুনি ব্যাকরণ সম্পর্কে যা জানো লেখ?
ত্রিমুনি ব্যাকরণ
সূত্রকার পাণিনী, বার্ত্তিককার কাত্যায়ন ও মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি – এই তিনজনকে ত্রিমুনি বলা হয়। এদের তিনজনের ব্যাকরণ গ্রন্থই ত্রিমুনি ব্যাকরণ নামে পরিচিত। নিম্নে এগুলো আলোচিত হল-
ত্রিমুনি ব্যাকরণ: মহর্ষি পাণিনী ও অষ্টাধ্যায়ী
ভূমিকা:- মহর্ষি পাণিনী শুধুমাত্র ‘ত্রিমুনি ব্যাকরণ’ – এর ক্ষেত্রেই নয়, শুধুমাত্র পাণিনী সম্প্রদায়ের বৈয়াকরণগনের মধ্যে নয়, সমগ্র সংস্কৃত ব্যাকরণ শাস্ত্রের জগতেও মধ্যমণি রূপে পরিগণিত হন। পাণিনীর ব্যাকরণকে আজও বহু পন্ডিত মানব মস্তিষ্কের বিষ্ময় বলে মনে করেন।
পাণিনীর রচনাবলী :-
মহর্ষি পাণিনীর লেখা ব্যাকরণ বিষয়ক প্রধান গ্রন্থটি হল অষ্টাধ্যায়ী সূত্রপাঠ।
অষ্টাধ্যায়ী :-
অষ্টাধ্যায়ী হল সূত্রপাঠ, পঞ্চাঙ্গ ব্যাকরণের প্রধান অঙ্গ এটি। সংস্কৃত ভাষা ও বৈদিক ভাষা বিষয়ক প্রায় চার হাজার ব্যাকরণ সূত্রের সমষ্টি হল এই অষ্টাধ্যায়ী। গ্রন্থের সূচনাতেই ১৪টি মাহেশ্বর সূত্র বা শিবসূত্র আছে। স্বরসিদ্ধান্তচন্দ্রিকা নামক গ্রন্থের মতে, এই মহেশ্বর সূত্রগুলি সহ অষ্টাধ্যায়ী-র মোট সূত্রসংখ্যা ৩৯৯৫। অন্য মতে, ৩৯৯৬, ৩৯৯৭ প্রভৃতিও দেখা যায়। সূত্রের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছে বলা হয় যে-
“অল্পাক্ষরমসন্ধিগ্ধং সরবেৎ বিশ্বতো মুখম্।
অস্তোভমববদ্যং চ সূত্রং সূত্রবিদো বিদুঃ।।”
ত্রিমুনি ব্যাকরণ: বার্ত্তিককার কাত্যায়ণ ও বার্ত্তিক:-
কাত্যায়ণ:-
পাণিনি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ত্রিমুনি ব্যাকরণের মধ্যে দ্বিতীয় মুনি হলেন বার্ত্তিককার কাত্যায়ন। কাত্যায়ণকে বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে কাত্য, পূর্ণবসু, বররুচি প্রভৃতি নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির মতে, তিনি দক্ষিণ ভারতীয় ছিলেন।
বার্ত্তিক:-
কাত্যায়ন পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ীস্থ সূত্র গুলির মধ্যে প্রায় বারোশো সূত্রের উপর পরিপূরক সূত্ররূপে প্রায় চার হাজার টি বার্ত্তিক রচনা করেছেন এবং মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির মহাভাষ্যে সেগুলি স্থান পেয়েছে এবং আলোচিত হয়েছে। বার্ত্তিক গুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, পাণিনীয় ব্যাকরণের আলোচনায় এগুলোকে যথেষ্ট পরিমাণে মান্যতাও দেওয়া হয়। মূলসূত্রে উক্ত, অনুক্ত এবং দূরুক্ত বিষয়ের ব্যক্তকরন ঘটিয়ে আলোচনার সম্পূর্ণতা সাধন করাই বার্ত্তিকের প্রধান কাজ। এই কারণেই অনেকে বার্ত্তিককে পরিপূরক সূত্র আখ্যা দিতে চান। বার্ত্তিকের লক্ষণ প্রসঙ্গে তাই বলা হয়েছে-“ঊক্তানুক্ত দূরুক্তানাং ব্যাক্তিকারী।”
ত্রিমুনি ব্যাকরণ: মহর্ষি পতঞ্জলি ও মহাভাষ্য:-
