অর্থশাস্ত্র হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তরগুলি নিম্নে দেওয়া হল।
অর্থশাস্ত্র হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
১) অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু কী? অথবা, কৌটিল্যকৃত অর্থশাস্ত্র কী জাতীয় গ্রন্থ?
উ:- অর্থশাস্ত্র মূলত রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ। এটি একাধারে রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্কলন ও ভাষ্যগ্রন্থ। প্রজাদের যোগক্ষেত্রে নির্ভর রাজ্যশাসন পদ্ধতির সবিস্তার বর্ণনা এবং মানুষের জীবিকা ও স্থিতি বা অর্থ বিষয়ক আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে।
২) অর্থশাস্ত্র বলিতে কী বোঝ?
উ:- অর্থশাস্ত্র প্রধানত রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ হলেও একে অর্থশাস্ত্র বলা হয়। কারন সম্পদ উৎপাদনকারী মনুষ্যগণের আধার যে পৃথিবীর অধিগ্রহণ ও রক্ষণ বিষয়ক শাস্ত্রই অর্থশাস্ত্র। অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা নির্ণয় প্রসঙ্গে কৌটিল্যের মত হলো-
“মনুষ্যাণাং বৃত্তিরর্থঃ, মনুষ্যবতী ভূমিরিত্যর্থঃ।
কস্যাঃ পৃথিব্যা লাভ পালনোপায়ঃ শাস্ত্রমর্থশাস্ত্রমিতি।।”
৩) অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কে? এটি কি শ্রেনীর রচনা? এর রচনাকাল উল্লেখ কর?
উ:- মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কূটনীতিবিদ্ প্রধানমন্ত্রী মহামতি কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের রচয়িতা।
মহামতি কৌটিল্য খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে (৩২১ এবং ২৯৬ খৃঃ পূর্বাব্দে ) অর্থশাস্ত্র রচনা করেন। এ বিষয়ে মতভেদও আছে।
৪) অর্থশাস্ত্রের বিভাগগুলি কী কী?
উ:- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মোট ১৫টি অধিকরণে বিভক্ত। অধিকরণগুলো মোট ১৮০ টি প্রকরণে ও ১৫০ অধ্যায়ে বিভক্ত।
৫) কৌণ পদন্ত কে? মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে তার মত কী?
উ:- কৌটিলকৃত অর্থশাস্ত্রম গ্রন্থে কৌণপদন্ত হলেন আচার্য ভীষ্ম।
কৌণ পদন্ত অর্থাৎ ভীষ্মের মতে রাজা পিতৃ পিতামহক্রমে আগত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে অমাত্য নির্বাচন করবেন। তাই অর্থশাস্ত্রে বলেছেন-
‘পিতৃপৈতামহানমাত্যান্ কুর্বীত্, দৃষ্টাপদানত্বাত্।’
৬) উপজাপ বলিতে কী বোঝ? রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে উপজাপের মৌক্তিকতা কীরূপ?
উ:- উপজাপ শব্দের অর্থ ভেদসাধন কর্ম।
রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে উপজাপের যৌক্তিকতা হল- কুমন্ত্রনা দ্বারা শত্রুপক্ষীয়দের স্বপক্ষে আনার চেষ্টা।
৭) কৌটিল্যের মতে, অমাত্য নিয়োগের সিদ্ধান্তটি কী?
উ:- অমাত্য নিয়োগের ব্যাপারে তার পূর্বসরী আচার্যদের মত সমর্থন করেন না। তার মতে রাজা বিশ্বাসাদি অমাত্যগুন বিবেচনা করে দেশ, কাল ও কর্মের স্বরূপ বুঝে সহাধ্যায়ী প্রভৃতি সকল শ্রেনীর ব্যাক্তিদের মধ্য থেকে অমাত্য বা কর্মসচিব নিযুক্ত করবেন। তাই আচার্য কৌটিল্য বলেছেন-
“বিভজ্যামাত্যবিভবং দেশকালৌ চ কর্ম চ।
অমাত্যাঃ সর্ব ত্রবৈতে কার্যাঃ স্যু র্ন তু মন্ত্রিণঃ।।”
৮) দূত কয় প্রকার ও কী কী?
উ:- গুনবৈষম্য অনুসারে দূত তিন প্রকার। যথা-
- i)নিসৃষ্টার্থ দূত।
- ii) পরিমিতার্থ দূত।
- iii) শাসনহার দূত।
৯) অর্থশাস্ত্র কবে কে প্রথম আবিস্কার করেন?
উ:- মহামতি কৌটিল্য কৃত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থখানি ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে ডঃ আর শ্যামশাস্ত্রী মহাশয় আবিষ্কার ও প্রকাশ করেন।
১০) অরিষড়বর্গ কী?
