দণ্ডী কাব্যাদর্শ
দণ্ডীর কাব্যাদর্শ
কাব্যাদর্শের গ্রন্থাকার আলংকারিক দণ্ডী রীতিবাদী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। দণ্ডীর আবির্ভাব কাল সপ্তম শতকের শেষার্ধ বলে সমীক্ষকরা মনে করেন।দশকুমারচরিতম্ নামে প্রসিদ্ধ গদ্যকাব্য, কাব্যাদর্শ নামে অলঙ্কার গ্রন্থ,ছন্দোবিচিত নামে আর একটি গ্রন্থের রচয়িতা রূপে দণ্ডীকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। রাজশেখর তাই যথার্থই বলেছেন-
” ত্রয়ো দণ্ডী প্রবন্ধাশ্চ ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতাঃ।।”
দশকুমারচরিতম্ দন্ডীর প্রথম জীবনের রচনা এবং কাব্যাদর্শ তাঁর পরিণত বয়সে সুপরিনত চিন্তার ফল।
কাব্যাদর্শ গ্রন্থের বিভাগ
কাব্যাদর্শ গ্রন্থটি তিনটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। প্রথম পরিচ্ছেদে দন্ডী সর্বশুক্লা দেবী সরস্বতীকে নিজ হৃদয়ে বরণ করে কাব্যের লক্ষণ, বিভাগ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কাব্যতত্ত্বের প্রতিটি বিষয়ই দণ্ডীর স্বকীয়তা প্রকাশিত হয়েছে ‘কাব্যাদর্শ’ এ। ভামহ, দণ্ডীর পথ ছিল পৃথক। তাই ভামহ প্রোক্ত কাব্যলক্ষণের কাঠামোটি দন্ডীর যাদুস্পর্শে বদলে গেছে।
কাব্যের শরীর সম্পর্কে কাব্যাদর্শ গ্রন্থে দন্ডীর মত
এটি আচার্য ভামহের মত কিন্তু দন্ডী ভিন্ন মত অবলম্বন করে বলেন কাব্যের শরীর হল ইষ্ট অর্থযুক্ত পদসমূহ-
“শরীরং তাবদিষ্টর্থ ব্যবচ্ছিন্না পদাবলী।”
ভামহ পরবর্তী অধিকাংশ আলংকারিক শব্দ ও অর্থের কাব্য শরীরত্ব স্বীকার করেছেন। কেবলমাত্র পন্ডিতরাজ জগন্নাথ দন্ডীর আনুগত্য স্বীকার করে কাব্যের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
” রমনীয়ার্থ প্রতিপাদকঃ শব্দ কাব্যম্।”
দন্ডীর মতে কাব্যাদর্শ গ্রন্থে কাব্য বিভাগ
দন্ডীর মতে কাব্য ত্রিবিধ। যথা গদ্যকাব্য, পদ্যকাব্য ও মিশ্রকাব্য। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন-
“পদ্যং গদ্যঞ্চ মিশ্রঞ্চ তৎ ত্রিবৈধ ব্যবস্থিতম্।
পদ্যং চতুষ্পদী তচ্চ বৃত্তং জাতিরিতি দ্বিধা।।”
কাব্যাদর্শ গ্রন্থে দন্ডী মতে মহাকাব্যের লক্ষণ
মহাকাব্য প্রসঙ্গে দন্ডী বলেছেন যে, মহাকাব্য হবে অলংকারযুক্ত এবং লোকরঞ্জক, সর্গের শেষে থাকবে বিভিন্ন বৃত্তান্ত। মহাকাব্যের লক্ষণ তিনি বলেছেন-
” সর্গবন্ধো মহাকাব্যমুচ্যতে তস্য লক্ষণম্।
আশীর্ণমস্ক্রিয়াবস্তুনির্দেশো বাপি তন্মুখম্।।”
কাব্যাদর্শ গ্রন্থে দন্ডী মতে গদ্যকাব্যের বিভাগ
মহাকাব্যের লক্ষণ ব্যাখ্যার পর দন্ডী গদ্যকাব্যের দুটি বিভাগ – কথা ও আখ্যায়িকার লক্ষণ ব্যাখ্যা করেছেন-
“অপাদঃ পাদসন্তানঃ গদ্যমাখ্যায়িকা কথা
ইতি তস্য প্রভেদী দ্বৌ ত্রয়োরাখ্যায়িকা কিল।।”
কাব্যাদর্শ গ্রন্থে দন্ডীর মতে চম্পূকাব্যের লক্ষণ
দণ্ডী কাব্যের অপর একটি ভেদ নিরূপন করেন। সেটি হল চম্পূকাব্য। তার লক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন –
“গদ্য পদ্যময়ী কাচিৎ চম্পূরিত্যভিধীয়তে।”
কাব্যাদর্শ গ্রন্থে দন্ডীর মতে অলংকার
আলংকারিক রূপে আচার্যদন্ডী রীতি প্রস্থানের সমর্থক হলেও অনেকেই দণ্ডীকেই অলংকার প্রস্থানের প্রবক্তা হিসেবে স্বীকার করেছেন। অলংকার শব্দটি দন্ডী ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তার মতে-
“কাব্যশোভাকরান্ ধর্মান্ অলংকার প্রচক্ষতে।”
কাব্যাদর্শ অনুসারে দন্ডীর মতে কাব্যের রস
তাঁর মতে, উপমাদি অলংকার এবং শ্লেষাদি গুন সবই বৃহৎ অর্থে অলংকার পদবাচ্য কিন্তু কাব্যে রসস্থিতি বিষয়ে যে দন্ডী অবহিত ছিলেন না এমন নয়, তিনি কাব্যের চতুর্থ গুণ মাধুর্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে কখনো বর্ণ, কখনো বা অর্থের উৎকর্ষ সাধন করে মাধুর্য গুনটি কাব্য রসের পরিপুষ্ট বিধান করে। তাঁর মতে রসবৎ কাব্য মধুর-
” মধুরং রসবদ বাচি বস্তুন্যাপি রসস্থিতিঃ।”
দন্ডীর মতে কাব্যাদর্শ গ্রন্থে কাব্যের রীতি
এছাড়া দন্ডী কাব্যে রীতি ও মার্গের গুরুত্ব বিশেষভাবে স্বীকার করে পরবর্তী আলংকারিক বামন যাকে রীতি বলেছেন দণ্ডী তাকেই বলেছেন মার্গ। তাঁর মতে মার্গের সাথে গুণ ও প্রয়োগের সম্বন্ধে অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বলেছেন-
” অস্ত্যনেকো গিরং মার্গঃ সূক্ষণভেদঃ পরস্পরং।”
বৈদর্ভী ও গৌড়য়রীতি দন্ডীর মতে প্রধান। অন্যান্য রীতিগুলি এই প্রধান রীতির মিশ্রণের ফল। আচার্য দন্ডীর মতে তন্মধ্যে বৈদর্ভী রীতি আদর্শ। এই রীতির দশটি গুন – শ্লেষ, প্রসাদ, সমতা, সুকুমারতা, মাধুর্য, অভিব্যক্তি, উদারতা, অজং, কান্তি, সমাধি। এই দশটি গুণ বৈদর্ভী রীতি প্রাণস্বরূপ অন্যান্য রীতিতে এই সব গুণের বিপর্যয় পরিলক্ষিত হয়-
” ইতি বৈদর্ভমার্গস্য প্রাণা দশগুণাঃ স্মৃতাঃ।
এষাং বিপর্যয়ঃ প্রায়ো দৃশ্যতে গৌড়বত্মাণি।।”
কাব্যাদর্শের লেখক দণ্ডী
কাব্যাদর্শের লেখক দণ্ডী ও দশকুমারচরিতের লেখক দন্ডী অভিন্ন ব্যক্তি কিনা এ বিষয়ে পন্ডিতবর্গের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কারো কারো মতে উভয় দন্ডী এক ব্যক্তি নয় কারণ কাব্যাদর্শে দণ্ডীর মত হল কাব্যের স্বল্প দোষ উপক্ষনীয় নয়। অথচ দশকুমারচরিতে ভুরি ভুরি দোষেয দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যারা উভয় দণ্ডীকে অভিন্ন মনে করেন তারা বলেন তত্ত্ব এবং প্রয়োগে চিরকালের পার্থক্য দেখা যায়। উত্তর রচনায় অসঙ্গতির আরোও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেটি হল দশকুমারচরিত প্রথম জীবনের রচনা এবং কাব্যাদর্শ অনেক পরবর্তীকালে পরিণত বয়সের রচনা। কাব্যাদর্শে দীর্ঘ সমাস নেই কিন্তু দশকুমার চরিতে দীর্ঘ সমাস প্রতি ছন্দেই আছে। অবশ্য এজন্যই দশকুমারচরিত কাব্যাদর্শকার দণ্ডীর রচনা নয় একথা বলা যায় না। কারণ পদ্য দীর্ঘ সমাসবারিত কিন্তু গদ্য সমাস বাহুল্য প্রাণস্বরূপ স্বীকৃত ।