দৃষ্টান্ত সহযোগে আত্মার অশরীরত্ব, নিত্যত্ব ও নিত্যমুক্তত্ব শাঙ্কররীতিতে প্রতিষ্ঠা কর।
দৃষ্টান্ত সহযোগে আত্মার অশরীরত্ব, নিত্যত্ব ও নিত্যমুক্তত্ব শাঙ্কররীতিতে প্রতিষ্ঠা কর
উ:- সর্বসাধারণের এটাই অনুভবসিদ্ধ যে, শরীরবিশিষ্ট আত্মা বর্ণ, আশ্রম, নাম, জাতি প্রভৃতি দ্বারা নিয়ত অনুবিদ্ধ হয়। তাই শরীর নাশের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণাশ্রমাদির নাশ হওয়ায় আত্মারও বিনাশ অনিবার্য হবে। সুতরাং আত্মার পরলোক সম্বন্ধিত্ব বা নিত্যত্ব কখনোই সম্ভবপর হয় না। তাছাড়া শরীর নিষ্ট আত্মা সুখ-দুঃখাদির ভোক্তা রূপে বিবেচিত হয়।
‘ন হ বৈ সশরীরস্য সতঃ প্রিয়াপ্রিয়য়োরপঅতিরস্তি’।
এর ফলে বিষয়ভোগবদ্ধ আত্মার নিত্যমুক্তত্ব ব্যাহত হয়।এরূপ আশঙ্কা নিরসনার্থে একাদশ শ্লোকটির অবতারনা-
“নানোপাধিবশাদেব জাতিনামাশ্রমাদয়ঃ।
আত্মন্যারোপিতাস্ততোয়ে রসবর্ণাদিভেদবৎ।।”
মায়াকল্পিত নানা উপাধিবশত নাম, জাতি প্রভৃতি আত্মায় আরোপিত হয়। সুতরাং নামজাত্যাদি আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম নয়, তাই এগুলি আত্মার বিশেষণ নয়। নামজাত্যাদি যদি আত্মার বিশেষণ হত তবেই বিরোধিগণের উক্ত আশঙ্কা সমীচীন হত। কেননা, নিত্য কার্যান্বয়ী ব্যাবর্ত্তক ধর্মই হবে বিশেষণ। যেমন- নীলাদিগুন দ্রব্যে নিয়ত সম্বন্ধ হওয়ায় বিশেষণরূপে পরিগণিত হয়।
তাই সেই সেই দ্রব্য থেকে নীলাদি ধর্মের উচ্ছেদ কখনোই হয় না। এইরম নামজাত্যাদি যদি আত্মায় বিশেষণরূপে অন্বিত হত, তবে আত্মায় নিয়ত সম্বন্ধ নামজাত্যাদির নাশে আত্মনাশ অবশ্যম্ভাবী হত। কিন্তু বৈদান্তিক দৃষ্টিতে নামজাত্যাদি আত্মার বিশেষণ না হয়ে উপাধি রূপে পরিগৃহীত হয়। কার্যান্বয়ী ব্যবর্ত্তক ধর্মকেই উপায় বলে। যেমন জপাকুসুমের সান্নিধ্যে স্বভাবশুক্ল স্ফটিক রক্তিম বলে অনুভূত হয়। কিন্তু জপাকুসুমের অপসারণে শুক্লভাস্কর স্ফটিক স্বস্বরূপে প্রকাশিত হয়। সুতরাং জপাকুসুমের লোহিত্যধর্ম স্ফটিকে আরোপিত হয়, তাই এটি স্ফটিকে নিহত সম্বন্ধ হয় না।
এ ক্ষেত্রে ব্যবর্ত্তক হলেও লোহিত্য ধর্মটি কার্যান্বয়ী না হওয়ায় সেটি স্ফটিকের বিশেষণ না হয়ে উপাধি হয়। এরূপ নাম, জাতি, আশ্রম প্রভৃতি আত্মায় মায়াবশতঃ আরোপিত হয় বলে আত্মায় নিয়ত সম্বন্ধ হয় না। তাই কার্যান্বয়ী না হওয়ায় এগুলি আত্মার বিশেষণ না হয়ে উপাধিই হবে। সুতরাং আত্মা স্বভাবত নামজাত্যাদিশূণ্য হলেও মায়াবশতঃ নামজাত্যাদিবিশিষ্ট – রূপে পরিকল্পিত হয়।
আচার্য এখানে একটি বিশেষ উপমা প্রদর্শন করে বিষয়টিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। ‘তোয়ে রসবর্ণাদিভেদবৎ’- যেমন স্বভাবমধুর ও স্বভাব ভাস্বর জলে তিক্ত, অম্ল, নীল, পীত প্রভৃতি নানা রস ও বর্ণ আরোপিত হয়, তেমনি নানা উপাধিযোগে আত্মাতে নাম, জাতি, আশ্রম প্রভৃতি আরোপিত হয়। এই আরোপজ্ঞানটি বাস্তবিক নয়, কাল্পনিক। সুতরাং নামজাত্যাদি আত্মায় আরোপিত হওয়ায় কল্পিত নামজাত্যাদির দ্বারা আত্মা নিত্য সম্বন্ধ হয়না। কেননা আরোপিত ধর্ম স্বাধিষ্ঠানে অনুমাত্রও সংশ্লিষ্ট হয়না। আচার্য্য শঙ্কর একথা স্বয়ং বেদান্তদর্শনভাষ্যে সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করেছেন-
“যত্র যদধ্যাসস্তৎকৃতেন দোষেন গুনেন বা অনুমাত্রমপি স ন সম্বধ্যতে”।।
অতএব, আত্মা নামজাত্যাদি দ্বারা নিত্যসম্বন্ধ না হওয়ায় নামজাত্যাদির নাশে আত্মার বিন্দুমাত্র স্বরূপহানিও ঘটে না। এইভাবে আত্মার বেদান্তসম্মত নিত্যত্ত্ব ও নিত্যমুক্তত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- আত্মবোধপ্রকরণ: সংস্কৃত ব্যাখ্যা
- আত্মবোধপ্রকরণ: দৃষ্টান্ত সহযোগে আত্মার অশরীরত্ব, নিত্যত্ব ও নিত্যমুক্তত্ব শাঙ্কররীতিতে প্রতিষ্ঠা
- আত্মবোধপ্রকরণ: অজ্ঞানের দূরীকরণ বা নিরাকরণ কিভাবে সম্ভব?
- আত্মবোধপ্রকরণ: অনুবন্ধ কাকে বলে? কয়প্রকার ও কী কী?
- আত্মবোধপ্রকারণ : আত্মার একত্ব প্রতিপাদন