ঋকসংহিতার প্রথম মণ্ডলের ১৫৪ সংখ্যক সূক্ত অনুসারে বিষ্ণু দেবতার স্বরূপ আলোচনা করা হল ।
ঋগ্বেদীয় বিষ্ণু দেবতার স্বরূপ আলোচনা করো
অবস্থান- | ঋকবেদ -প্রথম মন্ডল -১৫৪ তম সূক্ত |
ঋষি | ঋষি – উচথ্যের পুত্র দীর্ঘতমা |
ছন্দ | ত্রিষ্টুপ্ |
দেবতা | বিষ্ণু |
মন্ত্র সংখ্যা | ৬টি |
ভূমিকা:- ঋকবেদে বিষ্ণু সৌরদেবমন্ডলীর অন্যতম। পৌরাণিক দেবতাদের মধ্যে তিনি প্রধান তিন দেবতার একজন হলেও ঋকবেদের দেবতাদের মধ্যে তার স্থান গৌণ। বিষ্ণুর মহিমার তুলনা নেই। তিনি ত্রিবিক্রম। তিনি ত্রিপাদবিক্ষেপের দ্বারা তিন লোক পরিব্যপ্ত করে আছেন। তাঁর পদক্ষেপ অত্যন্ত দীর্ঘ। মধ্যাহ্নকালীন সূর্যরূপে তিনি দ্যুলোকের চক্ষু স্বরূপ। তাঁর মহিমা এমনই যে তাঁর পরমপদ সকলের দৃষ্টিগোচর হয় না।
একমাত্র সূরিগন এই পথ দর্শন করতে সমর্থ হয়-
“তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ”।
বিষ্ণু শব্দের নির্বাচন :-
বিষ্ণু শব্দের নির্বচন প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে – ‘বিষ্ণু ব্যাপ্তৌ‘। অর্থাৎ ব্যাপ্ত করা অর্থে বিষ্ ধাতু হইতে বিষ্ণু শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ যিনি ব্যাপ্ত করেন তিনিই বিষ্ণু। বিষ্ণু ত্রিভুবনকে ব্যাপ্ত করেন।
বিষ্ণুই সমস্ত যজ্ঞভূমিকে পরিব্যাপ্ত করে থাকেন –
‘যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ’।
বিষ্ণু সুক্তের ঋষি, ছন্দ ও দেবতা :-
ঋক সংহিতার প্রথম মণ্ডলের ১৫৪ সংখ্যক সূক্তটি ছয়টি মন্ত্রের সমাহার। আলোচ্য সূক্তের ঋষি হলেন উচথ্যের পুত্র দীর্ঘতমা এবং ছন্দ হল ত্রিষ্টুপ্। আর দেবতা হলেন বিষ্ণু।
বিষ্ণু দেবতার স্বরূপ:-
এই সূক্তে বিষ্ণু দেবতার যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে, তা নিম্নে বর্ণিত হল-
বিষ্ণু দেবতা ত্রিলোকের নির্মাতা :-
বিষ্ণু হলেন পার্থিব লোক সমূহের নির্মাতা। পার্থিব লোকসমূহ বলতে তিনটি লোককেই বোঝাচ্ছে।
সায়ণাচার্য বলেছেন –
“অত্র ত্রয়ো লোকা অপি পৃথিবীশব্দবাচ্যাঃ।”
তিনি ঊর্দ্ধে অন্তরীক্ষলোককে স্তম্ভিত করেছেন। বিবিধরূপে তিনি তিনবার পরিক্রমণ করেছেন। বিষ্ণুর এইরূপ বীরত্বকর্মকে সকলেই প্রশংসা করে।
ঋষির দৃষ্টিতে-
“বির্ষ্ণোনু কং বীর্যানি প্র বোচং যঃ পার্থিবানি বিমমে রজাংসি।
যো অস্কবায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্রমাণস্ত্রেধোরুগায়ঃ।।”
