শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ হতে ঈশ্বরের স্বরূপ আলোচনা করা হল ।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে ঈশ্বরের স্বরূপ আলোচনা কর।
উ:- কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ। এর নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মুনি ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। শ্বেতাশ্বতর নামক ঋষি এর প্রবক্তা বা দ্রষ্টা বলে নামকরণ হয়েছে শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ। আচার্য শঙ্করের মতে ‘ শ্বেত ‘ অর্থে ইন্দ্রিয় অর্থাৎ শ্বেতাশ্বতর শব্দের অর্থ হল সংযতেন্দ্রিয়। আবার শ্বেত এবং অশ্বতর কৃষ্ণযজুর্বেদের চরক শাখার দুটি বিভাগ রূপেও উল্লেখিত হয়ে থাকে তাই এই উপনিষদের নামকরণ তাদের থেকে হয়েছে একথাও বলা যায়।
উপনিষদটি সম্পূর্ণ পদ্যে রচিত, ছয়টি অধ্যায়েও ১১৩টি মন্ত্রে সমন্বিত। এই উপনিষদের শংকর ভাষ্য নামে আচার্য শঙ্করের ভাষ্য প্রচলিত আছে। বর্তমানে দার্শনিকচার্য ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের ব্যাখ্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপনিষদটিতে মূল আলোচ্য বিষয় বেদান্তের ব্রহ্মবাদ, পুরাণের দেববাদ এবং সাংখ্যের যোগবাদ। তাছাড়া সাংখ্য ও কপিল শব্দের উল্লেখ আছে। অনির্বান এই উপনিষদটি সম্পর্কে বলেছেন মোটের উপর এযেন বেদান্তের ব্রহ্মবাদ, পুরাণের দেববাদ ও সাংখ্যের যোগবাদের – ” ত্রিবেণীসংগমত্।”
এই বিশ্বের উৎপত্তির কারণ সম্বন্ধে ব্রহ্মবাদীদের জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়েই এই উপনিষদের সূত্রপাত-
” কিং কারণং ব্রহ্মকুতঃ স্ম জাতা
জীবাম্ কেন ক্ব চ সম্প্রপ্রতিষ্ঠা।।”
পরমাত্মা এক অদ্বিতীয়, তিনি জালবান। জাল অর্থ মায়া। তাই মহেশ্বর হলেন মায়াধীশ-
” য একো জালবানীশত ঈশনীভিঃ
সর্বাল্লোঁকানীশত ঈশনীভিঃ।।”
সমস্ত পার্থিব জগৎকে এই উপনিষদে মায়া বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে বেদান্ত দর্শনের মায়াবাদের সঙ্গে শ্বেতাশ্বতের মায়া সংক্রান্ত ধারনার মিল আছে। এই মায়াবাদের সঙ্গে আধুনিক পন্ডিত কান্টের দর্শনের মিল খুঁজে পাওয়া যায় –
” This is virtually identical with the teaching of kant, that the things of experience one only phenomena of the things in it self.”
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের সমগ্র তৃতীয় অধ্যায়ে এই পরম পুরষের জেনেই সাধক মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে। এছাড়া মৃত্যুমরণের আর কোনো পথ নেই-
” তমেব বিদিত্বাঅতি মৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঅয়নায়।।”
এই পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা অশ্রেষ্ঠ কিছু নেই, সূক্ষতর বা মহত্তর কেউই নেই, তিনি বৃক্ষের মত নিশ্চলভাবে নিজপ্রকাশত্মক মহিমায় বিরাজিত, তাঁর দ্বারাই সমস্ত জগৎ পরিব্যপ্তা-
“যস্মাৎ পরং নাপরস্তি কিঞ্চিদ্
যস্মান্নানীয়ো ণ জায়োঅস্তি কশ্চিত্।
বৃক্ষ ইব স্তবো দিবি তিষ্টত্যেকঃ
তেনেদং পুর্ণং পুরুষেণ সর্বম্।।”
বীজ থেকে যেমন প্রকান্ত বৃক্ষের ক্রমিক আবির্ভাব হয় তেমনিভাবেই ব্রহ্ম থেকে জগতের ক্রমিক বিকাশ ঘটেছে। বীজের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ যেমন বৃক্ষ ঠিক তেমনি ব্রহ্মের শক্তির বিকাশ হল জগৎ। এই ব্রহ্ম – একমেবাদ্বিতীয়ম্।” নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত, স্বভাব, নির্গুন, নিষ্ক্রিয় হলেও বহুভাবে তিনি কীর্তিত হন। বেদে তাই বলা হয়েছে-
” একংসদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি।”
সকল দিকে তাঁর হস্তপদ, সকলদিকে তাঁর চক্ষু, সবদিকে তাঁর মুখ ও মস্তক, সকল লোকের কর্ণ তারই, তিনি সমস্ত জগৎ পরিব্যপ্ত করে আছেন- “সর্বর্মাবৃত্য তিষ্ঠতি।”
“বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখো।
বিশ্বতোবাহুরুত বিশ্বতস্পাত্।।”
এ জগতে যা কিছু অনিত্য বিষয় তা সব কিছুই ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদনীয়-
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত্।”
তিনি দুগ্ধে ঘৃতের ন্যায় সর্বত্র জগতে বিরাজ করেন। ঈশ্বরই জগৎ সৃষ্টির কারণ, তাই ব্রহ্মবিদগণ রুদ্র ভিন্ন দ্বিতীয় কোন বস্তুর অপেক্ষায় থাকে না-
” একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয় তস্থু
যা ইমাল্লোঁকানীশত ঈশনীভিঃ।।”
তিনি (রুদ্র) নিজের শক্তি সমূহের দ্বারা সমগ্র জগৎ শাসন করেন, তিনি প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে অন্তর্যামি রূপে অবস্থিত। নিখিল বিশ্বসৃষ্টি করে তিনি পালন করেন। প্রলয়কালে সংহারও করেন-
” যো দেবানাং প্রভবশ্চোদ্ভবশ্চ
বিশ্বাধিপো রুদ্রো মহর্ষিঃ।
হিরণ্যগর্ভং জনয়ামাস পূর্বম্
সনো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুণক্তু।।”
পরমেশ্বর সকল প্রাণীর মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থিত। সর্বব্যাপী, কর্মাধ্যক্ষ, নিরুপাধিকঃ ও নির্গুন। ইনিই আবার নিস্ফল, নিষ্ক্রিয়, শান্ত, নিরুবদ্য ও নিরঞ্জন। সূর্য ও চন্দ্র বা তারকার জ্যেতি তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না। পরন্তু তাঁর দীপ্তিতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দীপ্ত হয়। মাকড়সার জালের মত মায়াশক্তির দ্বারা ঈশ্বর নিজেকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। এই পরমেশ্বরকে যারা জানেন না তারা দুঃখে অভিভূত হয়ে থাকেন-
” ততো যদুত্তরতরাং তদরুপমনাময়ম্।
য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্ত্যেথেতরে দুঃখমেবাপিয়।।”
সেই পরমেশ্বর আমাদের শুভবুদ্ধি দিন, যাতে আমরা ব্রহ্মের সাযুজ্য লাভ করতে পারি।