সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস হতে নাট্য সাহিত্যে উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ আলোচনা করা হল।
নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ
সংস্কৃত কাব্যের প্রকারভেদ
সংস্কৃত কাব্য প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্য।
দৃশ্য কাব্য কাকে বলে ?
দৃশ্যকাব্য দৃষ্টিগ্রাহ্য। মঞ্চে অভিনয় দর্শনের মাধ্যমে এই কাব্যের রস আস্বাদিত হয়। কাজেই সাধারণভাবে নাটকই দৃশ্যকাব্য বলে ।
সংস্কৃত দৃশ্যকাব্য বা নাট্যসাহিত্য
অভিনয়ের দ্বারা নাটকীয় পাত্র-পাত্রীর অবস্থার অনুকরণের নাম নাট্য -“অবস্থানুকৃতির্নাট্যম্’। দশ প্রকার রূপক ও অষ্টাদশ উপরূপক মিলে সংস্কৃত দৃশ্যকাব্য বা নাট্যসাহিত্য।
সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে মতবাদ
সংস্কৃত সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। সেগুলি নিম্নে আলোচিত হল-
নাট্য উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন মতবাদ
বেদ থেকে উৎপত্তি মহামুনি ভরত প্রণীত “নাট্যশাস্ত্র ‘নাট্যকলার প্রাচীনতম প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখিত নাট্য উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন মতবাদ। ভরতের মতে, ভগবান ব্রহ্মার ললিতকলা রূপে নাট্য সৃষ্টি করেছেন –
“এবং ভগবতা সৃষ্টো ব্রহ্মণা ললিতাত্মকম্।”
নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে উপাখ্যান
নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে নাট্যশাস্ত্রে একটি উপাখ্যান আছে- শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের বেদপাঠে অধিকার ছিল না। দেবতা ও মহির্ষি সংঘের অনুরোধে লোকপিতামহ ব্রহ্মা ত্রেতাযুগে সর্বসাধারণের মনোরঞ্জনের জন্য সার্ববণিক পঞ্চম বেদরূপে নাট্যবেদ সৃষ্টি করেন। নাট্যশাস্ত্রের বিবরণ অনুসারে ব্রহ্মা ঋগ্বেদ থেকে পাঠ্যাংশ,সামবেদ থেকে সংগীত, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় এবং অথর্ববেদ রস আহরণ করে নাট্য রচনা করেন। তাই বলা হয়েছে –
জগ্রাহ পাঠ্যমৃগ্বেদাৎ সামভ্যো গীতমেব চ।
যজুর্বেদাদভিনয়ান্ রসানাথর্বণাদপি।।’
ঋগবেদের সংবাদ সূক্ত থেকে উৎপত্তি
অনেকের মতে, ঋগবেদের সংবাদ সূক্ত থেকে নাট্য সাহিত্যেের উৎপত্তি । ঋগ্বেদে প্রায় কুড়িটি সূক্ত আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- লোপামুদ্রা, পুরুরবা – উর্বশী সূক্ত প্রভৃতি। এই সূক্তগুলি কথোপকথনের আকারে রচিত।
প্রখ্যাত জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলার এবং ফরাসি পন্ডিত সিলভ্যাঁ লেডির মতে ঋগ্বেদের এই সূক্তগুলি নাটকের লক্ষণাক্রান্ত। এই জাতীয় কথোপকথনাত্মক রচনা মহাভারত, পুরাণ এবং বৌদ্ধ সাহিত্যও পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের এই সূক্তগুলি কোনো না কোনো শ্রৌত অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিল।
ঋগ্বেদের সংবাদসূক্তগুলিকে বিভিন্ন শ্রৌতানুষ্ঠানে বিনিযুক্ত করতে গিয়েই যজ্ঞশাস্ত্রকারগন এগুলির নাটকীয় মূল্য বুঝতে পারেননি। বৈদিক সমাজব্যবস্থায় সংবাদসূক্ত গুলির যথার্থ মূল্যায়ন ঘটলে এই সূক্তগুলির মধ্যে পরিপূর্ণ নাটক দেখতে পাওয়া যেত। অধ্যাপক হার্টেল এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সুপর্ণাধ্যায় নামক একটি বৈদিক গ্রন্থকে পুরোপুরি নাটকের মর্যাদা দিয়েছেন।
বৈদিক কর্মবাদ থেকে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি
আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে বৈদিক কর্মকাণ্ডে।বৈদিক কর্মকাণ্ডে এমন কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে যেগুলোর মধ্যে নাটকীয় আচরণ স্পষ্ট। সোমযাগে সোমক্রেতা ও বিক্রেতার ভূমিকায় দুজনকে অভিনয় করতে হত। বিক্রেতার কাছ থেকে সোম ক্রয় করে তার মূল্য না দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতার হাতে প্রহৃত হত। এই আচরন সোমযাগের অঙ্গ। মহাব্রত নামক অনুষ্ঠানে এক খন্ড চর্মকে কেন্দ্র করে শ্বেতকায় বৈশ্য ও কৃষ্ণকায় শূদ্রের মধ্যে বিবাদের ঘটনাও চরম নাটকীয়তায় পূর্ণ। অধ্যাপক Keith এর মতে,এখানে শূদ্র হল অন্ধকারের প্রতীক,বৈশ্য আর্যদের আলোর দেবতা সূর্যের প্রতীক। শূদ্রকে পরাস্ত করে বৈশ্যের দ্বারা চর্মখন্ড লাভ -এই রূপকের অন্তরালে অন্ধকারকে দূর করে সূর্যালোকের জয় কীর্তিত হয়েছে।
পুতুল নাচ থেকে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি
অধ্যাপক পিশেলের মতে, পুতুল নাচ থেকেই নাটকের উৎপত্তি। পুতুলনাচে যিনি সূত্র দ্বারা পুতুলকে নাচান, তাকে বলা হয় সূত্রধার, যিনি পুতুলকে স্থাপন করেন তাকে বলা হয় স্থাপক। কিন্তু সংস্কৃত নাটকে যিনি কথাবস্তু,নায়ক, রস প্রভৃতির সূত্রপ্রেক্ষক সাধারণের কাছে উপস্থাপিত করেন, তাকে বলা হয় সূত্রধার। পুতুলের সূত্র ধারণ করার জন্যই সূত্রধার শব্দের পিশেল কল্পিত ব্যুৎপত্তি তাই অসঙ্গত। তাই সামান্য পুতুল নাচ থেকে রস ভাবসঞ্চারী নাটকের উৎপত্তির মতবাদকে মেনে নেওয়া যায় না।
হৃদয়ের ভাব থেকে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তিঃ-
ডক্টর রিজওয়ে বলেন যে, মানুষের মৃত্যুর পরে ঐ প্রয়াত মানুষটির জন্য তার আত্মীয় পরিজনেরা কান্নাকাটি করে হৃদয়ের শোক প্রকাশ করত।
শোকসন্তপ্ত ব্যক্তিদের হৃদয়ের ভাবপ্রকাশের রীতিনীতিকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফলে দৃশ্যকাব্যের উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু এই মতের ঐতিহাসিক কোনো সত্যতা নেই।
মানবিক প্রবৃত্তি থেকে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি
হিল্লিব্রান্ডৎ এর মতে, সংস্কৃত নাটকের প্রকৃত মূল নিহিত আছে মানবিক প্রবৃত্তির মধ্যে এবং মানুষের জীবনযাত্রার বাস্তবতার মধ্যে। রসবোধ ও আনন্দ অনুভূতি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি থেকে রামলীলা, কৃষ্ণলীলা প্রভৃতির আবির্ভাব। হিল্লিব্রান্ডৎ এবং কনো উভয়েই প্রথম প্রকাশ করেন যে ধর্ম বা ধর্মানুষ্ঠানের সাথে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তির ইতিহাস জড়িত এরূপ ধারণা ভুল। এর প্রকৃত উৎস নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা বাস্তব দিকে।
গ্রিক প্রভাব থেকে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তিঃ-
ওয়েবার সর্বপ্রথম ভারতীয় নাট্য সাহিত্যের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন।তার মতে গ্রীকের সংস্পর্শে আসার পর থেকে ভারতবর্ষের নাট্যসাহিত্য পরিণতি লাভ করে।
পাঞ্জাব, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলের রাজন্যবর্গের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে গ্রিক সৈন্য ছিল এবং তাদের রাজসভায় গ্রিক নাটকের অভিনয়ও হত। এভাবে ভারতীয় নাট্য সাহিত্যে ধীরে ধীরে গ্রিক প্রভাব সংক্রমিত হয়।
নাট্য সাহিত্যের মূল্যায়ন
বস্তুতঃ ভারতীয় নাট্য সাহিত্যের উদ্ভব সম্পর্কিত মতবাদ গুলি এমনই বিক্ষিপ্ত এবং পরস্পর বিরুদ্ধ যে, সংস্কৃত দৃশ্যকাব্যের উদ্ভবের প্রকৃত তথ্য তার থেকে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।
অথর্ববেদ রস আহরণ করে নাট্য রচনা করা হয়েছে ।