মুন্ডকোপনিষদ্ হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হল । এছাড়া মুন্ডকোপনিষদ্ হতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হল।
মুন্ডকোপনিষদ্ হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
১) উপনিষদ্ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ লেখো।
উ:- উপনিষদ্ শব্দটি সদ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। উপ-নি-সদ্+ক্বিপ্=উপনিষদ্। সদ্ ধাতুটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা- বিনাশ করা, দেখা বা বোঝা এবং মিলিত হওয়া। তাই উপনিষদ শব্দটির অর্থ হল গুরু সমীপে বসে মিথ্যা বা অজ্ঞানতাকে দূর করে সত্য তথা আত্মাকে বোঝা।
২)মুন্ডকোপনিষদ্ -এর এরূপ নামকরণের কারণ লেখ।
উ:- মুন্ডকোপনিষদ্-এর এরূপ নামকরণ সম্বন্ধে তিনটি অভিমত প্রচলিত আছে।
- i) মন্ডপ শব্দটি মূল্য ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। যার অর্থ হল মুন্ডন করা। এই উপনিষদ অজ্ঞানতা দূর করে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো প্রজ্জ্বলিত করে। তাই এরূপ নামকরণ হয়েছে।
- ii) আবার অনেকের মতে অথর্ববেদের উপনিষদ গুলির মধ্যে এই উপনিষদটি শ্রেষ্ঠ। তাই এর নাম হয়েছে মুণ্ডক। মুণ্ড শব্দটির অর্থ হল মাথা। মাথা যেমন মানুষের শ্রেষ্ঠ অঙ্গ তেমনি এই উপনিষদটি অথর্ববেদীয় উপনিষদ গুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় এরূপ নামকরণ হয়েছে।
iii) আবার কেউ কেউ বলেন মুন্ডক নামক ঋষি এই উপনিষদের উপদেষ্টা বলে এইরূপ নামকরণ হয়েছে।
৩) মুণ্ডকোপনিষদ্ এর মন্ত্র সংখ্যা কত?
উ:- মুণ্ডকোপনিষদ্ এর মন্ত্র সংখ্যা ৬৪টি।
৪) মুণ্ডকোপনিষদ্ এর বক্তা ও শ্রোতা কে?
উ:- মুণ্ডকোপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মবিদ্যা বিষয়ক তত্ত্বের প্রথম উপদেষ্টা হলেন ব্রহ্মা, তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র অথর্বাকে এ বিদ্যা প্রদান করেন। অথর্বা অঙ্গীরা নামক এক ঋষিকে এই বিদ্যার কথা বলেন। অবশেষে ঋষি অঙ্গিরা সেই ব্রহ্মবিদ্যা ঋষি শৌণককে শুনিয়েছিলেন।
৫) মুণ্ডকোপনিষদ্- কোন বেদের অন্তর্গত?
উ:- মুণ্ডকোপনিষদ্ অথর্ববেদের অন্তর্গত।
৬) তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে- এখানে পরাবর শব্দটির অর্থ কী? তস্মিন্ পদ কাকে বোঝানো হয়েছে?
উ:- পরাবর শব্দটিতে পর শব্দের অর্থ হল শ্রেষ্ঠ এবং অবর শব্দের অর্থ হল নিকৃষ্ট। সুতরাং পরাবর শব্দটির অর্থ হল কারনরূপে শ্রেষ্ঠ এবং কার্যরূপে নিকৃষ্ট।
তস্মিন্ পদটির দ্বারা পরমাত্মা ব্রহ্মকে বোঝানো হয়েছে।
৭) মুণ্ডকোপনিষদ্-এ কতগুলি মুন্ডক ও অধ্যায় আছে?
উ:- মুন্ডকোপনিষদে তিনটি মুণ্ডক আছে। প্রতিটি মুণ্ডকে দুটি করে অধ্যায় বর্তমান। সুতরাং এই উপনিষদে ছয়টি অধ্যায় বর্তমান।
৮) তস্য ভাসা সর্বনিদং বিভাতি – এখানে তস্য পদের দ্বারা কার কথা বলা হয়েছে? তাঁর দ্বারা কেন সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়?
