বিদ্যা ও অবিদ্যা বলতে কি বোঝ? আত্মজ্ঞান লাভের জন্য এই দুই এর সম্বন্বয় কিভাবে হয়?
বিদ্যা ও অবিদ্যা বলতে কি বোঝ?
উ:- বিভিন্ন উপনিষদে আত্মতত্ত্ব বা মুক্তি লাভের উপায় হিসেবে বিভিন্ন পথের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আত্মস্বরূপ লাভ করলে মানুষ সংসারে জন্ম- মৃত্যু জ্বরাব্যধি প্রভৃতি অনর্থসমূহের হাত থেকে মুক্তি পায়, কারণ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে-
” তে তং ভূক্তা স্বর্গলোকং বিশালম্
ক্ষীনোপূণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি।।”
কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন সাধনা। ঈশোপনিষদে মুখ্যরূপ পরম পুরুষার্থ লাভের উপায় হিসাবে দুটি পথের কথা উল্লেখ রয়েছে-
- i) জ্ঞান মার্গ বা বিদ্যা
- ii) কর্মমার্গ বা অবিদ্যা।
i) জ্ঞানমার্গ বা বিদ্যা
বিদ্যা শব্দের ব্যুৎপত্তি হল বৃদ্ + ক্যপ্ + ল্যপ্। ঈশোপনিষদে বিদ্যা বলতে একটি বিশেষ অর্থ গৃহীত হয়েছে। এখানে বিদ্যা শব্দের দ্বারা আত্মজ্ঞান অর্থ গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং বিদ্যা শব্দের অর্থ হিরণ্যগর্ভোপাসনা। উপনিষদে কোথাও জ্ঞান, কোথাও দর্শন, কোথাও বিদ্যা প্রভৃতি অর্থে বিদ্যা ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উপনিষদে বলা হয়েছে-
“জ্ঞায়তে দৃশ্যতে বা বিদ্যতে বা দেবতাত্ত্বং সাক্ষাৎ ক্রিয়তে অনেন।”
এই বিদ্যার সাহায্যে মর্ত্যের মানবদেব মানবে রূপান্তরিত হয়। এই বিদ্যার সাহায্যে মানুষ ভগবান জেনে ভগবত তুল্য হয়। সুতরাং যে শক্তির সাহায্যে মানুষ দিব্য জীবন লাভ করে, আত্মার স্বরূপকে জেনে কৃতার্থ হয় তার নাম বিদ্যা।
এই বিদ্যা শুদ্ধ সাধকের অন্তরে আত্মবোধ, বিদ্মাত্ববোধ, ব্রহ্মবোধ এই ত্রিবিধ ভাবে আত্মস্বরূপ প্রকাশ করে। এই বিদ্যা চিত্তকে অন্তর্মুখী করে বশীভূত করে প্রকৃত জীবনকে দিব্য জীবনে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা অন্তরে প্রবল ভাবে জেগে ওঠাকে আত্মবোধ বলে। এ প্রসঙ্গে ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে-
” যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি
সর্বভূতেষু চাত্মাণং ততো ণ বিজুগুপ্সতে।।”
যিনি নিজের আত্মাকে সর্বভূতকে অর্থাৎ সকল বস্তুকে দেখেন এবং সমস্ত বস্তু বা ভূতের মধ্যে নিজের আত্মাকেও দেখেন, তিনি এরূপ দর্শনের ফলে কাউকেই ঘৃণা করেন না। আত্মবোধ জাগলে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে নিজের মনে হয়-‘বসুধৈ কুটুম্বকম্।’
ii) কর্মমার্গ বা অবিদ্যা:-
