বাক্যপদীয় অনুসারে ব্যাকরণ পাঠের উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
বাক্যপদীয় – ব্যাকরণ পাঠের উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা
উ:- ভূমিকা:- কোনো শাস্ত্র পাঠ করার পূর্বে সেই শাস্ত্র পাঠের প্রয়োজন প্রতিপাদন অবশ্য কর্তব্য। কারণ ‘প্রয়োজনম্ বিজ্ঞায় ন মন্দোঅপি প্রবর্ত্ততে’- অর্থাৎ প্রয়োজন উপলব্ধি না করে মন্দধী অর্থাৎ মূর্খ ব্যক্তিত কোনো কর্মে প্রবৃত্ত হয় না।
ব্যাকরণ হল ছটি বেদাঙ্গের মধ্যে প্রধান। সকল তপস্যার মধ্যে শ্রেষ্ট তপস্যা। বাক্যপদীয় আচার্য ভর্তৃহরি এ প্রসঙ্গে কারিকাটি হল-
“আসন্নং ব্রহ্মণস্তস্য তপসামুত্তমং তপঃ।
প্রথমং ছন্দসামঙ্গং প্রাহুর্ব্যাকরণং বুধাঃ।।”
ব্যাকরণ পাঠের উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা
আচার্য ভর্তৃহরির মতে ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা গুলি নিম্নরূপ-
ব্যাকরণ পাঠের প্রথম উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা রক্ষা
‘ব্রহ্মণঃ আসন্নম্’- অর্থাৎ পরব্রহ্ম প্রাপ্তির উপকারক যে শব্দব্রহ্ম বা বেদ – তার সঙ্গে ব্যাকরন সাক্ষাৎভাবে সম্বন্ধ। যদিও শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরন, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ -এই ৬টি বেদাঙ্গ বেদার্থবোধের সহায়ক এবং পরম্পরাক্রমে ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়ভূত, তবুও ব্যাকরণের সাহায্যে বেদার্থের পরিজ্ঞান প্রথমে না ঘটলে অন্যান্য অঙ্গের দ্বারা উপকার পাওয়া যাবে না। ব্যাকরণের দ্বারা কেবল লৌকিক শব্দসমূহের নয়, বৈদিক শব্দরাশিরও প্রভৃতির যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব নয়। সুতরাং বেদার্থজ্ঞান, বেদরক্ষণ ও বেদমন্ত্র প্রয়োগের প্রকৃষ্ট উপায়রূপেও ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তা সিদ্ধ হয়ে থাকে।
ব্যাকরণ পাঠের দ্বিতীয় উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা ঊহ
বেদে সমস্ত লিঙ্গে এবং সমস্ত বিভক্তিতে মন্ত্র সমূহ পঠিত হয়নি। যাজ্ঞিকের কর্তব্য সেগুলির যথাযথ পরিবর্তন সাধন করা। এই প্রক্রিয়ার পারিভাষিক নাম হল ঊহ। যিনি ব্যাকরণ জানেন না তিনি সেগুলিকে যথাযথ পরিবর্তন করতে পারবেন না। সুতরাং ব্যাকরন অধ্যয়ণ করা উচিত। এই ঊহজ্ঞের ফল হল ঐহিক সুখসিদ্ধি। নাগেশ ভট্ট বলেছেন -” ঊহজ্ঞস্য হি আর্ত্বিজ্যলাভেন দ্রব্যপ্রাপ্তি দ্বারা ঐহিক সুখসিদ্ধি। নাগেশ ভট্ট বলেছেন -” ঊহজ্ঞস্য হি আর্ত্বিজ্যলাভেন দ্রব্যপ্রাপ্তি দ্বারা ঐহিক সুখসিদ্ধিঃ ফলমিতি।” ব্যাকরণ বেদের ঊহরূপ উপকার করে। কারণ লিঙ্গ বচনের যথাযথ বিপরিণামপূর্বক ঊহ করা হয় ব্যাকরণ শাস্ত্রের সহায়তায়।
