ব্যক্ত ও অব্যক্তের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য সাংখ্যরীতিতে ব্যাখ্যা কর।
ব্যক্ত ও অব্যক্তের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য সাংখ্যরীতিতে ব্যাখ্যা কর
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা কর-
” হেতুমদনিত্যমব্যাপি সক্রিয়মনেকাশ্রিতং লিঙ্গম্।
সাবয়বং পরতন্ত্রং ব্যক্তং বিপরীতব্যক্তম্।।”
ভূমিকা:- সাংখ্যমতে, মোক্ষসাধন তত্ত্বজ্ঞানের জন্য পঞ্চবিংশতিতত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। সেখানে তথ্যগুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সেগুলি হল- ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ। সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে- ‘ব্যাক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ’। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ – এর বিশেষ জ্ঞানকেই এখানে মোক্ষহেতু তত্ত্বজ্ঞান বলা হয়েছে। সাংখ্য মতে, মূল বস্তুদুটি একটি প্রধান এবং অপরটি প্রকৃতি। প্রকৃতিকেই অব্যক্ত বলা হয়। অব্যক্ত থেকে মহৎ প্রভৃতি কার্য উৎপন্ন হয় বলে এগুলিকে ব্যক্ত বলা হয়। এই ব্যক্ত ও অব্যক্তের মধ্যে যেমন কিছু সাধর্ম্য রয়েছে, তেমনি কিছু বৈধর্ম্যং আছে। ব্যক্ত ও অব্যক্তের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য নিরুপণ প্রসঙ্গে ঈশ্বরকৃষ্ণ দুটি কারিকা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটিতে উভয়ের মধ্যে বৈধর্ম্য নিরূপণ করেছেন এবং দ্বিতীয়টিতে উভয়ের সাধর্ম্য উল্লেখ করেছেন।
ব্যক্ত ও অব্যক্ত-এর বৈধর্ম্য:-
ব্যক্ত ও অব্যক্ত এর বৈধর্ম্য নিরুপণ প্রসঙ্গে ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেছেন-
” হেতুমদনিত্যমব্যাপি সক্রিয়মনেকমাশ্রিতং লিঙ্গম্।
সাবয়বং পরতন্ত্রং ব্যক্তং বিপরীতমব্যক্তম্।।”
এখন উক্ত বৈধর্মগুলি বিশেষভাবে প্রদর্শন করাই আমাদের লক্ষ্য-
- i) ব্যক্তের প্রথম বৈশিষ্ট্য হেতুমত্ত্ব বা কারণ তত্ত্ব। ব্যক্ত কার্যমাত্রই অবশ্যই কোন উপাদান কারণ আছে। প্রকৃতি সেই কারণ। প্রকৃতিই হল মহদাদি ২৩টি ব্যক্ত তত্ত্বের মূল উপাদান কারণ।
কিন্তু ঐ সকল ব্যক্তের বিপরীত ধর্ম বিশিষ্ট অব্যক্ত হল অহেতুমৎ অর্থাৎ কোনো কারণ নেই। - ii) ব্যক্ত পদার্থগুলি অনিত্য অর্থাৎ উৎপত্তি বিনাশশীল। এরা স্ব স্ব কারণ থেকে উৎপন্ন হয়, আবার সেই কারণ সমূহের মধ্যে লীন হয়ে যায়। তাই ব্যক্ত অনিত্য।
কিন্তু অব্যক্তের কোন কারণ না থাকায় এর উৎপত্তি হয় না, তাই বিনাশও হয় না। তাই অব্যক্ত অনিত্য। - iii) ব্যক্ত হল অব্যাপিত্ব। অর্থাৎ মহদাদি তত্ত্বগুলি অব্যক্ত বা প্রকৃতিকে ব্যপ্ত করে থাকে না।
কিন্তু অব্যক্ত সর্বব্যাপী অর্থাৎ সকল কার্য বস্তুকে ব্যপ্ত করে থাকে। - iv) ব্যক্ত হল সক্রিয় অর্থাৎ তারা চলন, বুদ্ধি প্রভৃতি ক্রিয়া যুক্ত। আবার তারা একটি দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহ গ্রহণ করে, তাই এদের সক্রিয় করা হয়েছে। সুতরাং ব্যক্তের পরিস্পন্দ বা সংযোগরূপ ক্রিয়া রয়েছে।
কিন্তু অব্যক্তের পরিস্পন্দ ক্রিয়া না থাকায়, তা নিষ্ক্রিয়। তাছাড়া সর্বব্যাপী ও বিভু বলেও সে নিষ্ক্রিয়। - v) ব্যক্ত অনেক অর্থাৎ প্রত্যেক পুরুষের বুদ্ধি প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় পুরুষের অনেকত্ববশতঃ বুদ্ধ্যাদি অনেক হয়।