উ:- অরিষড়বর্গ হল কাম,ক্রোধ,লোভ,মান,মদ ও হর্ষ। অর্থাৎ
- i) কাম বলতে পরস্ত্রী বিষয়ক অভিলাষ,
- ii) ক্রোধ বলতে হিংসাজনক চিত্তবিকৃতি,
- iii) লোভ হল পরের দ্রব্য প্রাপ্তির ইচ্ছা,
- iv) অজ্ঞতা বশত নিজেকে সর্বোৎকৃষ্ট মনে করাই মান
- v) গর্ব হল ধন বিদ্যাদির অহংকার এবং
- vi) হর্ষ/ মাৎসর্য হল অভীষ্ট বস্তু ভোগের সুখ বা আনন্দ।
এই ষড়রিপু বর্জনের দ্বারা ইন্দ্রিয়জয় আয়ত্ত্ব করতে হয়। তাই এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
“অরিষড়বর্গত্যাগেন ইন্দ্রিয়জয়ং কুর্বীত।”
১১) কৌটিল্যের মতে ত্রিবর্গ কী?এর মধ্যে কোনটি প্রধান?
উ:- কৌটিল্যের মতে ধর্ম,অর্থ ও কাম এই তিনটিকে একত্রে ত্রিবর্গ বলে। ত্রিবর্গের মধ্যে অর্থই প্রধান।
১২) গূঢ়পুরুষ কাকে বলে? গূঢ়পুরুষ কয় প্রকার ও কী কী?
উ:- গুপ্তচরকে গূঢ় পুরুষ বলে। গূঢ় পুরুষ প্রধানত পাঁচ প্রকার
i)কাপটিক, ii) উদাস্থিত iii) গৃহপতিক iv) বৈদেহক ও v) তাপস ব্যঞ্জন।
এছাড়া সত্রী, তীক্ষ্ণ, রসদ, ভিক্ষুকী প্রভৃতি বহু প্রকার গূঢ় পুরুষ আছে।
১৩ ) কৌটিল্যের মতানুসারে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণদণ্ড ও মৃদুদণ্ডের প্রভাব কীরূপ?
উ:- তীক্ষ্ণদণ্ডো হি ভূতানামুদ্বেজনীয়ঃ – অর্থাৎ তীক্ষ্ণ বা কঠোর দণ্ড প্রয়োগকারী রাজা সকল প্রাণিগণের উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকেন।
“মৃদুদণ্ড পরিভূয়তে– অর্থাৎ রাজা মৃদুদণ্ড প্রণয়নকারী হলে তিনি অন্যের কাছে পরাভব বরণ করেন।
১৪) রাজা অমাত্য বা সচিব নিয়োগ করবেন কেন? অথবা, রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে অমাত্যের ভূমিকা কীরূপ?
উ:- রাজ্য শাসন কার্য সহায়সাধ্য। যেমন-গাড়ি একটি চাকার সাহায্যে চলে না একে চালনা করতে গেলে অন্য একটি চাকারও প্রয়োজন হয় তেমনি রাজারও সহায়তাকারী ছাড়া রাজকার্য চলে না বলে রাজা সচিব দিগকে নিযুক্ত করবেন এবং তাদের মতামত শুনবেন।
১৫) লোকায়ত:-
মহামতি কৌটিল্য লোকায়ত শাস্ত্রকে আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত বলেছেন। সাধারনত আমরা লোকায়ত দর্শন বলতে নাস্তিক, চার্বাক বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনকে বুঝি। কিন্তু কৌটিল্য নাস্তিক দর্শন অর্থে লোকায়ত শব্দ গ্রহণ করেননি। কেননা কৌটিল্য ছিলেন পূর্ণরূপে আস্তিক। সনাতনপন্থী ও বেদ বিশ্বাসী। তাই গণপতি শাস্ত্রীর ব্যাখ্যানুসারে ব্রহ্ম গার্গী প্রোক্ত ন্যায় শাস্ত্রই লোকায়ত শাস্ত্রের তাৎপর্য।
আমরা গৌতমপ্রোক্ত ন্যায় শাস্ত্রের কথা থেকে বুঝেছি যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে অনুমানের দ্বারা বেদ সম্মত তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেছেন ন্যায় শাস্ত্র। কৌটিল্যও চেয়েছেন ধর্মাশ্রিত, বেদ নির্ভর সমাজব্যবস্থায় মানুষের সুখ, ঐশ্বর্য বৃদ্ধিলাভ হোক। তাই লোকায়ত দর্শনের উল্লেখ করে কৌটিল্য যে হেতুবাদী ও প্রত্যক্ষবাদী ছিলেন তা প্রমাণ করেছেন।