ঈশোপনিষদের নবম মন্ত্রে অবিদ্যা শব্দের অর্থ কর্ম বলে উল্লেখিত হয়েছে। বেদবিহিত অগ্নি, হোত্রাদি কর্মানুষ্ঠানকে বোঝানো হয়েছে। অবিদ্যা বলতে অজ্ঞান মায়া শক্তিতম প্রভৃতি বোঝালেও এখানে নঞ্ পদের সঙ্গে সমাস করে ‘ন বিদ্যা’ ‘ অবিদ্যা ‘ অর্থাৎ বিদ্যা বা তত্ত্বজ্ঞান বিরোধী কর্মকে বলা হয়েছে-
” অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহবিদ্যামুপাসতে
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ”।।
অর্থাৎ যে শক্তির দ্বারা সৃষ্টির নিম্নস্তর পরিচালিত হয়, যে শক্তি জীবকে অজ্ঞানে অভিভূত করে রাখে, যে শক্তির প্রভাবে আত্মস্বরূপ ভুলে যায় তারই নাম অবিদ্যা। এই জন্য বিদ্যার আর এক নাম আবরণ শক্তি-
‘ অহং বহুস্যাং প্রতয়েব।’
অর্থাৎ আমি বহুরূপে আত্মরূপে আত্মপ্রকাশ করি।
অহম সৃষ্টিতে রূপায়িত করার জন্য অবিদ্যার প্রয়োজন। অবিদ্যা আমাদের ভিতরে জাগায় অহম্, অভিমান ও ভেদবোধ। এই অভিমান অহম ভেদবোধ না থাকলে বহুত্ব প্রকাশ হয় না, এই ভেদবোধ অবলম্বনে ব্যক্তিত্বের উন্মেষ। এই ব্যক্তিত্বের উন্মেষ না থাকলে সৃষ্টিলীলা সম্ভবকর হতো না এই ব্যক্তিত্ব এই ক্ষুদ্র অহমেই আবার বিরোধ হয়।
আত্মজ্ঞান লাভের জন্য এই দুই এর সম্বন্বয় কিভাবে হয়?
বিদ্যা ও অবিদ্যার মাঝে মূলত কোন ভেদ নেই। বীজের মধ্যে বৃক্ষ যেমন সংকুচিত অবস্থায় থাকে তেমনি কালক্রমে অবিদ্যার আবরণ ঘুচিয়ে বিদ্যার আবির্ভাব ঘটে। জ্ঞাননিষ্ঠা বা বিদ্যায় যারা প্রথমেই অসমর্থ তারা কর্মের মাধ্যমে আত্মপর লাভের পথে অগ্রসর হবেন। এই অবিদ্যার সাধনার ফলে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী হয়ে আত্মপ্রকৃতি ও বিশ্ব প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে মৃত্যুভয়কে জয় করেন। তাই বলা হয়েছে-
“ বিদ্যাং চাবিদ্যাঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে।।”
অর্থাৎ যিনি বিদ্যা ও অবিদ্যাকে যুগপৎ অনুষ্ঠেয় রূপে জানেন, তিনি কর্মের দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে দৈবজ্ঞান যোগে অমরত্ব লাভ করেন।
কঠোপনিষদে শাস্ত্রানুসারে শ্রেয় ও প্রেয় এই দুইটির মধ্যে যে শ্রেয়কে লাভ করে তার মুক্তি হয় আর যে প্রেয়কে বরণ করে সে সে মুখ্য মার্গ থেকে বিচ্যুত হয়। এখানে শ্রেয় শব্দের অর্থ বিদ্যা এবং প্রেয় শব্দের অর্থ অবিদ্যা। বৃহদারণ্যকে বলা হয়েছে-
” কর্মণা পিতৃলোকে বিদ্যায়া দেবলোকেঃ।”
অর্থাৎ কর্মের দ্বারা পিতৃলোক এবং বিদ্যার দ্বারা দেবলোক প্রাপ্ত হয়। বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়েরই ঈশ্বর তিনি আর একজন। সুতরাং ঈশোপনিষদের ব্রম্ভজ্ঞান লাভের আলোচনার পৃথকভাবে কর্ম ও জ্ঞানের নিন্দার দ্বারা উভয়ের সমুচ্চয় সাধনে প্রশংসার মধ্যে জীবনের মূল লক্ষ্য লাভের উপায়-
” হলদ্ধাচাপরাং লাভং ন মুণ্যতে ততঃ।”
আচার্য মনুর বর্ণনার মাধ্যমেও বিদ্যা ও অবিদ্যার প্রশংসা আলোচিত হয়েছে।