নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল । নাট্যশাস্ত্র প্রণেতা হলেন ভরত মুনি। ভরত মুনি রচিত নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা ও বিষয়বস্তু তুলে ধরা হল।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যশাস্ত্র ও সাহিত্য সমালোচনা মূলক বিদ্যা সাধারণভাবে অলংকার শাস্ত্র নামে পরিচিত। কাব্য মীমাংসা, সাহিত্য-বিদ্যা প্রভৃতি শব্দের দ্বারাও সংস্কৃতে অলংকার শাস্ত্রকে বোঝানো হয়। ভারতবর্ষের অলংকার শাস্ত্রের ইতিহাস সুপ্রাচীন। আচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র ও সংস্কৃতে অলংকার শাস্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রামান্য রচনা।
নাট্যশাস্ত্রকার ভরতমুনির কাল নির্ণয় অতি দুরহ ব্যাপার। কালিদাস তার বিক্রমোর্বশীয়ম্ নাটকে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক kena-এর মতে ৩০০খ্রিস্টাব্দে নাট্য সাহিত্যের বর্তমান রূপটির আবির্ভাব। আবার অনেক পণ্ডিত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যের কোনো এক সময়কে ভরতের আবির্ভাব কাল বলে মনে করেন।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রকারিকা, ভাষ্য ও অনুবংশ শ্লোক- এই তিনটি অংশে বিভক্ত। বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থের অষ্টম থেকে দ্বাদশ অধ্যায়ে বিস্তৃত পরিসরে অভিনয়ের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। অভিনয় শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে ভরত বলেছেন-
“অভিপূর্বস্য নীঞ্চধাতুরাভিমুখ্যার্থ নির্নয়ে।
যস্মাৎ পদার্থন্নয়তি তস্মাদভিনয়ং স্মৃতঃ।।”
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র অধ্যায়গুলির বিষয়বস্তু
ভরত প্রণীত নাট্যশাস্ত্র সংস্কৃত সাহিত্যে অনন্য। এই নাট্যসাহিত্যটি ৩৬ টি অধ্যায় এবং ৬০ হাজার শ্লোকে রচিত হয়। অধ্যায়গুলির বিষয়বস্তু নিম্নে আলোচনা করা হল-
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র প্রথম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এই অধ্যায়ে নাট্যবেদের উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে এবং এই গ্রন্থকার জন্য রচিত হয়েছে, এর অঙ্গগুলি কি কি? মঞ্চে নাটক কিভাবে উপস্থাপিত হয় প্রভৃতি বিষয়গুলি ভরত তার নাট্যশাস্ত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। ভরত ঋগ্বেদ হতে পাঠ্যাংশ, সামবেদ হতে সঙ্গীত, যজুর্বেদ হতে অভিনয় এবং অথর্ববেদ হতে রস গ্রহণ করে এই পঞ্চম বেদ রচনা করেন।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এতে নাট্য মণ্ডপ ও প্রেক্ষাগৃহ রচনার রীতি বর্ণিত হয়েছে। ভরতের মতে প্রেক্ষাগৃহের আকৃতি হবে পর্বতের গুহার মতো। দর্শকের আসন হবে ইট বা কাঠ দিয়ে তৈরি এবং দেওয়ালে ছবি আঁকা থাকবে।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে রঙ্গমঞ্চে মহাদেব, ব্রহ্মা-বিষ্ণু বৃহস্পতি ও গুহক এই দেবতাগণের পূজা করা হয় এবং নাট্যানুষ্ঠানের জন্য তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র চতুর্থ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এই অধ্যায়ে দুটি নাটক অভিনয়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ‘অমৃতমন্থন’ নাটকটি দেবগনের সম্মুখে এবং ‘ত্রিপুরদাহ’ নাটকটি মহাদেবের সম্মুখে অভিনীত হয়।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র পঞ্চম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এতে পূর্বরঙ্গ, নান্দী ও প্রস্তাবনা বিষয়ক আলোচনা রয়েছে।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র ষষ্ঠ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এই অধ্যায়ের প্রথমে রস কাকে বলে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ভরত বলেছেন- ‘রসস্যতে আস্বাদ্যতে ইতি রসঃ।’ তারপর রসভাব, অভিনয়,ধর্মীয় বৃত্তি, প্রবৃত্তি সিদ্ধি, স্বর, গান ও রঙ্গ বিষয়ে লক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ভরত আটপ্রকার রসের কথা স্বীকার করেছেন। এই রস অভিব্যক্তি কি করে হয় একথা বলতে গিয়ে ভরত বলেছেন-