বিষ্ণু দেবতা বিক্রমশালী:-
বিষ্ণুর বিক্রম অতুলনীয়। তাই ঋষি উপমা দিয়েছেন- সিংহ অন্যান্য পশু ও মনুষ্য সকলের ভীতিজনক। কারণ সিংহের বিক্রমের কাছে সকলেই পরাজিত। সিংহ অনায়াসে কুৎসিত হিংসকর্ম করে। সিংহের এইরূপ বিক্রমের জন্য ও অসাধারন শক্তির জন্য সে স্তুত হয়। সেইরূপ সীমাহীন বিক্রমের জন্য বিষ্ণুও স্তুত হন।
ঋষির দৃষ্টিতে-
” প্রতদ্বিষ্ণুঃ স্তবতে বীর্যেণ মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ।
যস্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষ্বধিক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা।।”
বিষ্ণু দেবতা উন্নত প্রদেশবাসী ও অভিষ্টবর্ষী:-
বিষ্ণুই হলেন এক এবং অদ্বিতীয়, যিনি ত্রিপাদের দ্বারা লোকত্রয়কে বিশেষভাবে নির্মাণ করেছেন। গিরিবৎ উন্নতপ্রদেশে বিষ্ণুর অবস্থান। যারা তাঁর উদ্দেশ্যে প্রশস্তি বাক্য উচ্চারণ করেন, তাদের কামনা তিনি পূর্ণ করেন।
ঋষির দৃষ্টিতে-
” প্র বিষ্ণবে শূষমেতু মন্ম গিরিক্ষিত উরুগায়ায় বৃষ্ণে।
য ইদং দীর্ঘং প্রযতং সধস্থমেকো বিমমে ত্রি ভিরিৎ পদেভিঃ।।”
অমৃতময় মধুর ন্যায় চরণবিশিষ্টও সকলের ধারক:- বিষ্ণু তিনটি চরণ অমৃতময় মধুর দ্বারা পূর্ণ। তাঁর পদক্ষেপসমূহ ক্ষয়রহিত। তিনি চতুর্দশ লোকের ধারণকর্তা। পৃথ্বী,জল ও তেজ- এই ধাতুত্রয়বিশিষ্ট পৃথিবী ও দ্যুলোককে তিনিই একমাত্র ধারণ করেছেন।
ঋষির দৃষ্টিতে-
“যস্য ত্রী পূর্ণা মধুণা পদান্যক্ষীয়মাণা স্বধয়া মদন্তি।
য উ ত্রিধাতু পৃথিবীমুতদ্যামেকো দাধার ভুবনানি বিশ্বা।।”
বিষ্ণু দেবতা মোক্ষদানকারী:-
বল শালী বিষ্ণুর পরমপদে আছে অমৃতের উৎস। এই উৎসে মনুষ্যের ক্ষুধা-তৃষ্ণা -মৃত্যু পুনর্জন্মরূপ কোনো ভয়ই থাকে না। তিনি প্রকৃত বন্ধু, কারণ তার পদপ্রাপ্ত হলে মনুষ্য মোক্ষলাভ করে।
ঋষির দৃষ্টিতে-
” তদস্য প্রিয়মভি পাথো অশ্যাংনরো যত্র দেবযবো মদন্তি।
উরুক্রমস্য স হি বন্ধুবিথ্থা বিষ্ণোঃ পদে পরমে মধ্ব উৎসঃ।।”
বিষ্ণুদেবতা বহুজন স্তুত:-
যজমান ও যজমানপত্নী দুজনেই কামনা করেছেন একটি সুখনিবাসযোগ্য স্থান, যেখানে গোসমূহ অর্থাৎ রক্ষি সকল অতি উন্নত স্থানে বিরাজমান ও অতিবিস্তৃত। ঐস্থানে বহুজনের দ্বারা স্তুত ও অভিষ্টবর্ষী বিষ্ণুর পরমপদ প্রভৃতি রূপে প্রকাশিত হয়।
বিষ্ণুদেবতার সীমাহীন মাহাত্ম্য