মহর্ষি পতঞ্জলি:-
ত্রিমুনি ব্যাকরণের ক্ষেত্রে তৃতীয় গ্রন্থটি হল মহাভাষ্য। এর রচয়িতা মহর্ষি পতঞ্জলি। তিনি ত্রিমুনি ব্যাকরণের জগতে তৃতীয় মুনি হলেও পাণিনীয় সম্প্রদায়ের বৈয়াকরণগনের মধ্যে তাঁর প্রভাব খুব বেশি – অনেক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। পরবর্তীকালে ভট্টোজি দীক্ষিত প্রমুখ বৈয়াকরণদের স্বীকৃত ‘যথোত্তরং মুনীণাং প্রামাণ্যম্।’ মহাভাষ্যকার পতঞ্জলিকে শেষনাগের অবতার কল্পনা করে মহাভাষ্যকে কোথাও কোথাও ফনিভাষ্যও বলা হয়েছে।
মহাভাষ্য:-
মহাভাষ্য নামটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে যে, পতঞ্জলির এই ভাষ্য কোনো সাধারন ভাষ্য নয়। এটি মহাভাষ্য। ভাষ্যের যেটি প্রচলিত লক্ষণ সেটি মহাভাষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ –
“সূত্রস্থং পদমাদায় বাকৈঃ সূত্রানুসারিভিঃ।
স্বপদানি চ বর্ণ্যন্তে ভাষ্যং ভাষ্যবিদো বিদুঃ।।”
পতঞ্জলির মহাভাষ্যে সূত্রস্থ পদগুলিকে নিয়ে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি নিজের কথাও বলেছেন মহাভাষ্যকার। শুধু তাই নয় বেশ কিছু পাণিনীয় সূত্রকে প্রত্যাখ্যানও করেছেন তিনি। এমন ক্ষমতা খুব কম ভাষ্যকারই দেখতে পেরেছেন। এইভাবে নানাদিক দিয়ে বিচার করলে পতঞ্জলির ভাষ্যের মহাভাষ্যত্ব প্রমাণিত হয়।
মহাভাষ্যের বিষয়বস্তু
মহাভাষ্যের বিষয়বস্তুর কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে, এই গ্রন্থে পাণিনীর সূত্রক্রমে অষ্টাধ্যায়ীস্থ সূত্রগুলিকেই প্রধানতঃ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে সব সূত্রের ব্যাখ্যা পতঞ্জলি করেননি। সূত্র ছাড়া কাত্যায়ন ও সুনাগদির বার্ত্তিকগুলির মহাভাষ্যে স্থান পেয়েছে এবং ব্যাখ্যাত পেয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, বার্ত্তিকগুলির উৎসস্থল এই পাতঞ্জল মহাভাষ্যই। এছাড়া, মহাভাষ্যকারের ইষ্ট্যাদি বচনও এতে স্থান পেয়েছে। পতঞ্জলির এই মহাগ্রন্থখানি কয়েকটি আহ্নিকে বিভক্ত হয়েছে। সমগ্র মহাভাষ্যে মোট ৮৫টি আহ্নিক আছে। আহ্নিক নামটি থেকে কেউ কেউ মনে করেছেন যে, এক এক দিনে যতটা পড়ানো হতো বা যতটা রচনা হত, ততটা অংশই এক একটি আহ্নিকে স্থান পেয়েছে। মহাভাষ্যের প্রথম ৯টি আহ্নিক নবাহ্নিক নামে পরিচিত। পস্পশা আহ্নিকটি শুরু হয়েছে “অথ শব্দানুশাসনম্”- এই কথা দিয়ে। পরপর এখানে ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা, ব্যাকরণের স্বরূপ প্রভৃতি ব্যাকরণ বিষয়ক সাধারন কথাগুলো নিয়ে পতঞ্জলি পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। মহাভাষ্যের রচনাশৈলী এবং গদ্যও পন্ডিতগনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কঠিন বিষয়ও আলোচনার গুনে অনেক ক্ষেত্রেই সরস ও চিত্রগ্রাহী হয়ে উঠেছে।