“বিভানুভাব্যাভিচারি সংযোগাদ্ রসনিষ্পত্তিঃ প্রবর্ততে।”
ভরত আটপ্রকার রসের কথা বললেও কোনো কোনো সংস্করণে নবম রসরূপে, শান্ত রসের উল্লেখ দেখা যায়। কবি চিত্তের রসানুভূতি থেকে কাব্যের উদ্ভব, সামাজিক চিত্তের রসানুভূতি থেকে কাব্যের উদ্ভব, সামাজিক চিত্তের রসানুভূতিতে কাব্যের পর্যাবসান। বীজ থেকে বৃক্ষ, বৃক্ষ থেকে পুষ্প, পুষ্প থেকে ফল হয়। অর্থাৎ বীজ হচ্ছে সবকিছুর মূল। অনুরূপভাবে দৃশ্যকাব্যের ও শ্রব্যকাব্যের ক্ষেত্রে রসই মূল ভূততত্ত্ব। তাই ভরত বলেছেন-
” যথা বীজাব্দ ভবেদ্ বৃক্ষো বৃক্ষাৎ পুষ্পং ফলং তথা।
তথা মূলং রসাঃ সর্বে তেভ্যো ভাবা ব্যবস্থিতাঃ।”
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র সপ্তম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এই অধ্যায় ভাব, বিভাব, স্থায়ী ভাব, ব্যভিচারীভাব ও সেই সঙ্গে আটপ্রকার স্থায়ীভাব বর্ণিত হয়েছে।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র অষ্টম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এই অধ্যায় চার প্রকার অভিনয় সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে-
“আঙ্গিকো রাচিকশ্চৈব আহার্যঃ সাত্ত্বিকস্তথা
জ্ঞেয়স্তাভিনয়ো বিপ্রাশ্চতুর্ধা পরিকল্পিঃ।।”
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র নবম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এতে রসভাবাদি অনুসারে হস্ত পদ প্রভৃতির বহুপ্রকার বিক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র দশম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এতে অঙ্গসমূহের বিবিধ নিক্ষেপ ও তাদের নামকরণ বর্ণিত হয়েছে।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র একাদশ অধ্যায় থেকে ষোড়শ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এতে ১৬ প্রকার চাবী বা বিভিন্ন পাদ সংক্রমণ লক্ষণ সহযোগে বর্ণিত হয়েছে, এতে মন্ডপের লক্ষণ ও সংখ্যা বলা হয়েছে, এতে অভিনেতাদের যথাযথ চলন বর্ণিত হয়েছে, এতে নাট্য মণ্ডপের স্থান বিভাজন রয়েছে। এতে স্বনির্ভর বাচিক অভিনয় রয়েছে। এতে নাট্যে ব্যবহৃত বৃত্ত বা চন্দ্রসমূহ আলোচিত হয়েছে।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র সপ্তদশ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
নাট্যশাস্ত্রের সপ্তদশ অধ্যায়ে ভরতমুনি চারটি অলংকার, দশটি গুন, ১০ টি দোষ ও ৩৬ টি লক্ষণ বর্ণনা করেছেন।
নাট্যাচার্য ভরতের নাট্যশাস্ত্র অষ্টাদশ অধ্যায় থেকে ষড়ত্রিংশ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু
এতে প্রাকৃত অংশের পাঠ, চরিত্রদের আহ্বানের নিয়মসমূহ দশপ্রকার রূপকের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এতে দ্বিবিধ নাট্যবস্তু, পাঁচ প্রকার অর্থ প্রকৃতি, পাঁচ প্রকার সন্ধি, পাঁচ প্রকার অর্থোপক্ষেপক বর্ণিত হয়েছে। চারটি বেদ থেকে চারটি বৃত্তির উৎপত্তি প্রদর্শিত হয়েছে, আহার্যাভিনয় ও নেপথ্য বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। দশটি অঙ্গজ অলংকার বর্ণিত হয়েছে, বৈশিক এর ৩৬ প্রকার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। আঙ্গিক অভিনয় বর্ণিত হয়েছে, সিদ্ধির কথা আলোচিত হয়েছে? বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। রসভেদ জাতি ও স্বরের ভেদ রয়েছে। বাঁশির প্রকারভেদ রয়েছে। তাল, লয় প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের বর্ণনা রয়েছে। তিন প্রকার প্রকৃতি, নানা প্রকার নারীর লক্ষণ রয়েছে, নাট্যদলের সদস্যদের কর্মবিভাগ আলোচিত হয়েছে। মুনিগণের প্রশ্নে পূর্বরঙ্গে কোন দেবতার পূজা শ্রেষ্ঠ, সর্গ থেকে মর্ত্যে নাট্যের অবতরণ কি প্রকার ইত্যাদির উত্তর দেওয়া হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভরত তার গ্রন্থে রসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সামাজিক দিক থেকে এই নাট্য শাস্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে।
ভরত মুনি নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থের রচয়িতা।
ভরতের নাট্যশাস্ত্র বিচারে রস ৮ প্রকার। এগুলো হলো—শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত।