সায়ণাচার্য রচিত ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে বেদ সম্ভাবে বা বেদ সৎভাবে প্রমার উপস্থাপন কর।
সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে বেদ সম্ভাবে বা বেদ সৎভাবে প্রমার উপস্থাপন কর।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে সায়ণ অনুযায়ী বেদ শব্দের নির্বচন
আচার্য সায়ণ ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা-য় বেদ শব্দের নির্বচন ও বেদের মুখ্য প্রয়োজন নির্দেশ করে বলেছেন-‘ অলৌকিকং পুরুষার্থোপায়ং বেত্তি অনেন ইতি বেদশব্দনির্বচনম্। ‘ অতএব বেদের মুখ্য প্রয়োজন ইষ্টপ্রাপ্তি ও অনিষ্ট পরিহাররূপ পুরুষার্থ এবং তার লোকোত্তর উপায়কে জানিয়ে দেয় বলে বেদের বেদত্ব নিশ্চিত হয়। এই হল বেদ শব্দের নির্বাচন। সায়ণাচার্য বলেছেন-
” প্রত্যক্ষেণাণিনুমিত্যা বা যস্তূপায়ো ন বুধ্যতে।
এনং বিদন্তি বেদেন তস্মাদ্ বেদস্য বেদতা।।”
তাৎপর্যার্থ এই যে, ধর্ম ও ব্রহ্ম এই দুটি আলৌকিক তত্ত্ব কল্পারম্ভে ঈশ্বরের অনুগ্রহে ঋষিগণের অলৌকিক দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়েছিল। একমাত্র পরম হিতকারিণী শ্রুতিই এই দুটি তত্ত্বের স্বরূপ ও প্রাপ্তির উপায় সম্যকরূপে নির্ধারণ করেছেন। তাই পুরুষার্থানুশাসনে সূচিত হয়েছে- ” ধর্মব্রহ্মণী বেদৈকবেদ্যে।’
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ ও প্রমাণ বিষয়ে পূর্বপক্ষ:-
বেদের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রবল বিরোধিতা করে নাস্তিকগণ বলেন, বেদের লক্ষণ ও বেদবিষয়ে প্রমাণ কোনটাই সম্ভবপর নয়। অথচ লক্ষণ ও প্রমাণ ছাড়া কোনও বস্তুর অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় না।
ন্যায়বিদরা এইজন্য বলেন-
“লক্ষণপ্রমাণাভ্যাং হি বস্তুসিদ্ধিঃ।”
অধিকাংশ মীমাংসকাগণ বলেন, “মানাধীনা মেয়সিদ্ধির্মানসিদ্ধিশ্চ লক্ষণাৎ।” প্রমেয়ের সিদ্ধি প্রমাণাধীন এবং প্রমাণের সিদ্ধি লক্ষণাধীন। অর্থাৎ লক্ষণ ছাড়া প্রমেয় বস্তুকে প্রমাণের প্রবৃত্তি হয়না। আবার প্রমাণ ব্যতিরেকে প্রমেয়ের অস্তিত্ব সিদ্ধি হয় না।
যদি বলা হয় যে, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম -এই তিনটি প্রমাণের মধ্যে অন্তিম প্রমাণ আগমই বেদের লক্ষণ। এই উত্তরকল্পে পূর্বপক্ষিগণ বলেন, শব্দনিষ্ঠ শক্তিবলে সম্যকরূপে
আপ্তব্যক্তির পরোক্ষ অনুভবের সাধন আগমই বেদ- এই লক্ষণটি লক্ষ্য। বেদকে অতিক্রম করে মনু প্রভৃতি আপ্তপুরুষ কর্তৃক প্রণীত স্মৃতিশাস্ত্রেও সংক্রামিত হওয়ায় এখানে অতিপ্রাপ্তি দোষ হবে। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্য যদি বলা হয়, অপৌরষেয় পরোক্ষ অনুভবের সাধন আগমই বেদের লক্ষণ, তবে মণ্বাদি প্রণীত স্মৃতিশাস্ত্রে লক্ষণের অভিব্যক্তি না হলেও লক্ষণটি অসম্ভবদোষ দুষ্ট হবে। কেননা, বেদ পরমেশ্বর কর্তৃক রচিত হওয়ায় পৌরুষেয়।
যদি বলা হয়, পরমেশ্বর তো শরীরধারী পুরুষ নন, তাঁর উত্তর –
‘সহস্রশীর্ষাঃ পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ”-(ঋগ্বেদ-১০/৯০/১)