ব্যাকরণ পাঠের তৃতীয় উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা আগম
আগমও ব্যাকরণের অন্যতম প্রয়োজন। আগম অর্থাৎ শ্রুতি ব্যাকরণ অধ্যয়ণের প্রবর্তক। এখানে প্রয়োজনসমূহের মধ্যে আগম অন্যতম একথাই বলা হয়েছে।
ব্যাকরণ পাঠের চতুর্থ উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা লঘু
সহজে যাতে হয়, সেই উদ্দেশ্যেও ব্যাকরণ অধ্যয়ণ করা প্রয়োজন।
ভর্তৃহরি এই প্রসঙ্গে বলেছেন-
“অর্থপ্রবৃত্তিতত্তানাং শব্দা এব নিবন্ধনম্।
তত্ত্বাববোধঃ শব্দানাং নাস্তি ব্যাকরণাদৃতে।।” (বাক্যপদীয় ১/১৩)
অর্থের অববোধ বা ব্যবহারের যে সকল নীতি, ব্যাকরণই তাদের একমাত্র নিয়ামক। আবার শব্দসমূহের সাধুত্বের জ্ঞান ব্যাকরণ ব্যতিরেকে হতে পারে না। অতএব, অবিকল সাধু সংস্কার বিশিষ্ট শব্দের স্বরূপজ্ঞান কেবলমাত্র ব্যাকরণের অনুশাসনের দ্বারাই সম্ভব।
ব্যাকরণ পাঠের পঞ্চম উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা অসন্দেহ
শাস্ত্র বাক্যের অর্থবোধে সন্দেহ উপস্থিত হলে ব্যাকরন সেই সন্দেহের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। যেমন- ‘স্থূলপৃষতীমাগ্নিবারুনণীমনডাহীমালভেত’। অর্থ হল অগ্নি ও বরুন দেবতার উদ্দেশ্যে গাভী আলভন বধ করতে হবে। এখানে সংশয় হল- ‘স্থূলপৃষতীম্’- এই বিশেষণের তাৎপর্য নির্ণয়ে। কর্মধারয় সমাস হলে অর্থ হয়-স্থূল এবং বিন্দুমতী গাভী আলভন করা কর্তব্য। আবার বহুব্রীহি সমাস করলে- ‘স্থূলানি পৃষন্তি যস্যাঃ’ – এই বিগ্রহবাক্য দাঁড়ায়। অর্থ হবে সেই গাভী আলভনযোগ্য হবে যার বিন্দুগুলি হবে স্থূল। সুতরাং প্রথম ক্ষেত্রে স্থূলত্ব গাভীর, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্থূলত্ব বিন্দুর বোধ্য। এই স্থূলপৃষতী শব্দে উভয় অর্থই সম্ভব হওয়ায় ব্যাকরণে অনভিজ্ঞ ব্যাক্তি ঐ বাক্যের বক্তব্য নিরূপনে দ্বিধাগ্রস্ত হন। বৈয়াকরণ যিনি, তিনি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। বৈয়াকরণের স্বরের জ্ঞান থাকায় তিনি জানেন কর্মধারয় ও বহুব্রীহিতে স্বরগত বৈষম্য থাকে। তাই তাঁর ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়োগে কোনো অসুবিধা হয় না।
ব্যাকরণ পাঠের ষষ্ঠ উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা দূষ্ট ও অদৃষ্ট প্রয়োজন:-