উ:- মুন্ডকোপনিষদের তৃতীয় মুন্ডকের প্রথম খন্ড থেকে সংকলিত আলোচ্য মন্ত্রটিতে তস্য পদের দ্বারা পরমাত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে।
ব্রহ্ম স্বয়ং প্রকাশমান তাই চন্দ্র-সূর্যাদি জ্যোতিষ্ক পদার্থ এবং সমগ্র বিশ্ব চরাচর তাঁর অনুগত হয়ে তার দীপ্তিতেই উদ্ভাসিত হয়।
৯) পরাপর দৃষ্ট হলে দ্রষ্টার সমস্ত কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয় কেন?
উ:- পরাপর দৃষ্ট হলে দ্রষ্টা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে। ফলে তার হৃদয়ে আশ্রিত কামনা-বাসনা গুলি দূর হয়। তার মনে সকল সংশয়ের অবসান ঘটে। তাই তার কামনা বাসনা জনিত সকল কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
৯) দুটি পাখি গাছে বসে কী করে? অথবা দুটি পাখির আড়ালে কাদের কথা বলা হয়েছে?
উ:- দুটি পাখি গাছে বসে একজন স্বাদু তথা মিষ্টি ফল খায় এবং অন্যজন না খেয়ে শুধুমাত্র দেখে। এখানে দুটি পাখির আড়ালে জীবাত্মা ও পরমাত্মার কথা বলা হয়েছে এবং বৃক্ষ বলতে জীবদেহকে বোঝানো হয়েছে।
জীবাত্মা কামনা-বাসনাজনিত কর্মফল ভোগ করে। কিন্তু পরমাত্মা কোনো কর্মফল ভোগ না করে কেবলমাত্র দেখে।
১০) কিভাবে দুটি পাখি একই বৃক্ষে অবস্থান করে ভিন্ন ভিন্ন কর্মে লিপ্ত হয়? মুণ্ডকোপনিষদ্- অনুসারে লিখ?
উ:- ঋষি অঙ্গিরা ঋষি শৌণককে ব্রহ্মবিষয়ক উপদেশ প্রদানকালে জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেছেন-
“দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য-
নশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি।।”
এখানে দুটি পাখি বলতে জীবাত্মা এবং পরমাত্মাকে বোঝানো হয়েছে এবং বৃক্ষ শব্দটির দ্বারা জীবদেহকে বোঝানো হয়েছে। জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপ দুটি পাখি বৃক্ষরূপদেহকে আশ্রয় করে একই সঙ্গে অবস্থান করে। বৃক্ষ এবং দেহ এই দুটি বস্তুই চিরস্থায়ী নয়- অল্প দিনের মধ্যেই এগুলির বিনাশ ঘটে। বৃক্ষের সাধারণত পাখিরা বাস করে এবং জীবদেহে জীবাত্মা ও পরমাত্মা সর্বদা সংযুক্ত হয়ে অবস্থান করে। এরা কেউ কাউকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে থাকতে পারে না। জীব সর্বদা ঈশ্বরের আশ্রয় থাকে, ঈশ্বরও স্বতন্ত্রভাবে জীবদেহে থাকতে পারে না। তাই জীব ও ঈশ্বর পরস্পর সখ্যবন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু জীবাত্মা যখন নিজেকে পরমাত্মা হতে আলাদা ভেবে কর্মে লিপ্ত হয়, তখন সে আসক্তি জনিত কর্মের ফল সুখ- দুঃখ ইত্যাদি ভোগকরে। কিন্তু ঈশ্বর তথা পরমাত্মা কোন কর্মে লিপ্ত না হয়ে অধ্যক্ষ রূপে জীবদেহে অবস্থান করে শুধুমাত্র দেখেন। সুতরাং তাকে সুখ-দুঃখ কর্মফল ভোগ করতে হয় না।
১২) আত্মাকে কীভাবে লাভ করা যায়?
উ:- অনবরত ধর্মানুষ্ঠান, সত্য উপলব্ধি, ইন্দ্রিয় সংযম, একাগ্র চিত্তে পরমাত্মার ধ্যান ইত্যাদি তপস্যার দ্বারা এবং সম্যক্ জ্ঞানলাভ ও নিত্য ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা আত্মাকে লাভ করা যায়।
১৩) দেবযান কি? দেবযান কিসের দ্বারা বিস্তৃত হয়? অন্য একটি যানের নাম লিখ?
উ:- দেবযান হল উত্তম মার্গ। অর্থাৎ মর্ত্য লোক থেকে স্বর্গলোকে আরোহণের পথ। দেবযান সত্যের দ্বারা বিস্তৃত।
দেবযান ব্যতীত অন্য একটি যান হল পিতৃযান।
১৪) ব্রহ্মদর্শন হলে কী হয়?
উ:- ঋষি অঙ্গিরার মতে চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে ব্রহ্মদর্শন হলে হৃদয় গ্রন্থির সকল কামন বাসনা দূর হয়। সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয় এবং ফলে জীবের সমস্ত কর্মফল ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।
১৫) ব্রহ্ম কিভাবে একই সঙ্গে দূর হতে দূরে, আবার একই দেহে অতি নিকটে অবস্থান করেন?
উ:- ব্রহ্ম অজ্ঞানীর নিকট দূর হতে দূরে অবস্থান করেন। কারণ অজ্ঞানতাই ব্রহ্ম দর্শনের প্রধান বাধা। অজ্ঞানীরা অবিদ্যার দ্বারা আবৃত থাকায় ব্রহ্মকে দেখতে পায় না। তাই ব্রহ্ম তাদের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেন।
অপরপক্ষে যারা জ্ঞানী ব্যক্তি তারা সত্য, তপস্যা, সম্যক্ জ্ঞান এবং ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা এই ব্রহ্মকে নিজে দেহে অতি নিকটে উপলব্ধি করেন।
১৬) সর্বমেবাবিশন্তি -কারা কোথায় প্রবেশ করেন?
উ:- আত্মজ্ঞান লাভের দ্বারা তৃপ্ত পরমাত্মার সঙ্গে সংযুক্ত, আসক্তি শূন্য এবং বিবেকবান ঋষিগন সর্বত্র বিরাজমান ব্রহ্মের মধ্যে প্রবেশ করেন।
১৭) ব্রহ্মচর্য কী?
উ:- ইন্দ্রিয়কে সংযত করে মনের অনাচার দূর করে, জীবনব্রত পালনই হলো ব্রহ্মচর্য।
১৮) আপনাকে উপলব্ধি করার চারটি উপায় কি কি?
উ:- সত্য,তপস্যা, সম্যক জ্ঞান এবং ব্রহ্মচর্য।
১৯) সত্যমেব জয়তে- কে জয়লাভ করে এবং সত্যের দ্বারা আস্তীন পথটির নাম কি?
উ:- সত্যবাদীরা জয়লাভ করে মিথ্যাবাদীরা নয়, সত্যের দ্বারা আস্তিন পদটির নাম দেবযান।
২০) দেবযান কী?
উ:- উত্তর মার্গ নামক দিব্য পথের নাম দেবযান। সত্যকে অবলম্বনকারী ঋষিগন এই পথে গমন করেন। দেবযান সত্যের দ্বারা আস্তীন।
২১) আত্মাকে লাভ করলে বা জানলে কী হয়?
উ:- আত্মাকে লাভ করলে সত্য দ্রষ্টা ঋষিগন সেই জ্ঞানের দ্বারা তৃপ্ত হয় এবং তাদের সমস্ত আসক্তি দূর হয় এবং তাদের চিত্ত শান্ত হয়ে ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যায়।
২২) ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা – এই অংশের তাৎপর্য কি?