ইত্যাদি মন্ত্রে পরমেশ্বরও শরীরধারী পুরুষরূপে কীর্ত্তিত হয়েছেন। যদি বলা হয়, শরীর ধারন করে যাঁরা কর্মফল ভোগ করেন তাঁরাই পুরুষ। কিন্তু ঈশ্বর কর্মফল হেতু শরীর ধারন করেন না। তিনি তাই প্রকৃত পুরুষ নন। সুতরাং পরমেশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হলেও বেদ অপৌরুষেয়।
এই উত্তরপক্ষে বক্তব্য,
“ঋগ্বেদ এবাগ্নেরজায়ত, যজুর্বেদো বায়োঃ, সামবেদ আদিত্যাৎ” (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫/৫/৭)
ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যে জীবভাবাপন্ন কর্মাধীন শরীরধারী অগ্নি, বায়ু, সূর্য প্রভৃতি দেবতারূপ পুরুষ হতে বেদ উৎপন্ন হওয়ায় বেদ পৌরষেয়। এই কারনে অপৌরুষেয় আগমই বেদ এরূপ বেদের লক্ষণ সংগত হতে পারেনা।
যদি বলা হয়, মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ উভয়ে সমবেত শব্দরাশিই বেদের লক্ষণ, সেটাও নির্দুষ্ট হতে পারে না। ‘মন্ত্র এইরূপ, ব্রাহ্মণ এইরূপ ‘- এইরূপে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের কোনও নির্দিষ্ট লক্ষণ স্পষ্ট করে আজও যাজ্ঞিকগণ নির্ধারণ করতে পারেননি। তাঁরা মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের যে সব লক্ষণ করেছেন, কোনোটাই সমীচীন নয়। সুতরাং বেদের কোনও নির্দুষ্ট লক্ষণ অদ্যাপি নিরুপিত না হওয়ায় বেদের অস্তিত্ব বিষয়ে কোনও প্রমাণ চরিতার্থ হতে পারেনা।
এতৎ সত্ত্বেও বলা হয়,
‘ ঋগ্বেদো ভগবোঅধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমার্থবর্ণং চতুর্থম্।’ (ছান্দোগ্যোপনিষৎ- ৭/১/২)
ইত্যাদি বেদবাক্যই বেদের অস্তিত্ব প্রামাণ্য, কিন্তু সেটা হাস্যকরই হবে। কেননা, ‘ঋগ্বেদং ভগবোঅধ্যেমি’- ইত্যাদি বাক্য বেদেরই অন্তর্ভুক্ত, সেটি বেদের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রমাণ হলে ‘আত্মাশ্রয়’ দোষ প্রসক্ত হবে। কোনও ব্যাক্তি স্কন্দারোহণ কার্যে অত্যন্ত নিপুণ হলেও নিজের স্কন্দে কখনো নিজে আরোহন করতে পারেনা, তেমন নিজের অস্তিত্ব সাধন করতে বেদ নিজেই প্রমাণ হতে পারে না।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ ও প্রমাণ বিষয়ে উত্তরপক্ষ:-
বিসংবাদী নাস্তিকগণের উক্ত সুচিন্তিত আক্ষেপসমূহ খন্ডনকল্পে সিদ্ধান্তী পণ্ডিতপ্রবর সায়ণাচার্য মীমাংসকাচার্য্য মহর্ষি জৈমিনির মতানুসারে বেদের লক্ষণ ও প্রমাণকে যথাযথভাবে নিরূপণ করে বেদের অস্তিত্বকে প্রতিপাদন করেছেন। তাঁর মতে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণাত্মক শব্দরাশিই বেদের নির্দুষ্ট লক্ষণ।
এ সম্পর্কে জৈমিনি বলেছেন-
” তচ্চোদকেষু মন্ত্রাখ্যাঃ শেষে ব্রাহ্মণশব্দঃ।”(জৈ.সূ ২/১/৩২,৩৩)।
তৎ শব্দের অর্থ অভিধান (অনুষ্ঠেয় পদার্থের স্মরণরূপ প্রকাশ) তার ‘চোদক’ অর্থাৎ প্রয়োজক যে বাক্যসমূহ সেই বাক্যগুলিকে বলে মন্ত্র। অর্থাৎ যেটা বিধেয় পদার্থের স্মরণের হেতু, সেটাই মন্ত্র।
আর মন্ত্রাতিরিক্ত বেদভাগের নাম ব্রাহ্মণ। বিশাল ব্রাহ্মণ সাহিত্যের অন্তর্গত বিধি ও অর্থবাদের লক্ষণও দুর্নিরূপ নয়। অপ্রবৃত্ত-প্রবর্ত্তকত্ব বিধির লক্ষণ এবং বিশেষত্ব অর্থবাদের লক্ষণ। সুতরাং মন্ত্র ও ব্রাহ্মণাত্মকত্বই বেদের নির্দুষ্ট লক্ষণ। ঋষি আপস্তম্ব বলেছেন-
‘ মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্’।(যজ্ঞপরিভাষা ৩১)।