কিন্তু অব্যক্তের অপর কোনো ভেদ না থাকায় অব্যক্ত বা প্রকৃতি এক। - vi) ব্যক্ত মহদাদি তত্ত্বগুলি আশ্রিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ স্ব স্ব কারণে অবস্থিত থাকে।
কিন্তু অব্যক্ত বা প্রকৃতির কোনো কারণ না থাকায় তা কোথাও আশ্রিত হয়না। - vii) ব্যক্ত পদার্থগুলি নিজ নিজ কারনে লিঙ্গ বা অনুমাপক হয়।
কিন্তু অব্যক্ত কারো কার্য হয়না বলে কারো লিঙ্গ বা অনুমাপক হয় না। - viii) ব্যক্ত পদার্থ গুলি সাবয়ব অর্থাৎ এগুলি বিচ্ছিন্নভাবে থেকেও সংযোগ যুক্ত।
কিন্তু সর্বব্যাপী প্রকৃতির সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ এইগুলো গুনত্রয়ের সংযোগ হয়না বলে প্রকৃতি নিরাবয়ব। - ix) ব্যক্ত পদার্থগুলি প্রকৃতিকে সর্বদা অপেক্ষা করে বলে এরা পরতন্ত্র।
কিন্তু অব্যক্ত নিজ কার্য জননে কাউকে অপেক্ষা করে না, তাই স্বতন্ত্র।
ব্যক্ত ও অব্যক্তের সাধর্ম্য :-
ব্যক্ত ও অব্যক্ত -এর সাধারণ নিরূপণ করতে গিয়ে ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেছেন –
“ত্রিগুনমবিবেকি বিষয়ঃ সামান্যমচেতনং প্রসবধর্মী।
ব্যক্তং তথা প্রধানম্, তদ্বিপরীতস্তথা চ পুমান্।।”
এখানে ব্যক্ত – অব্যক্তের ছয়টি সাধর্ম্য উল্লেখিত হয়েছে –
- i) সংহত বস্তু মাত্রই ত্রিগুণাত্মক হয় বলে মহদাদি ব্যক্ত সকল ত্রিগুনাত্মক হবে।
- ii) ব্যক্ত ও ব্যক্ত উভয়েই ত্রিগুণ বলে ভিন্ন হওয়ায় অবিবেকী অর্থাৎ পরস্পর ভেদ বিশিষ্ট।
- iii) ব্যক্ত ও অব্যক্ত উভয়েই পুরুষের ভোগ ও জ্ঞানের বিষয় হয়ে থাকে। তাই বিষয়ত্ব উভয়েরই অসাধারণ ধর্ম।
- iv) ব্যক্ত ও অব্যক্তের অপরাধ সাধর্ম্য হল সাধারণত্ব বা সামানত্ব। অর্থাৎ ব্যক্ত ও অব্যক্ত উভয়ই অনেক ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত হয়ে থাকে।
- v) ব্যক্ত ও অব্যক্ত উভয়েই অচেতন, তাই স্বয়ং অপরকে প্রকাশ করতে পারে না।
- vi) ব্যক্ত ও অব্যক্ত উভয়েই প্রসব ধর্মী অর্থাৎ সর্বদাই পরিনামশীল। এমন কোনো সময় নেই যখন এরা পরিনাম শূন্য হয়।
মূল্যায়ন:-
ব্যক্তের সাধর্ম্যের দ্বারা অব্যক্তের অনুমান করা হয়েছে এবং ব্যক্ত ও অব্যক্তের সংখ্যাতত্ত্বের পরার্থহেতু পুরুষকে অনুমান করা হয়েছে। অর্থাৎ জড় বস্তুগুলি সংহত হয়ে অপরের প্রয়োজন সাধন করে বলে জড়ের অধিষ্ঠান ও ভোক্তার চেতন পুরুষ অনুমিত হয়। এই পুরুষেই এখানে জ্ঞ শব্দবাচ্য। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্ত ও অব্যক্ত ও জ্ঞ- এর সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যের সম্যক জ্ঞানই সাংখ্য মতে তথ্যবিজ্ঞান।
সাংখ্যকারিকা হতে অন্যান্য প্রশ্ন উত্তর
- তার্কিক সম্মত অসৎকার্যবাদ খন্ডন করে সৎকার্যবাদ সাংখ্যকারিকা অনুসারে ব্যাখ্যা
- গুণের লক্ষণ স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্যসমূহ
- সাংখ্য দর্শন অনুসারে প্রমাণসমূহ সবিস্তারে আলোচনা
- পুরুষের বহুত্বসাধক প্রমাণসমূহ ঈশ্বর কৃষ্ণের মতানুসারে আলোচনা
- সাংখ্য দর্শনের স্রষ্ঠা কে? সাংখ্য শাস্ত্রীয় পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব সমূহের প্রকারভেদ
- প্রত্যক্ষ প্রমাণ কি? প্রত্যক্ষের বাধক গুলি কি কি?
- সাংখ্যকারিকা: কারিকা ব্যাখ্যা