উপসংহার :- বিষ্ণুর এই পাদবিক্ষেপের বিষয়টি একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। বিষ্ণু দ্যুলোকের দেবতা। ঋকবেদে তাঁর স্থান গৌণ। তাঁহার মহিমা কীর্তিত হয়েছে পাঁচটি সূক্তে। বিষ্ণু সকলের রক্ষক ও পালক। যাই হোক এই সূক্তে বিষ্ণুদেবতার সীমাহীন মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। তিনি সকলের প্রণম্য।
বিষ্ণুসূক্ত- প্রথমমণ্ডল- ১৫৪তম সূক্ত- দ্বিতীয় মন্ত্র
“প্র তদ্বিষ্ণুঃ স্তবতে বীর্যেণ মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ।
যস্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষ্বধিক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা।।”
অনুবাদ:- যেহেতু বিষ্ণুর তন পদক্ষেপে সমস্তভুবন অবস্থান করে, অতএব ভয়ঙ্কর, হিংস্র, গিরিশায়ী অরণ্য জন্তুর ন্যায় বিষ্ণুর বিক্রম লোকে প্রশংসা করে।
উৎসঃ:- অয়ম্ মন্ত্রঃ ঋগ্বেদস্য প্রথমমণ্ডলস্য বিষ্ণুসূক্তে আম্নাতঃ।
ঋষিঃ দেবতা ছন্দঃ চ:- অস্য মন্ত্রস্য দীর্ঘতমা ঋষিঃ, বিষ্ণুঃ দেবতা, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দঃ চ।
প্রসঙ্গঃ :- অস্মিন্ মন্ত্রে ঋষিঃ দীর্ঘতমা বিষ্ণোঃ স্বরূপম্ প্রকাশয়তি।
অন্বয়ঃ :- অস্য মন্ত্রস্য অন্বয়ঃ যথা- প্র তদ্বিষ্ণুঃ বীর্যেণ স্তবতে মৃগো ন ভীমঃ কুচরঃ গিরিষ্ঠাঃ। যস্য উরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষু বিশ্বা ভুবনানি অধিক্ষিয়ন্তি।
সায়নভাষ্যম্:- সায়নাচার্যঃ ইমম্ মন্ত্রম্ এবম্ ব্যাখ্যাতবান্ – স মহানুভাবঃ বীর্যেন স্বকীয়েন বীরকর্মণা পূর্বোক্তরূপেন স্তবতে স্তূয়তে সর্বৈঃ। মৃগো ন সিংহাদিরিব। যথা- স্ববিরোধিনী মৃগয়িতা সিংহঃ ভীমঃ ভীতিজনকঃ কুচরঃ কুৎসিতহিংসাদিকর্তা দুর্গমপ্রবেশগন্তা বা গিরিষ্ঠাঃ পর্বতাদ্যুন্নতপ্রদেশস্থায়ী সর্বৈঃ স্তূয়তে। কিঞ্চ যস্য বিষ্ণোঃ উরুষু বিস্তীর্নেষু ত্রিসংখ্যকেষু বিক্রমণেষু পাদপ্রক্ষেপেষু বিশ্বা সর্বাণি ভুবনানি ভূতনানি অধিক্ষিয়ন্তি আশ্রিত্য নিবসন্তি। স বিষ্ণুঃ স্তূয়তে।
সরলার্থঃ:- অস্য মন্ত্রস্য সরলার্থঃ যথা- ভগবতঃ বিষ্ণোঃ ত্রিষু পদেষু নিখিলম্ ভুবনম্ বিরাজতে। তস্য দেবস্য বিক্রমঃ অতুলঃ। উপময়া ইদম্ বিশদীক্রিয়তে- সর্বৈঃ মৃগৈঃ সিংহঃ স্তূয়তে। যতঃ সঃ মৃগেন্দ্রঃ। তস্য পরাক্রমং নিকষা সর্বে মৃগাঃ পরাজয়ন্তে। তদ্বৎ বিষ্ণোঃ সীমাহীনবিক্রমাৎ সঃ দেবঃ সবৈঃ জীবৈঃ স্তূয়তে ইতি শিবম্।
আরো পড়ুন –