যদি বলেন মন্ত্রাতিরিক্ত বলে ব্রাহ্মণের বেদত্ব নেই। একথাও সিদ্ধ নয়। ‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্ত্তা দন্ডনীতিশ্চ শাশ্বতী’ ইত্যাদি (ন্যায়মঞ্জরী ধৃত) বাক্যে ত্রয়ী শব্দে কেবলমাত্র ঋক্,যজুঃ ও সামরূপ মন্ত্র সমূহের বেদত্ব স্বীকৃত হয়েছে।
যদি কেবল মন্ত্র সমূহেরই বেদত্ব সিদ্ধ হয়, তবে
‘ঋগ্বেদং ভগবোঅধ্যেমি, যজুর্বেদং সামবেদম্ আর্থবণং চতুর্থম্’-
এ বাক্যে চতুর্থ বেদরূপে অথর্ববেদের উল্লেখ ব্যর্থ হবে। কেননা অথর্ববেদের বাক্য গুলিকে যাজ্ঞিকগণ মন্ত্র বলে স্বীকার করেন না। এর দ্বারা এটাই জ্ঞাপিত হয় যে, মন্ত্রাতিরিক্ত হলেও অথর্ববেদের ন্যায় ব্রাহ্মণভাগেরও বেদত্ব সিদ্ধ হবে।
অনাদিকাল থেকেই সমগ্র বেদ গুরু শিষ্য পরম্পরায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রাপ্ত হলেও যেহেতু সম্প্রদায় থেকে বেদের কোনও স্বতন্ত্র কর্ত্তৃপুরুষের নাম পাওয়া যায় না, সেহেতু বেদ অপৌরুষেয়।
সিদ্ধান্ত:-
বেদের সম্ভাবে কোনো প্রমাণ নেই, নাস্তিকদের একথাও প্রমাদোক্তি ভিন্ন কিছু নয়। লৌকিক বাক্যে পুরুষগত ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণবৈকল্য প্রভৃতি দোষের সম্ভাবনা থাকায় অপ্রামাণ্য শঙ্কা হতে পারে। কিন্তু বেদবাক্য অপৌরুষেয় বলে তাতে পুরুষের উক্ত কোনও দোষের সম্ভাবনা না থাকায় অপ্রামাণ্য শঙ্কা হতে পারে না। আর বেদবাক্য যেহেতু অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞাপক, প্রত্যক্ষাদি লৌকিক প্রমাণাগম্য অনধিগত তত্ত্বের বোধক, সেহেতু নিজের প্রামাণ্য সিদ্ধির জন্য অন্য প্রমাণের সমর্থনকে অপেক্ষা করে না।
তাই বেদের স্বতঃসিদ্ধ প্রামাণ্য বিদগ্ধ দর্শনবিৎ সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্র বাচস্পতিমিশ্র বলেছেন-
“তস্যাপৌরুষেয়তয়া নিরস্তসমস্তদোষাশঙ্কস্য বোধকতয়া চ।
স্বতঃসিদ্ধপ্রমাণভাবস্য স্বকার্যে প্রমিতাবনপেক্ষত্বাৎ।।”
অভিপ্রায় এই ব্যবহারিক জগতে পদার্থসমূহের মধ্যে পরস্পর সামর্থ্যভেদ দেখা যায়। যেমন ঘটাদি জড় পদার্থগুলো স্বয়ং ঘটাদি বিষয়ের প্রকাশক হতে পারে না। কিন্তু প্রদীপ ঘটাদি বস্তুর প্রকাশক হয়, আবার নিজেরও প্রকাশক নিজেই হয়। সেই রূপ পরলোক, ধর্ম, ঈশ্বর প্রভৃতি অলৌকিক তত্ত্ববিষয়ে অকুণ্ঠিত শক্তি বেদই প্রমাণ আবার নিজের অস্তিত্ব প্রতিপাদন বেদ নিজেই প্রমাণ। ‘স্বস্কন্ধারোহণ ‘ ন্যায়ে ‘আত্মাশ্রয়’ দোষ অন্য বিষয়ে প্রযোজ্য হলেও স্বপ্রকাশ বেদ বিষয়ে প্রযোজ্য হতে পারে না।
ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা হতে পড়ুন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদ পৌরষেয় না অপৌরুষেয়
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: বেদের অনুবন্ধ
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণের পদ্ধতিতে অর্থবাদভাগের প্রামাণ্য
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: মন্ত্রের লক্ষণ নিরুপণ করে মন্ত্রভাগের প্রামান্য নিরুপন কর
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণ অনুযায়ী বেদের লক্ষণ নিরূপণ করে প্রমার উপস্থাপন
- ঋগ্বেদভাষ্যোপক্রমণিকা: সায়ণাচার্য কেন প্রথমে যজুর্বেদের ব্যাখ্যা করেছেন