ব্যাকরন দৃষ্ট এবং অদৃষ্ট উভয়বিধ ফলেরই জনক। কারণরূপে বলা হয়েছে- ‘একঃ শব্দঃ সুপ্রযুক্তঃ সম্যগজ্ঞাতঃ স্বর্গে লোকে চ কামধুগ্ ভবতি’- এই শ্রুতি বাক্যের দ্বারা ব্যাকরণের কাম্য স্বর্গাদিফল জনকতাও বোধিত হয়েছে। সুতরাং ব্যাকরণ উভয়বিদ ফলের জনক বলে সকল তপস্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ তপস্যা বলে নির্দিষ্ট হয়েছে। ‘প্রথমং ছন্দসামঙ্গং প্রাহুর্ব্যাকরণং বুধাঃ ‘- এখানে প্রথম শব্দের অর্থ প্রধান। কেননা ষড়ঙ্গের তালিকায় শিক্ষা এবং কল্প এরপর ব্যাকরণ পঠিত হয়েছে।
সুতরাং প্রাধান্যই ভর্তৃহরির অভিপ্রেত প্রাথম্য-
” ইদমাদ্যং পদস্থানং সিদ্ধিসোপানপর্বণাম্।
ইয়ং সা মোক্ষমাণা-নামজিক্ষা রাজপদ্ধতিঃ।।”
ব্যাকরন যে শুধু সাধুশব্দের ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন করে তাই নয়, পরন্তু সাধুশব্দের অর্থজ্ঞানপূর্বক প্রয়োগের দ্বারা প্রযোক্তার পরমধর্মের অভিব্যক্তি ঘটায় এবং পরিণামে পরব্রহ্মের সঙ্গে সাযুজ্যলাভ হয়। সুতরাং ভর্তৃহরি প্রমুখ আচার্যগণের মতে শব্দানুশাসন বা ব্যাকরণ অধ্যাত্মশাস্ত্রও বটে।
কোশ – কাব্য – শাস্ত্র- ইতিহাস -পুরাণাদি সমস্ত বিদ্যা বা ব্রাহ্ময়ের প্রতীতির মূল হল ব্যাকরণবিদ্যা, তা ভর্তৃহরিকারিকায় পরিস্ফুট-
” তদ্ দ্বারমপর্গস্য বাঙ্মলানাং চিকিৎসিতম্।
পবিত্রং সর্ববিদ্যানামধিবিদ্যং প্রকাশতে।।” -(বাক্যপদীয় ১/১৪)
ব্যাকরণ পাঠের উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তার মূল্যায়ণ
আসল কথা হল, ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তি ব্যতিরেকে কোনও বাক্যেরই অর্থপ্রতীতি সম্ভব নয়। সকল বিদ্যাই যেহেতু বাক্যসন্দর্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং ব্যাকরণই সকল বিদ্যার ভিত্তিভূমি। এই ব্যাকরণের দ্বারা যে শুধু সাধুশব্দের জ্ঞান হয়, তা নয়, এটা মুক্তির উপায়। সিদ্ধি বা মোক্ষই পুরুষের একমাত্র কাম্য। এই সিদ্ধিলাভ করতে হলে অধস্তন যে সকল ভূমি বা স্তরভেদ বা স্তরভেদ আছে, তাদেরকে অতিক্রম করতে হবে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম পর্ব বা সোপান হল সাধুশব্দের জ্ঞান ও প্রয়োগের সিদ্ধি। এই প্রয়োগসিদ্ধি ব্যাকরণের দ্বারাই সাধিত হতে পারে, অন্য কোনো শাস্ত্রের দ্বারা তা সম্ভব নয়। অর্থাৎ ব্যাকরণ সিদ্ধিলাভের পথে প্রথম সোপান- এতে প্রতিষ্ঠা লাভ না করলে পরবর্তী সোপানসমূহে আরোহণ সম্ভব নয়। সুতরাং বলা যায়, বেদপাঠ থেকে শুরু করে মোক্ষলাভ বা ব্রহ্মজ্ঞান – এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যাকরণের প্রয়োজন। ভর্তৃহরি ব্যাকরণের এইরূপ মাহাত্ম্য অনুভব করেছেন। ভর্তৃহরি ব্যাকরণের এইরূপ মাহাত্ম্য অনুভব করেছেন বলেই দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন-
“তদ্ ব্যাকরণমাগম্য পরং ব্রহ্মাধি গম্যতে।।” (বাক্যপদীয় ১/২২)