ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা অনুসারে সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য উপস্থাপণ কর।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা – সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
উ:- ভূমিকা:- বেদের দুটি ভাগ-মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণভাগ। ব্রাহ্মণভাগেরও দুটি ভাগ- বিধিভাগ ও অর্থবাদভাগ। সায়ণাচার্য জৈমেণীয় সূত্র উদ্ধৃত করে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ বিবেচনা করে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্যও স্থাপন করেছেন।
অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
ব্রাহ্মণের অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য নেই, এই মত প্রকাশ করে পূর্বপক্ষ:-
এখন বিচার্য্য, অর্থবাদ বাক্যের প্রামাণ্য আছে কিনা?
‘আম্নায়স্য ক্রিয়ার্থত্বাৎ আনর্থক্যম্ অতদর্থাণাম্’ (জৈমিণীয় সূত্র ১/২/১)
এই সূত্রে মহর্ষি জৈমিনি বলেছেন, ক্রিয়ার বোধক বেদবাক্যই প্রমাণ। কিন্তু যে বাক্যের কোনও ক্রিয়াতে তাৎপর্য নেই, সে বাক্যের প্রামাণ্য নেই। যেমন- অর্থবাদ বাক্য দ্রব্য ও দেবতার স্বরূপের বোধক, ক্রিয়ার বোধক নয়।
তাই জৈমেণীয় ন্যায় অনুসারে ‘অর্থবাদ ‘ বাক্য প্রমাণ হতে পারে না।
‘চোদনালক্ষণেঅর্থঃ ধর্মঃ ‘ (জৈমেণীয় সূত্র ১/১/২)
-এই বাক্যে জৈমিনি বলেছেন, ‘চোদনা’ অর্থাৎ ক্রিয়ার প্রতিপাদক বেদবাক্যই ধর্মে প্রমাণ।
বেদের বিধিবাক্য ও নিষেধবাক্য উভয়ই ক্রিয়ার প্রতিপাদক । বিধিবাক্য প্রবৃত্তিরূপ ক্রিয়ার প্রতিপাদক আর নিষেধ বাক্য নিবৃত্তি রূপ-ক্রিয়ার প্রতিপাদক। সুতরাং উভয়ই ধর্মে প্রমাণ।
কিন্তু অর্থবাদ বাক্য ক্রিয়ার প্রতিপাদক না হওয়ায় বিধেয় ধর্ম-এ সেটি প্রমাণ হতে পারে না। এখানে বিবক্ষিত এই -গ্রাম,পশু, পুত্র, স্বর্গ প্রভৃতি দুঃখাধিক-সুখসাধন বেদবিহিত যাগাদি কর্মই ধর্ম। কিন্তু বেদনিন্দিত সুখাধিক দুঃখভাজন কলঞ্জভক্ষণাদি কর্ম অধর্ম। সুখের প্রাপ্তি ও দুঃখের নাশ উভয়েই আমাদের কাম্য। এর জন্য প্রয়োজন যথাক্রমে বিধেয় কর্মে প্রবৃত্তি ও নিষিদ্ধ কর্ম থেকে নিবৃত্তি। এখানে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিরূপ ক্রিয়াসাধ্য ধর্ম বেদের বিধি ও নিষেধ বাক্যের মুখ প্রতিপাদ্য, অর্থবাদ বাক্যের প্রতিপাদ্য নয়। সুতরাং বেদান্তর্গত বিধিভাগে কর্মানুষ্ঠানজনিত ধর্ম রূপ পুরুষার্থ উপলব্ধ হলেও অর্থবাদভাগে অদৃশ্য পুরুষার্থের উপলব্ধি হয় না। এই কারণে পূর্ব পক্ষীর মতে বেদান্তর্গত অর্থবাদ বাক্যের প্রামাণ্য নেই।
অর্থবাদবাক্যের প্রামাণ্য রক্ষার্থে যদি বলা হয়,
‘ চোদনেতি ক্রিয়ায়াঃ প্রবর্ত্তকং বচনম্।’ (শাবরভাষ্য ১/১/২)
এই বাক্য অনুসারে ক্রিয়ার প্রবর্ত্তকত্বই ধর্মবিষয়ে প্রামাণ্যের বীজ, অর্থবাদ বাক্যেও ক্রিয়ার সেই প্রবর্ত্তকত্ব কল্পিত হোক। এর সমাধানকল্পে বক্তব্য, অর্থবাদবাক্যে ক্রিয়ার প্রবর্ত্তকত্ব স্বীকার করলে মহা অনর্থ হয়।
‘সোঅরোদীৎ তদ্রুদ্রস্য রুদ্রত্বম্'( তৈত্তিরীয় সংহিতা ১/৫/১/১)
‘ প্রজাপতিরাত্মনো বপামুদখিদৎ ‘ (তৈত্তেরীয় সংহিতা ২/১/১/৪)
ইত্যাদি অর্থবাদ বাক্যে প্রত্যয়ের বিধ্যর্থ বা প্রবর্ত্তকত্ব স্বীকার করলে অন্যকেও কাঁদতে হবে। অন্য ব্যাক্তিও নিজের মেদকে উন্মূলিত করবে-এরূপ অর্থ কল্পনীয় হবে। কিন্তু তাড়ন ছাড়া বা ইষ্ট বিয়োগ ছাড়া কেউ কখনো কাঁদতে পারে না। সুতরাং অর্থবাদ বাক্যে ক্রিয়ার প্রবর্ত্তকত্ব কল্পনা করা যায় না। অতএব, অর্থবাদ বাক্যের ধর্মে প্রামাণ্য নেই।
ব্রাহ্মণের অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করে সিদ্ধান্তপক্ষ:-
অর্থবাদ বাক্যের অপ্রামাণ্য বিষয়ে পূর্বপক্ষীর এই সমস্ত সুচিন্তিত মতের বিরুদ্ধে আচার্য্য জৈমিনির বক্তব্য এই, অর্থবাদ বাক্যের স্বাংশে প্রামাণ্য নেই, কিন্তু পরাংশে প্রামাণ্য। বিধিবাক্যের সঙ্গে অর্থবাদ বাক্যের একবাক্যতা স্বীকার করতে হবে। এর ফলে অনুষ্ঠেয় ধর্মরূপ বিষয়ে অর্থবাদ বাক্যের প্রামাণ্য অনস্বীকার্য্য হবে।
এই অভিপ্রায়ে জৈমিনি ঋষি বলেছেন-
” বিধিনা ত্বেকবাক্যত্বাৎ স্তুত্যর্থেন বিধীনাং স্যুঃ’ (জৈ.সূ.১/২/৭)।
অতিদুঃসাধ্য বিধিবোধিত যাগাদি কর্মে পুরুষের প্রবৃত্তি সম্পাদনের জন্য অর্থবাদ বাক্যসমূহের অবতারনা। অর্থবাদ বাক্য বিধিবাক্যে বিহিত অনুষ্ঠানের স্তুতির জন্য এবং স্তুতির দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে বিধেয় যাগাদি কর্মে প্রেক্ষাবান্ ব্যাক্তিগণের প্রবৃত্তির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই কারনে বিধিবাক্যেগুলি অর্থবাদসাপেক্ষ হয়। আবার অর্থবাদ বাক্যগুলিও ক্রিয়ার্থে বিধিবাক্যের অঙ্গীভূত হয়ে ক্রিয়ারূপ এক অর্থেরই প্রতিপাদক হয় এবং ধর্মরূপ পুরুষার্থে পর্য্যবসিত হয়। এভাবে অর্থবাদবাক্যের প্রামাণ্য সিদ্ধ হবে। সূত্রে তু শব্দের দ্বারা অর্থবাদবাক্য সমূহের অপ্রামাণ্য নিরাকৃত হয়েছে।
অতএব,
‘বর্হিষি রজতং ন দেয়ম্ ‘ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ১/৫/১/২)
এরূপ নিষেধ বিধিবাক্যের সঙ্গে
