অন্নংভট্টকে অনুসরন করে প্রত্যক্ষের লক্ষণ আলোচনা কর। প্রত্যক্ষের দুটি প্রকারভেদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।
অন্নংভট্টকে অনুসরন করে প্রত্যক্ষের লক্ষণ ও প্রত্যক্ষের দুটি প্রকারভেদের বৈশিষ্ট্য
প্রত্যক্ষের লক্ষণ আলোচনা
উ:- প্রমাণ চার প্রকার। যথা – প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ।
এই চারটি প্রমাণের মধ্যে প্রথমে প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন অন্নংভট্ট। প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল সবসম্মত প্রমাণ। প্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রাধান্যের কারণ হল প্রত্যক্ষ প্রমাণ অন্য প্রমাণের উপজীব্য। অন্য প্রমাণগুলি প্রত্যক্ষের অধীন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে প্রথমেই প্রত্যক্ষ প্রমাণের লক্ষণ করা হল কেন?
তার উত্তরে অন্নংভট্ট বলেছেন- প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা প্রমেয় বস্তুর সাক্ষাৎকার হয়। তাতে বস্তুটি এমন স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হয় যে তরপর আর ঐ বস্তুর জ্ঞানের জন্য প্রায়শঃ অন্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। এইজন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণের লক্ষণ প্রথমে করা হয়েছে-
‘প্রত্যক্ষজ্ঞানকরণং প্রত্যক্ষম্।’
অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের করণই হল প্রত্যক্ষ।
আচার্য অন্নংভট্ট প্রত্যক্ষের লক্ষণ করেছেন-
‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্যং জ্ঞানং প্রত্যক্ষম্।’
অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষ রূপ সম্বন্ধ থেকে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলে। এখানে ইন্দ্রিয় শব্দের দ্বারা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটিকেই বলা হয়েছে। অর্থ শব্দের দ্বারা ঘট প্রভৃতি পদার্থকে বলা হয়েছে। ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষ বা সম্বন্ধ হলে যে জ্ঞান হয়, তাকেই প্রত্যক্ষ বলে। অনুমিতি ও স্মৃতি প্রভৃতিতে অতিব্যাপ্তি বারনের জন্য ‘ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজন্য’ বলা হয়েছে। কারন অনুমিতি প্রভৃতি ‘ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজনিত নয়। প্রত্যক্ষের লক্ষণ নিয়ে প্রাচীন ও নব্য নৈয়ায়িকগণের মতবিরোধ আছে। প্রাচীনমতে ইন্দ্রিয়ত্বাবচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অর্থের সন্নিকর্ষরূপ সম্বন্ধের পরক্ষণে প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয়। অতএব, ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষই প্রত্যক্ষের অসাধারন কারণ। নবীন মতে ইন্দ্রিয়ত্বাবচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের করণ এবং তাদের সন্নিকর্ষ হল ব্যাপার, অন্নংভট্ট এখানে প্রাচীন মত গ্রহণ করেছেন।
তর্কসংগ্রহকার প্রত্যক্ষ প্রমাণের শ্রেনীবিভাগ প্রসঙ্গে বলেছেন-
‘তৎ দ্বিবিধং নির্বিকল্পং সবিকল্পকঞ্চেতি।’
অর্থাৎ নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক ভেদে প্রত্যক্ষ দু প্রকার। বিকল্প শব্দের অর্থ-
‘নামজাত্যাদিযোজনা, শব্দজ্ঞানানুপাতি শব্দশূন্যো বিকল্পঃ।’
অতএব, বিকল্প রহিতকে নির্বিকল্পক বলে।
i) নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ:-
অন্নংভট্টের মতে, নির্বিকল্পক হল-
‘ নিষ্প্রকারকং জ্ঞানং নির্বিকল্পকম্।’
‘নিষ্প্রকারক’ শব্দের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন-
” বিষেষণ বিশেষ্য সম্বন্ধানবগাহিজ্ঞানম্।
প্রকারতা শূন্য জ্ঞানত্বমেব নির্বিকল্পকত্বম্।”
‘ বিকল্পয়তি বস্তু যৎ তদ্ বিকল্পকম্’ –
অর্থাৎ কোন বস্তুকে যে বিশিষ্ট করে, সে বিকল্পক বিশেষণ। অতএব, বিশেষণ রহিত বস্তুর স্বরূপমাত্র যে জ্ঞানের বিষয়, সেটি নির্বিকল্পক।নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষে আমারা কোন একটা কিছু এরূপ অনুভব করি। সেখানে বস্তুটি বিদ্যমান থাকলেও বস্তুটির সঙ্গে ধর্মের কোনো রূপ সংসর্গ বা সম্বন্ধ করতে আমরা পারি না। ফলে বস্তুটি সঠিক কিনা তা আমাদের জ্ঞানে ভাসমান হয় না।
বিষয়েন্দ্রিয় সংযোগের ক্ষণে বিষয়ের স্বরূপটি বিচ্ছিন্ন থাকায় জ্ঞানটিকে নিষ্প্রয়োজন বলা হয়েছে। যেমন – ‘অয়ং ঘটঃ’ বললে ঘটাকার জ্ঞানের বিষয় তিনটি হয়।
যথা- ঘটটি বিশেষ্য, ঘটত্বটি বিশেষণ এবং সংসর্গ বা সমবায়টি হল সম্বন্ধ। বিশেষ্য ও বিশেষণের জ্ঞান সর্বদাই সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।
সুতরাং, প্রত্যক্ষের সময় বিশেষ্য, বিশেষণ ও সম্বন্ধ একত্রিত হয়ে থাকে। অয়ং ঘটঃ – এই ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রকার হচ্ছে ঘটত্ব আর জ্ঞানটি হচ্ছে ঘটত্ব আর জ্ঞানটি হচ্ছে ঘটত্ব প্রকারক জ্ঞান। কিন্তু যে প্রত্যক্ষে বিশেষ্য, বিশেষণ ও সম্বন্ধ জ্ঞান প্রতিজ্ঞাত হয় না। তাকেই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ বলা হয়েছে।
সুতরাং নির্বিকল্পক বা নিষ্প্রকারক জ্ঞানে বিশেষ্য, বিশেষণ ও সম্বন্ধ থাকলেও সেগুলো পরস্পর অসম্বন্ধ বা বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের নাম, জাতি ইত্যাদির কোন ধারনা হয় না। তাই কোন ভাষা বা শব্দ দ্বারা নির্বিকল্পক জ্ঞানটি প্রকাশ করা যায় না।
এজন্য অন্নংভট্ট বলেছেন-
‘বিশেষণ বিশেষ্য সম্বন্ধানবগাহিজ্ঞানং নির্বিকল্পকম্।’
বিশেষণ বিশেষ্য ও সম্বন্ধ জ্ঞান না হওয়ায় নির্বিকল্পককে অতীন্দ্রিয় জ্ঞান বলা হয়। তাই এটি প্রমা নয়।
ii) সবিকল্পক প্রত্যক্ষ:-
নির্বিকল্পক জ্ঞানের লক্ষণ বলার পর অন্নংভট্ট সবিকল্পক জ্ঞানের লক্ষণ বলেছেন- ‘ স প্রকারকং জ্ঞানং সবিকল্পকম্।’ এই সবিকল্পক জ্ঞানের লক্ষণ শুধু সবিকল্পক প্রত্যক্ষেরই লক্ষণ নয় , অবিকল্পক জ্ঞানমাত্রেরই লক্ষণ। এখানে সবিকল্পক প্রত্যক্ষের লক্ষণই অনুমিতি আদি জ্ঞানে সমন্বিত হওয়ায় অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়। সুতরাং স্বীকার করতে হবে যে, এই লক্ষণটি সবিকল্পক জ্ঞানমাত্রেরই লক্ষণ।
এই সবিকল্পক জ্ঞানের লক্ষণ করার পর অন্নংভট্ট এর উদাহরণ দিয়েছেন-
‘ডিত্থোঅয়ং ব্রাহ্মণোঅয়ং শ্যামোঅয়ম্ ইতি।’
নির্বিকল্পক জ্ঞানের লক্ষণ বলার পর সেখানে কিন্তু কোন উদাহরণ দেওয়া হয়নি। কারণ এর দ্বারা বোঝা যায় যে, নির্বিকল্পক জ্ঞানের প্রকাশক কোন শব্দ নেই। বিকল্প শব্দের অর্থ বিশেষণ। বিশেষণ বিশিষ্ট বস্তুকে গ্রহণকারী জ্ঞানই সবিকল্পক জ্ঞান। এখানে বিশেষণ শব্দের দ্বারা নাম, জাতি, গুন, ক্রিয়া বিবক্ষিত হয়। এইজন্যই বলা হয়েছে-
” নামজাত্যাদিযোজনাসহিতং জ্ঞানং সবিকল্পকং।”
অন্নংভট্ট সপ্রকারক শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন-
‘ নামজাত্যাদিবিশেষণ বিশেষ্য সম্বন্ধাবগাহি জ্ঞানং।’
ডিত্থোঃ – একটি বস্তুর নাম, ব্রাহ্মণ হল একটি জাতির নাম, শ্যাম হল একটি গুন। নাম, জাতি, গুণ বিশেষণ রূপে তৎ তৎ বিশেষ্যের সঙ্গে সম্বন্ধ বিশিষ্ট হয়ে জ্ঞানের বিষয় হওয়ার জন্য এই জ্ঞানগুলিকে বলা হয় সবিকল্পক জ্ঞান।
এটাই হল প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে আলোচনা।