উ:- ব্রহ্ম আকারহীন অর্থাৎ অদৃশ্য। তাই তাকে চক্ষু দ্বারা দেখা সম্ভব নয়। আবার এর আকার ও প্রকার সবকিছুই অজানা, তাই অজানাকে বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না।
২৩) পরামৃতা পরিমুচ্যন্তি সর্বে- এই মন্ত্রাংশটির অর্থ কি?
উ:- পরম আত্মাকে নিশ্চিত ভাবে জেনে সন্ন্যাস যোগের দ্বারা সকল বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ হয়।
অথবা, সকল সাধকগন জীবিত অবস্থাতে ব্রহ্ম স্বরূপ হয়ে যায়।
২৪) নান্যৈর্দেবৈস্তাপসা কর্মণা বা- এখানে দেবৈ ও তপস্যা শব্দের অর্থ কি?
উ:- দেবৈঃ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা।
তপসা শব্দের অর্থ তপস্যা বা কর্মের দ্বারা।
২৫ ) ‘বেদান্ত বিজ্ঞানসুনিশ্চিতার্থাঃ’ – উক্তিটির অর্থ কি?
উ:- বেদান্ত অনুশীলনের ফলে যে নিশ্চিত জ্ঞান উৎপন্ন হয় অর্থাৎ যারা ব্রহ্মের উপলব্ধি করেছেন তাদের উপলব্ধি করেছেন।
২৬) সমানে বৃক্ষে পুরুষ নিমগ্নঃ – এখানে সমানে বৃক্ষে এবং পুরুষ শব্দগুলির দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে?
উ:- অর্থবেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত ‘মুণ্ডকোপনিষদ’ থেকে সংকলিত আলোচ্য মন্ত্রটিতে সমানে বৃক্ষে শব্দটির দ্বারা একই গাছে অর্থাৎ একই দেহে বোঝানো হয়েছে।
পুরুষঃ শব্দটির দ্বারা কর্মফলভোগী জীবকে বোঝানো হয়েছে।
২৭) জীব কিভাবে বীতশোক হতে পারে?
উ:- পুরুষ অর্থাৎ ভোক্তা জীব যখন যোগী ব্যক্তিদের দ্বারা সেবিত ঈশ্বরকে তথা পরম আত্মাকে নিজদেহে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তখন সে বীতশোক অর্থাৎ চিরতরে দুঃখমুক্ত হয়।
২৮) সর্বমেবা বিশন্তি – কারা কোথায় প্রবেশ করেন?
উ:- আলোচ্য মন্ত্রটি মুন্ডকোপনিষদ -এর তৃতীয় মন্ডলের প্রথম খন্ড থেকে সংকলিত।
চিত্ত শুদ্ধির মাধ্যমে তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষিগন আত্মাকে যথাযথভাবে জেনে জ্ঞান লাভের দ্বারা তৃপ্ত হয়ে নিজদেহে পরমাত্মার উপস্থিতি উপলব্ধি করে ব্রহ্মের মধ্যেই প্রবেশ করেন।
২৯) ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির পরমাত্মা লাভের তুলনাটি কিরূপ?
উ:- অথর্ব বেদের শৌণকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদ্ -এ ব্রহ্মোজ্ঞ ব্যক্তির পরমাত্মা লাভের সঙ্গে প্রবাহমান নদীগুলির নাম রূপ ত্যাগ করে সমুদ্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া।
৩০) কারা পরিমুক্ত হন?
উ:- বেদান্ত বিজ্ঞান বিষয়ে যারা নিশ্চিত রূপে জ্ঞান লাভ করেছেন এবং সর্ব কর্ম পরিত্যাগ রূপে সন্যাসযোগের দ্বারা যেসব সিদ্ধ পুরুষগণ জীবিত অবস্থায় ব্রহ্মের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা দেহত্যাগের পরেও সম্পূর্ণরূপে পরিমুক্ত হন।