“সোঅরোদীৎ, তদ্রুদ্রস্য রুদ্রত্বম্’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ১/৫/১/১)
এই নিন্দার্থবাদ বাক্যের একবাক্যতা স্বীকার করতে হবে। এখানে রজতদানের অভাবে রোদনের অভাবরূপ গুনই বিবক্ষিত। সেই গুনের দ্বারা রজতগন নিবারনরূপ বিধি স্তুত হয়।
‘ন হি নিন্দা নিন্দ্যং নিন্দিতুং প্রবর্ত্তিতুং প্রবর্ত্ততে, অপিতু বিধেয়ং স্তোতুম্’
– এই ন্যায় অনুসারে নিন্দার্থবাদ বাক্যের নিন্দাতে তাৎপর্য্য নেই, কিন্তু নিষেধ -বিধি বিষয়ের প্রশংসাতে তাৎপর্য্য। ‘গুনবাদস্তু (১/২/১০) এই জৈমিণীয় সূত্রে এটাই বিহিত হয়েছে।
সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য সিদ্ধান্ত :-
আলোচনার নিষ্কর্ষ এই, বেদবিহিত কর্মানুষ্ঠানই ধর্ম। ধর্ম আমাদের অপরিসীম সুখের কারণ। বেদান্তর্গত বিধিভাগে এই ধর্মরূপ পুরুষার্থ উপলব্ধ হয়। কিন্তু বিধেয় অগ্নিহোত্রাদি কর্ম অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। তাই বিধিঘটিত কর্ম প্রশস্ত এরূপ জ্ঞান না হলে পুরুষের কর্মে প্রবৃত্তি হয় না। অর্থবাদ কর্মের সেই প্রশস্ততা প্রকাশ করে। অর্থবাদ বাক্যের দ্বারা কর্মের প্রশস্ততা বিষয়ে জ্ঞান জন্মালে যজমান পুরুষার্থসিদ্ধিহেতু কর্মে সোৎসাহ প্রবৃত্ত হয়।
এভাবে অর্থবাদবাক্য বেদের অনুষ্ঠেয় কর্মে প্রবৃত্তির প্রয়োজক হওয়ায়, বেদের বিধিভাগ অর্থবাদসাপেক্ষ হয়। আবার অর্থবাদ দ্রব্য ও দেবতার স্বরূপ প্রতিপাদন করে, কোনও ক্রিয়াকে প্রতিপাদন করেনা। তাই স্ববাক্যবোধিত বিষয়ে অর্থবাদবাক্যের তাৎপর্য নেই ও স্বাংশে প্রামান্য নেই। সে কারণে বিধি বাক্যের সঙ্গে একবাক্যতা প্রাপ্ত হয়ে অর্থবাদ বাক্য বিধেয় অর্থেরই প্রতিবাদক হয়। এইভাবে অর্থবাদবাক্যেও বিধিসাপেক্ষ হয়।
ফলতঃ বিধি ও অর্থবাদ পরস্পর সাকাঙ্ক্ষ ও পরস্পর পরিপূরক হয়ে নষ্টাশ্বদগ্ধরথন্যায়ে একই অর্থের বোধক হয় এবং ধর্মরূপ পুরুষার্থ সাধনে ব্যপৃত হয়। বলাবাহুল্য, অজ্ঞাতার্থজ্ঞাপকত্ববশতঃ বিধি বাক্যের ন্যায় অর্থবাদ বাক্যেরও প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। মহর্ষি জৈমিনি ন্যায়মালাবিস্তারে বিধি ও অর্থবাদের ধর্মসাধনতারূপ প্রামাণ্যকে অকুণ্ঠ স্বীকার করেছেন-
“বিধ্যর্থবাদৌ সাকাঙ্ক্ষৌ প্রাশাস্ত্যপুরুষার্থয়োঃ
তেনৈকবাক্যতা তস্মাদ্বাদানাং ধর্মমানতা।।”(১/২/৩)
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদের অনুবন্ধ
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে প্রমার উপস্থাপন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন