ঋকসংহিতার দশম মন্ডলের ৭৫ তম সূক্ত নদী সূক্তে সংকলিত নদীসমূহের নাম উল্লেখ করে প্রাচীন ভারতের নদী সম্পর্কে তোমার অভিমত নদীসূক্তের বৈশিষ্ট্যসহ বর্ণনা কর। or, নদী সূক্তের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
নদী সূক্তে সংকলিত নদীসমূহের নাম উল্লেখ করে প্রাচীন ভারতের নদী সম্পর্কে তোমার অভিমত নদীসূক্তের বৈশিষ্ট্যসহ বর্ণনা
নদী সূক্ত | ঋকসংহিতার দশম মন্ডলের ৭৫ তম সূক্ত |
নদী সূক্তের ঋষি | প্রিয়মেধের পুত্র সিন্ধুক্ষিৎ |
নদী সূক্তের ছন্দ | জগতী |
নদী সূক্তের দেবতা | নদী |
নদী সূক্তে সংকলিত নদীসমূহের সংকলিত নদীসমূহের নাম:-
ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের ৭৫ তম সূক্তের (নদীসমূহের ) ৫ তম ও ৬ষ্ঠ মন্ত্রে যে সকল নদীর উল্লেখ আছে, সেগুলি হল-সাতটি প্রধান নদী -গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, শুতুদ্রী, পরুষ্ণা, মরুৎবৃধা,আর্জীকিয়া। এদের অবয়বভূত আরও তিনটি নদী-অসিক্নী, বিতস্তা, সুষোমা মিলিত হয়েছে আর্জীকিয়া নদীর সঙ্গে। আবার সিন্ধু নদী কোন কোন নদীর সহিত মিলিত হয়েছে তা বলতে গিয়েও কতকগুলি নদীর নাম পাওয়া যায়। সেগুলি হল- তৃষ্ঠামা, সুসর্ত্তু, রসা, শ্বেতী, ক্রুমু, গোমতী,কুভা,মেহৎনু। সিন্ধুনদী এই সকল নদীর সঙ্গে একত্রে বয়ে চলেছে। তাই ঋষি সিন্ধুক্ষিৎ বলেছেন-
” ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতি শুতুদ্রি স্তোমং সা তো পরুষ্ণ্যা।
অসিক্ন্যা মরুদ্বৃধে বিতস্তয়ার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষোময়া।।” (১০.৭৫.৫)
“তৃষ্টাময়া প্রথমং যাতবে সজূঃ সুর্সত্বা শ্বেত্যা ত্যা।
ত্বং সিন্ধো কুভয়া গোমতীং ক্রুমুং মেহৎন্বা সরথং যাভিরীয়সে।।” (১০.৭৫.৬)
প্রাচীন ভারতের নদী সম্পর্কে অভিমত
ঋগ্বেদের কিছু কিছু সূক্তে এবং বিভিন্ন মন্ত্রে যে সকল নদীর উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে সরস্বতী, সিন্ধু, বিপাশা, শুতুদ্রী উল্লেখযোগ্য। তবে এই নদী গুলির মধ্যেও সরস্বতীর গুরুত্ব সর্বাধিক। সরস্বতী স্বয়ং নদীসমূহের মাতৃস্বরূপ। তার মাহাত্ম্য ও কীর্তি অন্যান্য নদী অপেক্ষা বেশি। কিন্তু এই সরস্বতী নদী অধুনা রাজপুতনার মরুভূমিতে লুপ্ত হয়ে গেছে। সরস্বতীর পরেই সিন্ধু নদীর স্থান। সকল নদী অপেক্ষা সিন্ধু নদীই তেজে শ্রেষ্ঠ, অত্যন্ত বেগবান। সিন্ধু নদীর পূর্বভাগ পাঞ্জাব দেশের নদী সমূহ এবং পশ্চিম দিকে কাবুল দেশের নদী সমূহ আছে। ঋগ্বেদের দশমমণ্ডলেই মাত্র একবার গঙ্গা নদীর নাম পাওয়া যায়। এই সূক্তে উল্লেখিত নদী সমূহের মধ্যে কিছু নদীর নাম বর্তমানে পরিবর্তিত হয়েছে। সেগুলি হল -শুতুদ্রী=শতদ্রু, পরষ্ণি=ইরাবতী, অসিক্নী=চন্দ্রভাগা, বিতস্তা=ঝিলাম, আর্জিকীয়া=বিপাশা, কুভা=কাবুল নদী, গোমতী=গোমাল নদী, সুষোমা= সিন্ধু নদী।
নদী সূক্তের বৈশিষ্ট্যসহ বর্ণনা
ভূমিকা:– ঋগ্বেদে অন্তত পঁচিশটি নদীর উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে সরস্বতী প্রধান। তবে সিন্ধু নদীর গুরুত্বও কম নয়। এই নদীর বেশ কয়েকটি উপনদী উল্লেখিত হয়েছে। ঋকসংহিতার দশম মন্ডলের ৭৫ তম সূক্তটি নদীসূক্ত নামে পরিচিত। এই সূক্তের ঋষি হলেন -প্রিয়মেধের পুত্র সিন্ধুক্ষিৎ, ছন্দ হল জগতী এবং দেবতা নদী।
নদী সূক্তের বৈশিষ্ট্য
নদীসূক্তের বৈশিষ্ট্য নিম্নে সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে-
নদী সূক্তে সিন্ধু প্রবাহমার্গ
নদীসমূহ পৃথিবীলোক, অন্তরীক্ষলোক এবং দ্যুলোক-এই তিন লোকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহমানা নদীসমূহের মধ্যে সিন্ধু নদীই নিজ তেজের দ্বারা সকলকে অতিক্রম করে দ্রুতবেগে প্রবাহিত হচ্ছে। ঋষির দর্শনে-
“প্র সু ব আপো মহিমানমুক্তমং কারূর্বোচাতি সদনে বিবস্বতঃ।
প্র সপ্তসপ্ত ত্রেধা হি চক্রমুঃ প্র সৃত্বরীণামতি সিন্ধুরোজসা।।”
নদী সূক্তে সিন্ধুর গতি:-
শস্যপূর্ণ ভূমির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় সিন্ধুর জলধারায় চারিদিকের ভূমি উর্বর হয়ে সোনার ফসল ফলে। বিনা বাধায় সিন্ধুর প্রবাহের জন্য বরুনদেব তাঁকে পথ নির্মাণ করে দিলে সে দুরন্তবেগে সকল নদীকে অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়। ঋষির দর্শনে-
” প্র তেহরদদ্বরুনো যাতবে পথঃ সিন্ধো যদ্বাজাং অভ্যদ্রবস্ত্বম্।
ভূম্যা অধি প্রবতা যাসি সানুনা যদেষামগ্রং জগতামিরজ্যসি।।”
নদী সূক্তে সিন্ধুর গর্জন:-
পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সিন্ধুর শব্দ উত্থিত হয়। সিন্ধুর শব্দ শুনে মনে হয় যেন অন্তরীক্ষ থেকে ভীষণ শব্দে বৃষ্টি পড়েছে। সিন্ধুর আগমনকালে তাঁকে মনে হয় গর্জনকারী বৃষ। ঋষির দর্শনে-
” দিবি স্বনো যততে ভূম্যোপর্যনন্তং শুষ্মমুদিযর্তি ভানুনা।
অভ্রাদিব প্র স্তনয়ন্তি বৃষ্টয়ঃ সিন্ধুর্যদেতি বৃষভো ন রোরূদেৎ।।”
নদী সূক্তে সিন্ধুর সহগামিনী:-
অন্যান্য নদীসমূহ নিজ গতিতে প্রবাহিত হয়ে সিন্ধু নদীতে পতিত হয়ে সিন্ধুর জলরাশি ও তার গতি বৃদ্ধি করে শান্ত হয়ে যায়। যেমন- শিশুবৎসেরা গাভীর দুগ্ধ পান করে শান্ত হয়ে যায়। যুদ্ধ করবার সময় রাজা যেমন সৈন্য নিয়ে যায়। ঠিক তেমনি রাজারূপ সিন্ধুও সহগামিনী দুইটি নদী শ্রেনী নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঋষির দর্শনে-
” অভি ত্বা সিন্ধো শিশুমিন্ন মাতরো বাশ্রা অর্ষন্তি পয়সেব ধেনবঃ।
রাজেব যুদ্ধা নয়সি ত্বমিৎসিচৌ যদাসামগ্রং প্রবতামিনক্ষসি।।”
নদী সূক্তে সিন্ধুর বর্ণ ও আকার:-
সিন্ধু হল ঋজুগামিনী ও তাঁর বর্ণ শুভ্র। তাঁর দীপ্তিতে চারিদিকে উজ্জ্বল। অহিংসিতা সিন্ধুর জলের গভীরতা ও প্রশস্ততার জন্য ঋষি তাঁকে সুন্দরী স্থূলকায়া নারীরূপে বর্ণনা করেছেন। ঋষির দর্শনে-
”ঋষিত্যেনী রুশতী মহিত্বা পরি জ্রয়াংসি ভরতে রজাংসি।
অদব্ধা সিন্ধুরপসামপস্তমাশ্বা ন চিত্রা বপুষীব দর্শতা।।”
নদী সূক্তে সিন্ধুর বসন ও সম্পদ:-
সিন্ধু নদী চিরযৌবনা ও সুন্দরী। এর উৎকৃষ্ট ঘোটক, উৎকৃষ্ট রথ ও উৎকৃষ্ট বসন আছে। সুবর্ণ অলংকারে সে উত্তমরূপে সজ্জিত। অন্নবতী সিন্ধুর অববাহিকায় সীলমা খড় ও মধুবর্ষনকারী পুষ্প পাওয়া যায়। যে পুষ্পের দ্বারা সে স্বয়ং আচ্ছাদিত। ঋষির দর্শনে-
“স্বশ্বা সিন্ধুঃ সুরথা সুবাসা হিরণ্যয়ী সুকৃতা বাজিনীবতী।
ঊর্ণাবতী যুবতিঃ সীলমাবত্যুতাধি বস্তে সুভগা মধুবৃধম্।।”
নদী সূক্তে সিন্ধুর মাহাত্ম্য
অশ্বযুক্ত সুন্দর রথে আরোহন করে সিন্ধু যজ্ঞে অন্ন দান করেন। যজ্ঞভূমিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সিন্ধুর মাহাত্ম্য অপরিসীম। অহিংসিত, দুর্বার, মহৎ এবং মহিমময় এই সিন্ধু নদী অপরিমিত যশের অধিকারিনী। ঋষির দর্শনে-
“সুখং রথং যুযুজে সিন্ধুরশ্বিনং তেন বাজং সনিষদস্মিন্নাজৌ।
মহান্ হ্যস্য মহিমা পনস্যতেহদব্ধস্য স্বযশসো বিরপশিনঃ।।”
নদী সূক্তের মূলায়ন
বৈদিক ঋষিদের প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে নদীও দেবতা। তবে নদীর দেবত্ব কল্পনায় কোনো অসঙ্গতি নেই। বৈদিক দেবতা আত্মস্বরূপ। আত্মা এক, অতএব দেবতাও এক। তবে দেবতা এক হলেও যেহেতু তিনি অনিমাদি মহৈশ্বর্যের অধিকারী সেইহেতু তিনি বহুরূপ ধারন করতে পারেন। নিরুক্তকার স্পষ্টতঃ বলেছেন-
” মাহাভাগ্যাদ্দেবতায়া এক আত্মা বহুধা স্তূয়তে।”
অতএব, গঙ্গা, সরস্বতী, সিন্ধু প্রভৃতি নদী দেবভাবাপন্ন হবে- এই রূপই স্বাভাবিক। তাছাড়া নদীবিধৌত ভূভাগে বসবাসকারী আর্য ঋষিরা নদীর শস্যপ্রদ কল্যানকররূপ দেখে সহজেই দেবত্ব আরোপ করেছিলেন। আর সেই দেবত্বরূপী সিন্ধু নদীর মহিমা অপরিসীম।